কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলো না
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তেত্রিশ বছরের অপেক্ষায় ছিলেন, তবু নাদের আলী তাকে পদ্ম বিল দেখাতে নিয়ে যায়নি। নাদের আলীরা কথা রাখে না! তাই বলে কি আমরা পদ্ম বিল দেখবো না? অবশ্যই সেই উদ্দেশ্যেই আজ ছুটে চলেছি। সঙ্গী জোটেনি আজ, তাই একাকীই রওনা হয়েছি।
কবিতার পদ্ম বিলের নাম তিন প্রহরের পদ্ম বিল হলেও আমি যে পদ্ম বিলে যাচ্ছি তার নাম ভুতিয়ার বিল। খুলনা জেলার তেরোখাদা উপজেলার ভুতিয়ার বিলে এই পদ্ম বিলের অবস্থান। যাত্রার শুরুতেই আপনাদের পথ বাৎলে দেই।
যদি কম খরচে যেতে চান, তাহলে খুলনা শহর থেকে জেলখানাঘাট পার হয়ে সেনের বাজার থেকে তেরোখাদাগামী বাসে উঠে পড়বেন। বাসের হেল্পারকে বলে রাখবেন, আপনাকে যেন পদ্মবিলা বাজারে নামিয়ে দেয়। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে বাসের সিটে হেলান দিয়ে বসবেন। তাই বলে আবার ঘুমিয়ে যাবেন না যেন, তাহলে কিন্তু পথের চারপাশের নয়ন ভোলানো দৃশ্যাবলী মিস হয়ে যাবে।
আমিও জানালার পাশে একটি সিট খুঁজে নিয়ে যুৎমতো বসলাম। কিছুক্ষণ পরে একজন শীর্ণকায় লোক আমার পাশের সিটে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যে ভাব হয়ে গেল। সে একজন নাবিক- বহুকাল নৌকায় নৌকায় ঘুরে বেড়িয়েছে জীবিকার তাগিদে। এখন ছুটি পেয়ে বাড়ির পানে ছুটেছে। ঘরে তার ছোট্ট কন্যা সন্তান- কতদিন পরে তাকে বুকে টেনে নেবে। সেই আনন্দে মুখ উজ্জ্বল।
অবশেষে বাস আমাকে পদ্মবিলা বাজারে নামিয়ে দিয়ে উধাও হয়ে গেল সামনের দিকে। বাজারে নামতেই অনেকগুলো ভ্যান এগিয়ে এলো। তাদের একজনকে নিয়ে চললাম পদ্ম বিলকে চাক্ষুষ করতে। শেষমেশ যে গ্রামে পৌঁছলাম তার নাম নলিয়ার চর! বিলের ভেতরে চলে গেছে একটি রাস্তা। সেই রাস্তার দুপাশে বাড়িঘর। প্রত্যেকটি বাড়ি জল দিয়ে ঘেরা, যেন এক একটি দ্বীপ।
বিলের অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় ধানের ক্ষেত। দূরে গিয়ে যেখান জল অনেক গভীর সেখানে চরে বেড়াচ্ছে হাঁসের পাল।
ভ্যানে চড়ে অচেনা একজন মানুষকে গ্রামে ঢুকতে দেখে একটি বাচ্চা ভ্যানের পাশাপাশি দৌড়াতে লাগলো। এতক্ষণ ভ্যানওয়ালার সাথে আসার উদ্দেশ্য নিয়ে বেশ গল্প হচ্ছিল। ভ্যানওয়ালা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলো, কিরে তোর বাপ বাড়ি আছে? ইনি বিলে ঘুরতে যাবেন। তোর বাপকে নৌকা নিয়ে আসতে বল।
সে অমনি দৌড়ে গেলো। ওদিকে ভ্যানওয়ালা আমাকে ঠিক বিলের কিনারে নিয়ে হাজির হলো। আমি নামতেই দেখি একটি নৌকা পেছন দিকের বাড়িঘরের ভেতর থেকে আবির্ভূত হচ্ছে। আর নৌকার সামনের দিকে গুটিসুটি মেরে বসে আছে সেই পিচ্চিটা। লোকটির নাম শেখ মোস্তাইন। পিচ্চির মামা হয় সম্পর্কে।
টাকা-পয়সার ব্যাপারটি ঠিক করে দু সন্তানের পিতা বছর পঁচিশের সদা হাস্য মুস্তাইন ভাইয়ের নৌকায় উঠে ভেসে পড়লাম ভুতিয়ার বিলে। নামে ভুতপ্রেতের গন্ধ থাকলেও রূপে গুণে অনন্য ভুতির বিল। বিস্তীর্ণ জলাভূমি। চারদিকে লতা-গুল্ম, কোথাও কচুরিপানা। এরই মাঝে ভেসে রয়েছে অগণিত পদ্ম। স্নিগ্ধতার রং আর আকাশে মেঘের ভেলা এই দুইয়ে মিলে যেন একাকার প্রকৃতি। ঘাসফড়িঙ, হাঁসের পাল আর বুনোঘাসের দল আপনাকে প্রাথমিক সম্ভাষণ জানাবে। তার কিছুক্ষণের ভেতরেই এই বিলের প্রকৃত রাণী পদ্মফুল আপনাকে স্বাগত জানাবে।
পদ্মফুলের বৈজ্ঞানিক নাম Nelumbo nucifera। সারা বছর পানি থাকে এমন জায়গায় এরা ভালো জন্মে। ভুতিয়ার বিস্তৃত বিল তাই পদ্মের জন্য আদর্শ আবাস। পদ্মের পাতা বড় এবং গোলাকৃতি। এদের কোনো কোনো পাতা পানিতে লেপটে থাকে, কোনোটি বা জল থেকে হাত খানেক উঁচু হয়ে থাকে।
বর্ষাকালে ফোটে পদ্মফুল- এর ফুল আকারে বড় এবং বহু পাপড়িযুক্ত। আমাদের দেশে দু ধরনের পদ্মফুল পাওয়া যায়। একটির রঙ লাল বা গোলাপি, অপরটি সাদা। ভুতিয়ার বিলে অবশ্য প্রথমোক্ত প্রকরণটিই পাওয়া যায় শুধু। সাদাটি অপেক্ষাকৃত দুর্লভ। গাজীপুরের দিকে শুনেছি সাদা পদ্ম পাওয়া যায়। পদ্মফুলের হালকা সুগন্ধ আছে। পদ্মের মূল, কন্দ, ফুলের বৃন্ত ও বীজ খাওয়া যায়। পুরাতন গাছের কন্দ এবং বীজের সাহায্যে এদের বংশবিস্তার হয়। পদ্মফুলের রূপে মুগ্ধ হয়ে যুগে যুগে কবি সাহিত্যিকরা তাদের কাব্যে পদ্মফুলের গুণগান করেছেন।
পদ্মের বড় বড় পাতায় ছোটবেলায় যে কত ভাত খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। পদ্মের পাতায় গরম ভাত বেড়ে নিলে হালকা মিষ্টি একটা গন্ধ পাওয়া যায়। পদ্মের ফলকে আঞ্চলিক ভাষায় ফোঁপল বলে। ফোঁপলের ভেতরে সারি সারি বীজ থাকে। এই বীজ একটি সুস্বাদু খাবার। দেখতে তার বাহার কম নয়। ভুতিয়ার বিল থেকে প্রতিদিন মণ মণ পদ্মের ফোঁপল আর পদ্মফুল চলে যায় আশেপাশের শহরগুলোতে। আমি নিজেও এই বিলের খোঁজ পেয়েছি আমার মেডিকেল কলেজের সামনে এক ফোঁপল বিক্রেতার কাছ থেকে।
পদ্ম বিলে এসে বহুদিন পরে শখ হলো নৌকা চালানোর। তাই একটি বাঁশের বৈঠা তুলে নিলাম হাতে। এগুলো ঠিক বৈঠা নয়, এদের চইড় বলা হয়। পদ্মফুলের মূল সিজন সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস। তখন এই বিল গোলাপি আভায় ঝকমক করে। আমরা আসতে দেরী করে ফেলেছি। ঠিক সময় এলে যে কারো চোখ ছানাবড়া হয়ে যেতো, এত পদ্মফুল ফোটে এখানে।
ঘুরতে ঘুরতে পদ্ম বিলে আপনার খিদে লেগে গেলে চিন্তার কারণ নেই। সবুজ পরিপুষ্ট একটি ফোঁপল ছিঁড়ে নিন! তারপর মহানন্দে ভোজ সারুন। বাজি ধরতে পারি, শহরে যে সকল খাবার খেতে আপনি অভ্যস্ত, তাদের অনেকগুলোকে হার মানাবে এটি!
এখানে আসার সময় তাই অনেকে আমাকে রীতিমত হুমকি দিয়ে রেখেছে, তাদের জন্য যেন ফোঁপল নিয়ে যাই। তাই কয়েকটি ফোঁপল ছিঁড়ে নিলাম ব্যাগে। তারপর আরকি। আবার ফেরার পথ ধরলাম। মুস্তাইন ভাই তার সাবলীল হাতে ফিরিয়ে নিয়ে চলল সেই শহরের অভিমুখে। পেছনে পড়ে রইলো ভুতিয়ার বিল।
কীভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে করে খুলনা আসবেন। খুলনার জেলখানাঘাট পার হলেই বাস পাবেন। বাকিটা আগেই বলা দিয়েছি। সুতরাং ঘুরেই আসুন।
Feature Image: Amitav Aronno