পারিবারিক ভ্রমণের জন্য লন্ডন একটি আদর্শ স্থান। গত পর্বে এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলোর শেষ টানতে পারিনি, তাই দ্বিতীয় পর্ব লিখতে হলো। অবশ্য এই পর্বেও লন্ডনকে শেষ করা সম্ভব নয়। কারণটা আগেই উল্লেখ করেছি, আমি নয় ইংরেজ লেখক স্যামুয়েল জনসন বলেন,- ‘When a man is tired of London, he is tired of life; for there is in London all that life can afford.’ অর্থাৎ একজন মানুষ যখন লন্ডনে ক্লান্ত হয়, তখন তিনি জীবন থেকে ক্লান্ত। কারণ জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই লন্ডনে রয়েছে।’
বাকিংহাম প্যালেস
ব্রিটেনের রাজতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় আভিজাত্যের প্রতীকরূপে দাঁড়িয়ে আছে বাকিংহাম প্যালেস। লন্ডন ভ্রমণ করবেন আর বাকিংহাম প্যালেসে যাবেন না, তা কী হয়! বাকিংহাম প্যালেস মূলত লন্ডনের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাসাদ। এটাই লন্ডনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের কার্যালয় ও বাড়ি। এছাড়াও এখানে রয়েছে ‘বাকিংহাম প্যালেস বাগান’। এটি লন্ডনের সব থেকে বড় ব্যক্তিগত বাগান।
বাকিংহাম প্যালেসে ঘুরে দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে রাজ পরিবারের শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলাকালীন। কারণ, একমাত্র তখনই এটা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। তবে রানীদের ব্যক্তিগত কোয়ার্টারে সবসময়ই প্রবেশ নিষেধ থাকে।
এখানে আপনি ১৯টি স্টেট কক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন যেখানে রানী এবং রাজ পরিবারের সদস্যরা দেশের অতিথিদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং রাষ্ট্রীয় উৎসব সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে অংশ গ্রহণ করেন। এখানে রয়েছে রাজকীয় সংগ্রহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বস্তু, যা আপনার নজর কাড়বেই।

ওয়েস্ট মিনিস্টার এবে
পর্যায়ক্রমে ১৬টি রাজকীয় বিয়ের সাক্ষী হয়ে লন্ডনের বুকে এখনো টিকে আছে প্রাচীন এক মন্দির, যার নাম ওয়েস্ট মিনিস্টার এবে। এটি সিটি অব ওয়েস্ট মিনিস্টারে অবস্থিত, তাই বেশ ব্যস্ত জায়গা এটি। এখানে প্রায় সবসময়ই মানুষের ভিড় থাকে।
প্রাচীন এই মন্দিরটি গোথিক স্থাপত্য কলায় নির্মিত হয়েছিল, যা এখন যুক্তরাজ্যের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভবন। এখানে প্রধান গির্জা ছাড়াও রয়েছে ভজনালয়, মঠ, যাজক ঘর ও দুর্গ। এটি আনুমানিক ১৫৪০ থেকে ১৫৫০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রধান গির্জার মর্যাদা পায়।
যদি আপনি বইপ্রেমী হয়ে থাকেন, তবে নিশ্চয় বিখ্যাত লেখক উইলিয়াম শেকসপিয়র, জিওফ্রি চসার, চার্লস ডিকেন্স এবং রুডয়ার্ড ক্লিপিং এর নাম শুনে থাকবেন। ঘুরে আসতে পারেন ‘কবি কর্নার’ থেকে, এখানে এই লেখকদের সমাধি রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে আইজ্যাক নিউটন সহ প্রকৃতি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনেরও সমাধি। ব্রিটিশ রাজ পরিবারের কিছু সদস্যদেরও সমাধিস্থ করা হয় এখানে।

বিজ্ঞান জাদুঘর
লন্ডনের একটি গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরের নাম ‘বিজ্ঞান জাদুঘর’। এটি নির্মিত হয় ১৮৫৭ সালে। বর্তমানে এখানে প্রতি বছর প্রায় ৩ মিলিয়ন পর্যটক আসেন। সাত তলা বিশিষ্ট বিশাল এই জাদুঘরে রয়েছে বিজ্ঞানের অনেক কিছুই, যা আপনার লন্ডন ভ্রমণকে সার্থক করে তুলতে পারে। এখানে বিভিন্ন শিক্ষামূলক ও আনন্দদায়ক উপকরণ সহ মোট ১৫ হাজারেরও অধিক জিনিসপত্র রয়েছে।
প্রথমেই রয়েছে বিজ্ঞানের আদিম যুগ থেকে শুরু করে এর খুঁটিনাটি নানান দিক। তারপর রয়েছে মেডিকেল হিস্ট্রি গ্যালারী, যা আপনাকে প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থা সহ এর উন্নতির ধারা ও শাখা-প্রশাখার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।
স্পেস গ্যালারিতে আছে বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণার বস্তু। এর মধ্যে আছে ব্রিটিশ স্পেস মিশনে অংশ নেওয়া ২টি এক্স-রে টেলিস্কোপ, Apollo 10। আরো আছে ক্লক মেকার কালেকশন, এটি পুরনো ঘড়ির বিশাল একটি সংগ্রহশালা। এছাড়াও এই বিজ্ঞান জাদুঘরে রয়েছে বিস্ময়কর কিছু জিনিস।

ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্ট মিউজিয়াম
শিল্পকলার জন্য বিশ্বের সব থেকে বড় মিউজিয়াম হলো ভিক্টোরিয়া এন্ড আলবার্ট মিউজিয়াম। এটি নির্মাণ করা হয়, ১৮৫২ সালে। প্রাসাদের মতো দেখতে এই জাদুঘরটির নামকরণ করা হয় তখনকার রাজ জুটি ভিক্টোরিয়া এবং আলবার্টের নামে।
সংক্ষেপে জাদুঘরটি V & A নামে পরিচিত। জাদুঘরের অভ্যন্তরে রয়েছে বিভিন্ন শিল্প নিদর্শনের সংগ্রহ। এখানে বিভাগ অনুযায়ী সাজানো রয়েছে স্থাপত্য, টেক্সটাইল, আসবাব, চিত্রকর্ম, অলংকার সহ মোট ২ মিলিয়নেরও অধিক উপকরণ।
স্থায়ী প্রদর্শনীর পাশাপাশি মাঝে মাঝে এখানে কিছু অস্থায়ী প্রদর্শনীও হতে দেখা যায়। স্থায়ী প্রদর্শনীতে পর্যটক গাইড বিনামূল্যে দেওয়া হয়, কিন্তু বিশেষ প্রদর্শনীগুলোর জন্য টিকেট সংগ্রহ করতে হয়।

লন্ডন আই
আমাদের দেশে আমরা যাকে নাগরদোলা বলি, লন্ডন আইকে তার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। কিন্তু এটি ছোট-খাট কোনো নাগর দোলা নয়। বিশাল আকৃতির এই নাগর দোলা থেকে লন্ডনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ দেখা যায়।
লন্ডন আই এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০০০ সালে, আর তখন থেকেই উন্মুক্ত করা হয় সুউচ্চ ও আধুনিক এই নাগর দোলাটি। সেই সময়ে এটি লন্ডন শহরের সবচেয়ে বড় চাকা এবং সর্বোচ্চ ভিউইং পয়েন্ট ছিল।
চাকাটির উপরে উঠতে হলে আপনাকে অবশ্যই টিকেট কাটতে হবে। এখানকার টিকিট কাউন্টারে থাকে অনেক লম্বা লাইন। তাই আপনি চাইলে অনলাইনেও টিকিট কিনতে পারবেন। এছাড়া সকাল সাড়ে নয়টায় অর্থাৎ রাইড শুরু হওয়ার আধ-ঘণ্টা আগে টিকেট কাউন্টার খুলে দেওয়া হয়।

রিজেন্ট পার্ক
লন্ডন শহরের সব থেকে সুন্দর পার্ক হলো দ্য রিজেন্ট পার্ক। ৪১০ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত এই পার্কে রয়েছে নানা ধরনের বিনোদন মাধ্যম। একটি পার্কে যত রকম বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে পারে, তার সবটাই আছে এই রিজেন্ট পার্কে।
প্রকৃতির সাথে নিঃশ্বাস নিতে চাইলে কিছুক্ষণ লেকের পানিতে নৌকা ভ্রমণ করতে পারেন। সৌন্দর্যের মাঝে ডুব দিতে আর ঘুরতে পারবেন রানী ম্যারির বাগানে। এখানে রয়েছে বিশাল একটি গোলাপ বাগান, যা শহরের সব থেকে বড় গোলাপ বাগান। এখানে ৪০০ টি ভিন্ন প্রজাতির ৩০ হাজারেরও বেশি গোলাপ রয়েছে।
রিজেন্ট পার্কে আরো রয়েছে একটি উন্মুক্ত থিয়েটার, অনেকগুলো বাগান, খেলার মাঠ, আইসক্রিম পার্লার ও একটি পাব। হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারবেন রিজেন্ট পার্কের উত্তর পাশে অবস্থিত চিড়িয়াখানা থেকেও।

এগুলো ছাড়াও লন্ডনের মানুষের নাগরিক জীবন ও আচার ব্যবহার আপনাকে দিতে পারে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা। লন্ডন ভ্রমণে আরো যোগ করতে পারেন ইমপ্যারিয়াল ওয়্যার মিউজিয়াম, হর্স গার্ড প্যারেড, চার্চিল ওয়্যার রুম, গ্লোব থিয়েটার, ঘার্কিন ভবন, ট্রাফালগার স্কয়ার, লন্ডন পার্লামেন্ট ভবন, চায়না সিটি ইত্যাদি।
Feature image: Day Out With The Kids