”প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট” প্রশিক্ষণে অংশ নিতে আমি যাব ইন্দোনেশিয়ার পর্যটন গন্তব্য বালিতে। যে তারিখে আমার ঢাকা ছাড়ার কথা তারপরের দিনই ১১ জুলাই ২০১০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনাল। দেশে বসেই আমরা জেনে গেছি বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলবে নেদারল্যান্ড ও স্পেন। অন্যান্য সময়ে ফুটবল না দেখলেও আমি প্রতিবারই বিশ্বকাপ দেখি ১৯৯৪ সাল থেকে। নিজের প্রিয় দল ব্রাজিল বাদ পড়েছে কোয়ার্টার ফাইনালে, তাই বলে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখবো না তা তো হতে পারে না। হিসেব করে দেখলাম, আমি ১১ তারিখে দুপুর নাগাদ বালি পৌঁছে যাবো, রাতে খেলা শুরু হবে ১২টা থেকে, পরের দিন সকাল ৮টা থেকে প্রশিক্ষণ। তারমানে পুরো রাত জেগেই খেলা দেখে সকালে প্রশিক্ষণে যেতে হবে।
২০১০ সালে বিশ্বকাপের ফলাফল অনুমান করে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল অক্টোপাস পল। একুরিয়ামে রাখা পানিতে দু’দেশের পতাকা নামিয়ে দেয়া হতো, যে দেশের পতাকার উপর অক্টোপাস পল গিয়ে বসতো সে দেশই জিততে থাকে। নির্ভুল ফলাফল অনুমান করা পলের বিশ্বকাপ ফাইনালের অনুমান ছিল স্পেন জিতবে। আমার সমর্থনও স্পেনের জন্যই ছিল, পলের কারণে না, বরং ছন্দময় আক্রমাণত্মক ফুটবল দেখে। অবশ্য নিন্দুকরা বলতো নেদারল্যান্ড ব্রাজিলকে হারানোর কারণেই স্পেনের পক্ষ নেয়া।
যাই হোক, ১০ তারিখ রাতে আমাদের বিমান সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স ঢাকা ছাড়ে নির্ধারিত সময়ের ত্রিশ মিনিট পরে। বিমান ছাড়ার পর পাইলট বলে দিলো ৩০ মিনিট বিলম্ব নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই, সেটা পুষিয়ে দেয়া হবে। হলোও তাই, আমরা সিঙ্গাপুরের চাংগি এয়ারপোর্টে অবতরণ করলাম নির্ধারিত সময়েই। পরের ফ্লাইট ৩ ঘণ্টা পরে, তাই সাজানো গোছানো এয়ারপোর্টে ঘুরে ফিরে সময় কাটিয়ে নির্ধারিত সময়ে কানেকটিং ফ্লাইট ধরলাম। বিমানে উঠে দেখলাম পুরো বিমান ট্যুরিস্টে ভর্তি, একমাত্র এশিয়ান আমি। জুন-জুলাইতে ছুটি কাটাতে সারা বিশ্ব থেকে পর্যটরা ভিড় করে বালিতে। স্বাভাবিকভাবেই বিশাল এ এয়ারবাসে কোনো সিট খালি নেই। নির্ধারিত সময়ে বালিতে অবতরণ করলাম আমরা।
আমার হোটেল ছিল সানুর বীচে। হোটেলে চেক ইন করার পর খেলার বিষয়টা নিয়ে আলাপ করলাম। হোটেলের ম্যানেজার বলল তুমি যদি আসলে খেলা উপভোগ করতে চাও কুটা চলে যাও, আমাদের এখানে তেমন জমবে না খেলা। সন্ধ্যার পর আমি বের হলাম কুটার উদ্দেশ্যে, সানুর থেকে কুটা মোটামুটি ১ ঘণ্টার দূরত্ব। রাতের সানুর মোটামুটি ভুতের বাড়ি বলা চলে, রাত ৮টার পরেই লোকজন দেখা যাচ্ছে না। কুটায় নেমে দেখলাম পুরোপুরি বিপরীত। রাস্তাজুড়ে বিভিন্ন ক্লাব আর রেস্তোরাঁ, সবখানেই আছে বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখার চমৎকার সব আয়োজন।
পর্যটকে গিজ গিজ করছে কুটার প্রধান সড়ক, যাদের প্রায় সবার গায়ে কমলা বা লাল জার্সি। প্রতিটি রেস্তোরাঁ, ক্লাব আর বারে অফারের ছড়াছড়ি। খুজে পেতে একটা রেস্তোরাঁর অফার বেশ মনে ধরলো। বাংলাদেশি টাকায় ১,০০০ টাকার মতো টিকেট, সংগে রাতের খাবার, মধ্য রাতের নাস্তা আর সফট ড্রিংকস ফ্রি আছে।
টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম ভিতরে। কমলা আর লালে ভর্তি রেস্তোরাঁ। বিশাল বিশাল সব টিভি স্ক্রীনে চলছে বিশ্বকাপে ম্যাচপূর্ব আনুষ্ঠানিকতার সরাসরি সম্প্রচার। সুবিধাজনক একটা টেবিল খুঁজে নিলাম যেখানে আরও স্প্যানিশ সাপোর্টার আছে। টেবিলে বসার পর তারা জিজ্ঞাসা করলো আমি কোন দলকে সাপোর্ট করছি। স্পেন বলতেই বেশ কয়েকজনের খুশিতে দাঁত বেরিয়ে পড়লো। খেয়াল করে দেখলাম মূলত স্থানীয় লোকজনই বেশি স্পেনের সমর্থক। আর বিদেশিরা বেশি ডাচ সমর্থক। কয়েকজনের সাথে কথা বলে যেটা বুঝলাম ইন্দোনেশিয়া আগে ডাচ উপনিবেশ ছিল, ডাচদের তারা পছন্দ করে না, তাই এদেশের লোকেরা আজ স্পেনকেই সমর্থন দেবে।
তবে ডাচ সমর্থকরা দেখার মতো পোশাক পরে এসেছে। কমলা রঙের পোশাকের সাথে তাদের রয়েছে রংবেরঙের টুপি। আর বাঁশিগুলোও দেখার মতো। ভালোই মাতিয়ে রেখেছে ডাচ সমর্থকরা। অবশ্য স্পেনের সমর্থকরা কম যাচ্ছে না, নিজের দলের পতাকা আর বিভিন্ন রকমের মাফলার নিয়ে তুমুল হৈচৈ করছে তারা। রাতের খাবারটা আগে খেয়ে নিলাম। বুফে খাবার, মূলত বালিনিজ এতিহ্যবাহী খাবারই বেশি। খেয়ে দেয়ে বসলাম খেলা দেখতে।
ঘরের সবচেয়ে বড় টিভি স্ক্রীনটার সামনেই একটা টেবিলে আমি বসেছি। অবশ্য সেখানে না বসলে যে ভালো দেখা যাবে না এমন নয়, ঘরে অন্তত আরও ছয়টি বড় বড় স্ক্রীন রয়েছে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই কোনো না কোনো টিভি স্ক্রীন চোখে পড়ছে। এর মধ্যেই খেলা শুরু হয়ে গেল। খেলার শুরুতেই গোল দেবার মতো অবস্থা করে ফেলেছিল স্পেন। রামোসের দুর্দান্ত হেড চমৎকারভাবে ফিরিয়ে দেয় ডাচ গোলরক্ষক। লাফিয়ে উঠেছিল স্পেনের সমর্থকরা, আর ডাচ সমর্থকদের চোখেমুখে আতংক। তবে দু’দলের হয়ে গলা ফাটাতে পিছিয়ে নেই দু’দলের সমর্থকরা। কমলা ঝলকও দেখলাম আমরা।
প্রথমার্ধের একেবারে শেষ দিকে রোবেন তো কলজেই কাঁপিয়ে দিয়েছিল স্প্যানিশ সমর্থকদের, ক্যাসিয়াস বাঁ দিকে ঝাপিয়ে পড়ে সেবারের মতো রক্ষা করলো। বিশ্বকাপের ফাইনালে চলছিল দু’দলের বাঘে-মহিষের লড়াই। দেশ থেকে এতদূরে প্রথমবারের মত বিশ্বকাপ দেখছি আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব ছাড়া। সাধারণত বিশ্বকাপ ফাইনালের দিনে আমাদের বাসায় থাকে বিশাল আয়োজন, সব বন্ধুরা ভিড় করে খেলা দেখতে। আজ এ বিদেশ-বিভূঁইয়ে ইউরোপিয়ান দু’দেশের মধ্যে ফাইনাল দেখছি।
ডাচ সমর্থকরা এ রেস্তোরাঁয় সংখ্যাগরিষ্ঠ। বিরতিতে খেলা যখন গোলশূন্য ড্র হয়ে আছে, তখন তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। জানাল গ্রীষ্মের ছুটিতে তারা কোনো না কোনো দেশ ঘোরার চেষ্টা করে থাকে। এবার বালিতে আসার আগে বিশ্বকাপের সময় মিলে যাওয়াতে এখানে যত ডাচ নাগরিক আছে সবাই নিজ দলের সমর্থনে হাজির হয়েছে কুটাতে। হাল্কা নাস্তা আর সফট ড্রিংকস শেষ করতে করতে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয়ার্ধেও চললো আক্রমণ আর প্রতি-আক্রমণ, কিন্তু গোলের দেখা পেল না কোনো দলই। অতিরিক্তে সময়ে স্পেন সমর্থকদের মুখে একটিই কথা, ম্যাচ ট্রাইবেকারে গেলে নেদারল্যান্ডই জিততে যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত সময় শেষ হবার মাত্র ৪ মিনিট আগে গোলের দেখা পেল স্পেন। ফেব্রিগাসের বাড়িয়ে দেয়া বল নিয়ন্ত্রণে এনেই ডান পায়ের জোরালো শটে বল জালে জড়িয়ে দেন ইনিয়েস্তা। চেষ্টার ত্রুটি করেনি ডাচ গোলরক্ষক, কিন্ত তার হাতে লেগেও বিচ্যুত হয়নি ইনিয়েস্তার শট। সাথে সাথে উল্লাসে ফেটে পড়ে সব স্পেনের সমর্থকরা। তাদের মধ্যে আমি আছি, কাউকেই চিনি না, কিন্তু আনন্দ ভাগাভাগিতে কোনো সমস্যা নেই।
অল্পকিছু সময় বাকি ছিলো খেলার, সেটাও শেষ হয়ে যাবার পর শুরু হলো উদযাপন। নেচে-গেয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে স্পেনের সমর্থকরা, আর ডাচরা নীরবে ত্যাগ করছে রেস্তোরাঁ। এর মধ্যে কাপ দেবার সময় আরেক দফা হৈ-হুল্লোড় করে আমিও বের হলাম। কুটার রাস্তায় তখন স্পেনের পতাকা নিয়ে মিছিল করছিল স্পেনের সমর্থকরা, তাদের সাথে আছে বালির স্থানীয় লোকজন, এর মধ্যেই আমি ফিরে চললাম সানুরে। সকালে হাই তুলতে তুলতে প্রশিক্ষণে গিয়ে দেখি আমার পাশেই বসেছে স্প্যানিশ মেয়ে বারবারা। তাকে অভিনন্দন জানানোর একটু পরে আমাদের প্রধান প্রশিক্ষক ঢুকলো রুমে। ডাচ বার্টের প্রথম কথাই ছিল বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরে তার মন খুব খারাপ।
ফিচার ইমেজ- লেখক
বালিতে বসে বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১০ ফাইনাল দেখা

Loading...