প্রকৃতির নানা রকম উপহারের মাঝে অরণ্যই বোধহয় সবচেয়ে বেশী তার রূপ বদলাতে পারে ঋতুভেদে। পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্য, নদী-নালা, মাঠ, এ সবকিছুই ঋতুভেদে তাদের রূপের পরিবর্তন করে থাকে বা প্রাকৃতিক উপায়ে ওদের রূপের বদল ঘটে থাকে। তবে এসবের কোনোটাই বুঝি অরণ্যের মতো অতটা বদলে যায় না। আমি বর্ষার সময় ভেজা প্রেমিকার মতো অরণ্য দেখেছি, সদ্য স্নান করে ফেরা প্রেয়সী যেন।
আমি দেখেছি রুক্ষ সময়ের কর্কশ অরণ্যকে। বস্ত্রহীন, লাজলজ্জাহীন অরণ্যের আগুনে পুড়েছি বেশ কয়েকবার। উষ্ণ অরণ্যকে যতটা ভালো লেগেছে, কষ্ট লেগেছে তারচেয়ে অনেক বেশী। যতটা কাছে গিয়েছি ততটাই যেন পুড়েছি, আর মন খারাপ করে ফিরেছি।
শীতের অরণ্য? সে এক অন্য অনুভূতি নিয়ে ধরা দিয়েছে যেন প্রতিবার, প্রতি মুহূর্তে, প্রতি সময়ে। শীতের অরণ্য যেন আগে থেকে না দেখা, লাজে কুয়াশার ঘোমটা টেনে নিজের টুকটুকে রূপ লুকিয়ে রাখা নতুন বৌয়ের মতো! কুয়াশা সরে গেলেও যেখানে অজানা ভয়ের ধুসর মেঘ জমে থাকে কিছুটা, মেঘ সরে গেলেও বাপের বাড়ি থেকে চলে আসার শেষ অশ্রুর মতো শিশির জড়িয়ে থাকে যেন তার সমস্ত সত্ত্বায়। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা অরণ্যের মুখমণ্ডলে যখন ভোরের প্রথম সূর্যের আলোর ঝিলিক পড়ে তখন যে ভয়, সংজ্ঞা আর লজ্জা সরিয়ে সুন্দরী অরণ্য যেন লাজুক হেসে ওঠে, উষ্ণতার আলতো ছোঁয়ায়। উহ, এই সময়ের অরণ্যের কী যে অপূর্ব রূপ…

কোনো এক শেষ বিকেলে, যখন সূর্য হেলে পড়বে আকাশের পায়ে। ঘন কোনো অরণ্যের মাঝে কাঠের কটেজের বেলকোনিতে ঝুলে থাকা দোলনায় বসে থাকবো চুপচাপ। বেশ ঘন শীতে দোলনায় বসে এক চাদরের ভেতরে উষ্ণতা খুঁজবো! কোনো কথা বলবো না কারো সাথেই। কারণ এটা কথা বলার সময় না। এটা প্রকৃতি দেখার, বোঝার, উপভোগ করার আর অনুভব করার সময়। গভীর অরণ্য, ঝরা পাতা, সুখের শিশির, নীরব প্রকৃতি।
শীতের সময়ে যে কোনো অরণ্য যেন আরও নীরব আর নিস্তব্ধতায় চুপ করে যায়। পাখিরাও কম ডাকে, পোকা-মাকড় পর্যন্ত যেখানে সেখানে ছুটে গিয়ে শব্দ করে না। বনের পশুপাখিরাও শান্ত ভাবে একে-অন্যের গা ঘেঁষে উষ্ণতা খোঁজে। তাই এই সময়ের প্রকৃতি অসম্ভব চুপচাপ, নীরব আর নিস্তব্ধ। এই সময়ে যেভাবে প্রকৃতিকে উপভোগ করা যায় আর কখনো তেমনটা যায় না।

কান না পেতেও চমকে ওঠা যায়, শুকনো পাতায় ঝরে পড়া শিশিরের শব্দ শুনে। বৃষ্টির মতো করে টুপটাপ শিশির ঝরে গাছের পাতায় পাতায়। একবার কানের কাছের গাছের পাতায়, তো একবার একটু দূরের কোনো পাতায় পাতায়, কখনো কোনো শুকনো পাতায় ঝরে পড়া শিশিরের একটা অদ্ভুত ছন্দ সুর তোলে যেন! ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ একটা অদ্ভুত আনন্দের শিহরণ জাগে মনে-প্রাণে। শীতের প্রকোপ যখন বাড়তে থাকবে খোলা বারান্দায়, বাতাসের বেগ যখন বাড়বে, চাদরের ভেতরের উষ্ণতা ভেঙে উঠে পড়বো দুজনেই।
ঘরের ভেতরে নরম কোমল আর ঠাণ্ডা হয়ে থাকা লেপের মধ্যে ঢুকে যাবো। লেপের মধ্যে থেকেই শুনতে পাবো ধীরে ঝরে পড়া, শিশিরের ক্ষীণ ছন্দ। বিছানা উষ্ণ হতেই ঘুমিয়ে পড়ব। মধ্য রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে, দেখবো একে অন্যের আলিঙ্গনে বাঁধা পড়েছে অরণ্য আর কুয়াশা দারুণ হৃদ্যতায়, উষ্ণতায়! বাইরে গাছের পাতায় শিশিরের সুর, দূরে কোনো রাতজাগা পাখির ডাক, দুই একটা অবাধ্য পাখির ডানা ঝাপটে উড়ে যাবার শব্দ! অদ্ভুত রাতের উষ্ণ রোমাঞ্চ নিয়ে ধরা দেবে আমাদের কাছে।

খুব তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাবার কারণে, ঘুম ভেঙে যাবে খুব ভোরে। তখনও সূর্য ওঠেনি। হিম শীতল শীতে, উষ্ণ লেপের আদরের আলিঙ্গন ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করবে না কিছুতেই। তাই ঘুম না থাকলেও চোখ বুজে শুয়ে থাকবো নরম বিছানায়। একটু পরে এক চিলতে রোদ ঢুকে পড়বে চোখের উপরে, কাঠের কটেজের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে! অন্ধকার ঘরের ভেতরে, কাঠের অসংখ্য ফাঁকা দিয়ে ঢুকে পড়া রোদ তৈরি করবে এক অপার্থিব মোহময় পরিবেশ। একটা আলো-আধারির খেলা। চোখ খুলে এই অপার্থিবতা দেখে আর বিছানায় থাকতে ইচ্ছে করবে না কিছুতেই।
কাঠের ভেজানো দরজা খুলেই একরাশ মুগ্ধতা ঘিরে ধরবে যেন, দেখে সবুজ গালিচায় রোদ আর শিশিরের খেলা। সবুজ কচি ঘাস আর গাছের পাতায় পাতায় ঝরে পড়া শিশির কণার উপরে রোদের ঝিকিমিকি হাসি দেখে। খুব ঠাণ্ডা হওয়া সত্ত্বেও খালি পায়ে পা রাখবো মিহি, সবুজ আর শিশির ভেজা সবুজ ঘাসে। একটা শীতল অনুভূতি শিহরণ তুলবে সারা শরীরে। একটা অব্যক্ত সুখ স্পর্শ করবে মুহূর্তেই! যেটা বলে, দেখে বা লিখে বোঝাবার সাধ্য নেই।

এই শিশির, সবুজ ঘাস, ঝরা পাতা, মিষ্টি রোদ, শিশিরের ঝরে পড়ার শব্দ, এই সব কিছু শুধু অনুভবের, চুপচাপ উপভোগের, ঠায় বসে আর চেয়ে থেকে উপলব্ধির!
চলে যাবো এভাবে একদিন কোনো এক গভীর অরণ্যে। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়, কোথায় যাওয়া যায়? আমাদের অরণ্যে কী এমন অদ্ভুত নির্জনতা আর শিশিরের স্বাদ নেয়া যাবে? আমাদের কোনো অরণ্যের মাঝে কি এমন করে থাকার নিরাপদ আয়োজন আছে? যেখানে সহজেই অল্প খরচেই নিজের মতো করে ঘুরে আসা যাবে? অনেক খুঁজে খুঁজে, খরচ, সময় আর নিরাপত্তার ব্যাপারটা একই সাথে না মিলাতে পেরে শেষে মনে পড়লো ডুয়ার্সের কথা।
আর দেরি না করে, ঝটপট ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম এমন নির্জনে, শিশির ভেজা ঘাসের, অরণ্যের মাঝে দুই একদিন ঝরা পাতায় শিশিরের ঝরে পড়ার শব্দ শুনতে শীতের মায়াবী অরণ্য ডুয়ার্সে।

আর ঠিক যেমনটি মনে মনে ভেবেছিলাম, চেয়েছিলাম, তেমন করেই পেয়েছিলাম শীতের অরণ্যকে, শিশিরে ভেজা ঘাস আর গাছের পাতাকে, ভোরের নরম আলোর উষ্ণতাকে আর নির্জন অরণ্যের ডুয়ার্সকে। ঢাকা থেকে খুব সহজেই শিলিগুড়ি বা জলপাইগুড়ি দিয়ে গিয়ে ডুয়ার্সের এমন অরণ্য উপভোগ করা যেতে পারে। ঢাকা থেকে বাংলাবান্ধা বা চ্যাংরাবান্ধা হয়ে জলপাইগুড়ি বা শিলিগুড়ি দিয়ে বাস বা জীপে করে যেতে পারেন ডুয়ার্সের নির্জন আর শীতের অপরূপ অরণ্যে।
How to go there and when?
কতো সুন্দর লেখা। অসাধারন সজল জাহিদ।