দালাই লামা এবং তাঁর সঙ্গীরা তিব্বত থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় লাভ করেছিলেন ভারতের হিমাচল প্রদেশের ধর্মশালায়। এরপর থেকেই পর্যটকদের কাছে ধর্মশালা হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়। বিশেষভাবে শহরটির ম্যাকলাউড গঞ্জের ব্রিটিশ হিল স্টেশনটির কথা উল্লেখ করতেই হবে। প্রায় ১,০০০ মিটার উঁচুতে ১০ কিলোমিটার ব্যাপী রেললাইন পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে। এই হিল স্টেশন আর সর্পিল রেললাইন নিজ চোখে দেখতে প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক ছুটে আসেন এখানে।
রিচার্ড গিয়ার, উমা থারমান, ইথান হকের মতো অনেক নামীদামী তারকাই ভারতে আসেন ধর্মশালার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আধ্যাত্মিকতার সান্নিধ্য পেতে। তবে সাধারণ দর্শনার্থীদের অনেককেই এখানকার স্নিগ্ধতায় পূর্ণ জীবনযাত্রা আর নির্মল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মায়ায় জড়িয়ে যেতে দেখা যায়। হাতে কম সময় নিয়ে এসেও তারা এখানে থেকে যান দিনের পর দিন।
কোথায় ঘুরবেন:
হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত ধর্মশালার ম্যাকলাউড গঞ্জে আছে পাইন ফরেস্ট সমৃদ্ধ শৈলশ্রেণী। এখানকার গেস্ট হাউজ আর রুফ টপ রেস্টুরেন্টগুলো থেকে আপনি দেখতে পাবেন নীল আকাশ, পাথুরে পাহাড়, সুবিশাল পর্বত আর গাছপালার সমাহার। তবে ধর্মশালার আসল রূপ আপনার চোখে ধরা দেবে তখনই, যখন আপনি ট্রেকিং আর হাইকিং করতে বেরিয়ে পড়বেন।
পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ট্রেকিং করে আপনি পৌঁছে যেতে পারেন ভাগসু আর ধর্মকোট গ্রাম দুটিতে। ভাগসুতে দেখা মিলবে ছোট এক পাহাড়ি ঝর্ণার, তবে জায়গাটা বিখ্যাত এর সুপ্রাচীন শিব মন্দিরটির জন্য। জুলাইয়ের শেষ থেকে আগস্টের শেষ পর্যন্ত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থযাত্রার সময়টি পর্যটকদের জন্যও এই মন্দির ঘুরে দেখার শ্রেষ্ঠ সময়।
ট্রেক করে এবার আপনি চলে আসতে পারেন ধর্মশালার প্রশান্তির নীড় ডাল লেকে। এই লেকটিকে কাশ্মীরের ডাল লেকের সাথে মিলিয়ে ফেলবেন না আবার! এরা আলাদা দুটি লেক। লেকের পাড়ে অনুমতি সাপেক্ষে করতে পারেন ক্যাম্পিং। অরণ্য আর পাহাড়ে ঘেরা জায়গাটায় অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ পাবেন নিঃসন্দেহে।
ডাল লেকের পর ট্রেকিং করে চলে যেতে পারেন আরও উত্তরে, ধাউলাধর পর্বত শ্রেণীর কাছাকাছি। ৪,৩৫০ মিটার উঁচু ইন্দ্রহার পাস হয়ে এরপর পৌঁছে যাবেন হিন্দুদের মন্দিরের শহর হিসেবে খ্যাত চাম্বা আর ভারমউরে। এখানে আসার জন্য আপনি সাহায্য নিতে পারেন ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর। ট্রেকিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং গাইড ঠিক করে দেবে তারাই।
প্রকৃতির সান্নিধ্যে তৃপ্ত হয়ে এবার আপনি বেরিয়ে পড়তে পারেন আধ্যাত্মিকতার খোঁজে। এজন্য ট্রেকিং শেষে আপনাকে ফিরে আসতে হবে ম্যাকলাউড গঞ্জে। মেডিটেশন এবং ইয়োগার জন্য হিন্দু এবং বৌদ্ধ রীতির যে কোনোটি বেছে নিতে পারেন এখানে। দীর্ঘ সময়ের জন্য মেডিটেশন এবং ইয়োগা শিখে নেয়ার সুযোগ আছে এখানকার ভিক্ষুদের কাছ থেকে। আপনার হাতে যদি সময় কম থাকে, তবে তিব্বত ওয়ার্ল্ডে গিয়ে করে ফেলতে পারবেন কয়েক ঘণ্টার শর্ট কোর্স।
এখানকার ধর্মীয় স্থাপনাগুলো ঘুরে না দেখলে আপনার ধর্মশালা ভ্রমণটাই বৃথা যেতে পারে! এই কাজটি তাই আপনাকে করতে হবে অবশ্যই। শুরু করতে পারেন ম্যাকলাউড গঞ্জের মূল চত্বরের ঠিক পেছনের লাল-হলুদ বৌদ্ধ মন্দিরটি দিয়ে। ভেতরে গিয়ে এখানকার প্রার্থনা চক্রগুলো ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরিয়ে দেয়া একটা ধর্মীয় রীতি হিসেবে পালিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মন্দিরের দুই পাশে রমরমা দুটি বাজারও আছে।
এরপর চলে যেতে পারেন সুগ লাখাং মন্দির এবং নামগায়াল আশ্রমে। দুটোই দালাই লামার বাসভবন থেকে খুব কাছে। তবে তাঁর বাসভবনে জনসাধারণ বা পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি নেই। অনেক সময় শহরে এসে স্থানীয়দের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে থাকেন তিনি। এমন কোনো কর্মসূচি আছে কিনা, খোঁজ নিয়ে রাখবেন। দালাই লামার কথা শুনতে পাওয়াও সৌভাগ্যের ব্যাপার!
হালকা কেনাকাটা:
প্রকৃতির স্বাদ আর আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া তো পেলেন। এবার এখানকার স্থায়ী নিবাসী আর অন্যান্য পর্যটকদের সাথে খানিকটা খাতির জমানোর চেষ্টা করতে পারেন। এতে ধর্মশালার জীবনযাত্রা সম্পর্কে বেশ ভালো একটা ধারণা পেয়ে যাবেন। অন্যান্য পর্যটকদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে পারেন আপনার অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সংগ্রহ করতে পারেন স্যুভনির।
বুদ্ধের ছবি সংবলিত “থাংকা” কিনে নিতে পারেন। কীভাবে থাংকা তৈরি করা হয় সেটাও দেখে নিতে পারেন। এছাড়া এখানকার বাজারগুলো থেকে কিনতে পারেন কারুকার্যময় গয়না সামগ্রী। বিভিন্ন ধরনের তেল এবং সুগন্ধিও এখানে পাবেন সুলভ মূল্যে।
কী খাবেন:
ধর্মশালায় পাবেন বৈচিত্র্যময় সব খাবারের সন্ধান। আসল তিব্বতের মোমোর স্বাদ পেতে পারেন এখানে। চেখে দেখতে পারেন স্যুপের মতো সুস্বাদু থুকপা। চিকেন, বিফ, মাটন বা হ্যাম দেয়া মোমো আর থুকপা পেয়ে যাবেন আপনি। এছাড়া উত্তর ভারতীয়, দক্ষিণ ভারতীয়, ভুটানিজ এমনকি ইসরাইলি কুইজিনও পাওয়া যায় এখানকার রেস্টুরেন্টগুলোয়। তবে ১১টার ভেতরেই প্রায় সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যায়। ডিনার তাই সেরে ফেলতে হবে এই সময়ের মধ্যেই।
কখন যাবেন:
ধর্মশালা ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বর্ষণপ্রবণ অঞ্চল। তাই শরতই হচ্ছে ধর্মশালা ঘুরে দেখার আদর্শ সময়। তখন তাপমাত্রা থাকে কিছুটা কম। সেই সাথে হালকা রোদেরও দেখা পাওয়া যায়। বসন্তের শেষ দিকে এখানে প্রচণ্ড গরম পড়তে শুরু করে। গ্রীষ্মের শুরুতেই শুরু হয়ে যায় ভারী বর্ষণ। আর শীতের সময় বেশ তীব্র ঠাণ্ডা পড়ে এখানে। তবে ধর্মশালায় পুরো বছর জুড়েই পর্যটকেরা আসতে থাকেন। তাই আপনার পছন্দমতো সময় বেছে নিয়ে চলে আসতে পারেন এখানে।
ফিচার ইমেজ- অডলে ট্রাভেল
তথ্যসূত্র:
১. Theroughguides.com
২. The Holiday India
৩. Wikimedia