দ্বীপ যদি একজন পর্যটক বা ভ্রমণকারীর জন্য অনেক আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থল হয়ে থাকে, তাহলে ভাবুন তো দ্বীপপুঞ্জগুলো ভ্রমণকারীদের জন্য কতটা আকর্ষণীয় হতে পারে? দ্বীপপুঞ্জগুলো সাধারণত বেশ কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত হয়।
দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপগুলো সাধারণ একসারিতে বা একগুচ্ছ হয়ে মহাসাগর বা সমুদ্রের পানিতে ভেসে থাকে। পানির ধারাই একগুচ্ছ দ্বীপগুলোর একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করে থাকে। আলাদা হয়ে থাকার কারণেই এক দ্বীপপুঞ্জের একেক দ্বীপের ভৌগলিক দৃশ্য বা গাছগাছালির প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হয়। তবে এটাই কিন্তু দ্বীপপুঞ্জের প্রধান আকর্ষণ।
এগুলোর সাথে সাথে ভিন্ন ভিন্ন দ্বীপের সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস এবং ইতিহাসও ভিন্ন ভিন্ন থাকে। পুঞ্জের একটা দ্বীপ থেকে আরেকটা দ্বীপের দূরত্ব হয়তো খুব বেশি থাকে না, তারপরও ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণের একেকটা দ্বীপকে স্বকীয় মনে হয়, মনে হয় যেন বেশ কয়েকটি দেশে ঘোরার স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে একটা দ্বীপপুঞ্জে ঘুরেই। নিচে এমনই কয়েকটি দ্বীপপুঞ্জের কথা আলোকপাত করা হলো:
গ্যালাপাগোস, ইকুয়েডর
দক্ষিণ আমেরিকার ৯০০ কিলোমিটার পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে ৪৫ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে আছে ১৮টি বৃহৎ আগ্নেয়-দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপপুঞ্জটি। এই আগ্নেয়-দ্বীপগুলোই চার্লস ডারউইনকে তাঁর বিবর্তনবাদের তত্ত্বের চিন্তা করতে সাহায্য করেছিল।

এখানকার বন্যপ্রাণীদের জীবন-যাপন দেখলে পুরো বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করা পর্যটকও হাঁ হয়ে যেতে বাধ্য। এই দ্বীপপুঞ্জে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে সমুদ্র-শৈবাল চিবুতে থাকা ইগুয়ানা; ছবি তোলা যাবে পেঙ্গুইন এবং সদা নৃত্যরত বুবিদের। এখানকার ইসাবেলা দ্বীপে রয়েছে কাছিমের সমাহার, সান্তাক্রুজে রয়েছে চার্লস ডারউইন রিসার্চ সেন্টার এবং বার্তোলোম দ্বীপে রয়েছে অবিস্মরণীয় মুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য।
বেশিরভাগ দ্বীপপুঞ্জেই পানির নিচের দৃশ্য দেখতে চমৎকার লাগে। তবে এখানকার পানির নিচে সীল, ডেভিলফিশ এবং সামুদ্রিক ইগুয়ানার সাথেও সাঁতার কাটা যাবে। সান্তাক্রুজের প্লারা মানসা এই দ্বীপপুঞ্জের সেরা জায়গাগুলোর একটি।

এখানে ভ্রমণে যেতে চাইলে ডিসেম্বর-মে’র ভিতরে যাওয়াই সেরা সময়। এ সময়টায় সমুদ্র বেশ শান্ত এবং তাপমাত্রাও বেশ সহনীয় মাত্রায় থাকে।
সোসাইটি আইল্যান্ডস, ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়া
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে জেগে ওঠা এই দ্বীপপুঞ্জটি মূলত দুই গ্রুপে বিভক্ত। গ্রুপ দুটির নাম লিওয়ার্ড এবং উইন্ডওয়ার্ড আইল্যান্ড গ্রুপ। এখানে প্রায় ১৪টির মতো দ্বীপ রয়েছে। স্থলভূমি বিবেচনায় এর আয়তন প্রায় ১,৫৯০ বর্গ কিলোমিটারের মতো।

প্রথম দিকে ইউরোপিয় পর্যটকেরা গ্রীষ্মপ্রধান দ্বীপ তাহিতিকে বর্ণনা করেছিল বিলাসের স্বর্গ হিসেবে। এই দ্বীপগুলোতে ছড়িয়ে আছে নির্মল ও বিশুদ্ধ সৌন্দর্য। মুরিয়া এবং হুয়াহিন দ্বীপে রয়েছে চমৎকার কিছু উপহ্রদ এবং খাঁজকাটা পর্বতমালা। আর বোরা বোরা দ্বীপটা বিখ্যাত মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া দম্পতিদের জন্য।
এখানে গেলে বোরা বোরা দ্বীপের উপহ্রদে চড়ে সূর্যাস্ত দেখাটা কোনোভাবেই মিস করা উচিৎ নয়। পর্যটকদের কাছে জায়গাটা খুব আকর্ষণীয়, কারণ এখানকার উপহ্রদগুলোর রঙ অসম্ভবভাবে নীল থেকে কমলা-গোলাপীতে পরিণত হয়ে যায়।

সারাবছরই এখানে যাতায়াত করা যায়। তবে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এখানে আর্দ্রতা একটু বেশি থাকে এবং বৃষ্টির পরিমাণও বেশি থাকে।
স্পাইস আইল্যান্ডস, ইন্দোনেশিয়া
বান্দা সমুদ্রে মাথা তুলে জেগে ওঠা হাজারের বেশি দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই দ্বীপপুঞ্জটি। এর আয়তন প্রায় ৭,০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। পঞ্চদশ শতাব্দিতে ইউরোপিয়দের দারুচিনি, লবঙ্গ ও জয়ফলের যোগান আসতো এখান থেকেই।

এ কারণেই অঞ্চলটা ঘুরে দেখার জন্য এবং কলোনি স্থাপনের আগ্রহ জাগে ইউরোপিয়ানদের। বর্তমানে দ্বীপগুলো বেশ নির্জন, তবে সুন্দর। ঔপনৈবেশিক ছাপটা এখনো বেশ ভালোভাবে লেগে আছে বান্দা দ্বীপে। এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শনও রয়েছে। এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য চমৎকার। তবে এখানকার জনসমাবেশ বেশি টেরন্যাট এবং অ্যাম্বন দ্বীপেই।
স্পাইস আইল্যান্ডসে ঘুরতে গেলে দ্বীপের সাদা বালিময় সমুদ্রসৈকত কোনোভাবেই মিস করা উচিৎ নয়। বিশেষ করে অহোইডারটাউনের সৈকতটা। এছাড়াও এখানে দেখার মতো রয়েছে চুনাপাথরের বাঁধে আবদ্ধ অসংখ্য গুহাময় একটি উপসাগর। জুন-আগস্ট মাস এই দ্বীপুঞ্জে বর্ষাকাল থাকে। এসময় এখানে ভ্রমণে না যাওয়াই ভালো। নভেম্বর-মার্চ পর্যন্ত থাকা শুকনো মৌসুমই এখানে ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত সময়।
সাইক্লেডস, গ্রীস
প্রায় ২০০টির মতো দ্বীপ রয়েছে অ্যাজিয়ান সমুদ্রে জেগে ওঠা এই দ্বীপপুঞ্জে। যদিও বেশিরভাগ দ্বীপেই কোনো জনবাস নেই। স্থলভূমির হিসাব করলে এর আয়তন ২,৫৭২ বর্গ কিলোমিটার। আকৃতিতে দ্বীপপুঞ্জটি অনেকটা গোলাকার। ক্ষুদ্রদ্বীপ ডেলোসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বৃত্তাকার আকৃতির জন্য এর নামকরণ করা হয়েছে সাইক্লেডস।

নির্মল এই গ্রীক দ্বীপগুলোতে রয়েছে সাদা চুনকাম করা প্রচুর বাড়ি, নীল-গম্বুজ বিশিষ্ট গির্জা, জলপাই বাগান এবং প্রাচীন ধ্বংসস্তুপের সমাহার। ভূমধ্যসাগরীয়দের জন্য মিকোনোস হচ্ছে পার্টি সেন্টার। আর সান্টোরিনি বিখ্যাত হানিমুনে যাওয়া দম্পতিদের জন্য।
নাক্সোসে রয়েছে ভেনিসীয় দুর্গ এবং কনস্ট্যাণ্টিনোপলের চ্যাপেলসমূহ। আর কিছুটা দলছুট হয়ে থাকা টিনোস দ্বীপটা হচ্ছে সনাতন তীর্থযাত্রীদের খুব পছন্দের একটি গন্তব্য।

এখানে গেলে সান্তোরিনির অইয়া শহরটি কোনোভাবেই বাদ দেওয়া উচিৎ নয়। শহরটির পুরোটা জুড়েই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জেলেদের নীল-সাদা রঙের ঘরবাড়ি। এছাড়াও এই শহরের মূল রাস্তার পুরোটাই মার্বেলে তৈরি। তাছাড়া রাস্তার ধারে লোভ জাগানিয়া স্যুভিনিয়রের দোকান তো আছে।
সান্তোরিনির রাজধানী ফিরা অবশ্য অনেকটাই নীরব এলাকা। তবে ফিরায় গেলে দেখতে পাওয়া যাবে আগ্নেয়গিরির লাভায় নিমজ্জিত প্রাচীন আগ্নেয়-গর্তের মোহনীয় দৃশ্য।
যাতায়াতের জন্য সারাবছরই এই জায়গাটি উপযোগী। তবে এই দ্বীপপুঞ্জে তাপমাত্রা কিছুটা বেশি। মে-জুন পর্যন্ত তাপমাত্রা অনেকটা কম থাকে, সেজন্য এইসময়টাই এখানে ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে ভালো। তাছাড়া বসন্তের সময় পুরো দ্বীপই ভরে থাকে বুনোফুলের সমাহারে এবং জনসমাবেশের ভিড়ও থাকে অনেক কম।
ব্যালেরিক আইল্যান্ডস, স্পেন
ভূমধ্যসাগরের বুকে জেগে ওঠা ৪,৯৯২ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই দ্বীপপুঞ্জটিতে রয়েছে চারটি প্রধান দ্বীপ (মায়োর্কা, মেনোর্কা, ইবিযা এবং ফর্মেনটেরো) এবং অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ।
দ্বীপগুলো এককালে বিভিন্ন জাতির কাছে বহুল আকাঙ্খিত ছিল। গ্রীক, রোমান, মুররাসহ একদা অনেক জাতিই এগুলো নিজেদের অধিকৃত করতে চেয়েছিল।

বর্তমানে এটা রয়েছে পর্যটকদের দখলে। ইবিযা দ্বীপটি বিখ্যাত এখানের গ্রীষ্মকালীন জেট বিমানের রাজধানীতে পরিণত হয়ে যাওয়ার জন্য। তাছাড়া দ্বীপটাও প্রচণ্ড রকম মনোমুগ্ধকর। মায়োর্কাতে রয়েছে চমৎকার কিছু সমুদ্রসৈকত। এছাড়া এখানকার খাঁজকাটা পাহাড়গুলো মায়োর্কাকে পরিণত করেছে হাইকিং’র নিখুঁত এক স্বর্গে।
এছাড়াও রয়েছে মুগ্ধকর এক ক্যাথেড্রাল এবং আরবদের নির্মিত পুরনো একটি শহর। এই মায়োর্কাতেই রয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্ভুক্ত সিয়েরা ডি ট্রামুন্টানা মাউন্টেইন রেঞ্জ। মেনোর্কাতে অবশ্য খুব একটা পর্যটকের পা পড়ে না। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে মুগ্ধকর ভূ-দৃশ্যটি বোধহয় এই মেনোর্কাতেই দেখা যায়।

দ্বীপপুঞ্জটি সারাবছরই পর্যটক পরিপূর্ণ থাকে। আবহাওয়াও ভালো থাকে মোটামুটি সারা বছর জুড়েই। তবে আবহাওয়া সবচেয়ে ভালো থাকে মার্চ-মে’র ভিতরে।
লোফোটেন আইল্যান্ডস, নরওয়ে
সুমেরুবৃত্তের অন্তর্ভুক্ত নরওয়ের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে ১,২২৭ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই দ্বীপপুঞ্জটি গড়ে উঠে ছয়টি প্রধান দ্বীপ এবং অসংখ্য শৈল দ্বীপ নিয়ে। গভীর সমুদ্রের খাঁড়ি, তুষারাবৃত পর্বতমালা, বুনো তটরেখাসহ এখানকার প্রতিটি দৃশ্যই দেখার মতো।

সত্য বলতে, উত্তর মেরুর মৃদু আলোকরশ্মির কারণে এখানকার প্রতিটি দৃশ্যই সৌন্দর্যময় হয়ে উঠেছে। পুরো দ্বীপপুঞ্জই যেন পাখিদের অভয়ারণ্য। প্রচুর পাখির আনাগোনা রয়েছে এই দ্বীপপুঞ্জে। ভাইকিংদের ইতিহাসে আগ্রহ থাকলে এই দ্বীপপুঞ্জই সবচেয়ে সেরা জায়গা। এখানকার লোফোট ভাইকিং মিউজিয়ামে ভাইকিংদের হেন তথ্য নেই যা জানা যাবে না। এছাড়া বড়শি দিয়ে মাছ ধরা প্রচুর গ্রামও রয়েছে এই দ্বীপপুঞ্জগুলোতে।
এখানে গেলে কোনো কিছু দেখাই বাদ দেওয়া উচিৎ নয়। কোনো সন্দেহ ছাড়াই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর একটি এটি। নরওয়েজিয়ানদের মতে, এখানকার মস্কিতোনেসয় দ্বীপটি দৃশ্যগতভাবে সবচেয়ে সৌন্দর্যময়। ডিসেম্বর-জানুয়ারী ছাড়া সারাবছরই এখানে ভ্রমণে যাওয়ার জন্য ভালো সময়। তবে সবচেয়ে ভালো হয় মে-অক্টোবরে গেলে।
ফিচার ইমেজ- cloudinary.com
মাদিহা মৌ, thanks so much for the post.Much thanks again. Really Cool.