আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের রহস্যময় দ্বীপরাষ্ট্র মাদাগাস্কার। দেশটির আয়তন ৫ লাখ ৮৭ হাজার ৪১ বর্গ কিলোমিটার। জনসংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ। ভারত মহাসাগরে অবস্থিত সকল দ্বীপরাষ্ট্রের মাঝে মাদাগাস্কারই সব থেকে শক্তিশালী। তবে সে অন্য কথা। আজ মাদাগাস্কারের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের অজানা সব সত্য সম্পর্কে জানাবো। দেশটির নাম শুনলেই মনে পড়ে জনপ্রিয় অ্যানিমেটেড মুভি ‘মাদাগাস্কারের’ কথা।
চলচ্চিত্রটির প্রধান চরিত্রগুলোতে রয়েছে একটি সিংহ নাম এলেক্স, জেব্রা মার্টি, জিরাফ মেলম্যান এবং গ্লোরিয়া নামের একটি জলহস্তী। যেন নিউ ইয়র্ক কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানার প্রাণীদের আফ্রিকা অভিযানে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাই বলে মাদাগাস্কারের নিজস্ব জীব বৈচিত্র্য নেই এমনটা ভাবলে ভুল করবেন। দেশটি তাদের জীব বৈচিত্র্যে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। আর তাই এ রকম অনেক ডকুমেন্টারি ও সিনেমারই প্রেরণা মাদাগাস্কার, পৃথিবীর সব থেকে আকর্ষণীয় ও অন্যতম রহস্যময় ভ্রমণ গন্তব্য।
ভাবতেই পারেন বহুল আলোচিত এই চমৎকার দ্বীপরাষ্ট্রটি সম্পর্কে আপনি অনেক কিছুই জানেন। আর তাই আজ মাদাগাস্কার সম্পর্কে এমন সব তথ্য জানাবো যা অনেকেরই অজানা এবং অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক।

মাদাগাস্কারের প্রাপ্ত বন্যপ্রাণীর বেশীরভাগই পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না
মাদাগাস্কার দ্বীপটি প্রায় ৭০ কোটি বছরের পুরনো। বর্তমান মাদাগাস্কার ১৬৫ কোটি বছর আগে আফ্রিকা থেকে এবং ১০০ কোটি বছর আগে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই প্রাচীন বিচ্ছিন্নতাই মাদাগাস্কারকে অনন্য উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ উপহার দিয়েছে। এখানে প্রাপ্ত প্রায় ৯০ শতাংশ জীব বৈচিত্র্য পৃথিবীতে অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এর মধ্যে বিলুপ্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝে রয়েছে উড়তে পারে না এমন দৈত্যাকার পাখি ও বামন হিপ্পো।

লেমুরগুলোকে মাদাগাস্কারে পবিত্র মনে করা হয়
লেমুর হলো একজাতীয় ছুঁচালো মুখযুক্ত নিশাচর বানর। এটি শুধু মাদাগাস্কারেই পাওয়া যায়। এখানে লেমুরকে পূজার স্থানে বসানো হয়েছে। অর্থাৎ এই প্রাণীটি মাদাগাস্কারে খুবই পবিত্র এবং সম্মানীয়। এছাড়া দেশটিতে সাংস্কৃতিক নানা বিধি নিষেধ দিয়ে লেমুর সংরক্ষণ করা হয়। মাদাগাস্কারে ব্যুৎপত্তিমূলক এমন শ্রুতিও রয়েছে যেখানে বলা হয় লেমুরের সঙ্গে মানুষের যোগ রয়েছে।
এমনকি মানুষ এবং লেমুরকে একই বংশধারার প্রাণী বলেও মনে করা হয়। ২০১২ সালের এক জরিপে বলা হয় মাদাগাস্কারে মোট ১০৩ প্রজাতি ও উপপ্রজাতির লেমুর রয়েছে। আর এগুলোর প্রত্যেকটিই বিপন্ন এবং বিলুপ্তপ্রায়। এরই মধ্যে দৈত্যাকৃতির লেমুরসহ অনেক লেমুরই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।

এশীয়রা আফ্রিকানদের আগে মাদাগাস্কারে বসতি স্থাপন করেছে
বোর্নেও দ্বীপের অধিবাসীরা সর্বপ্রথম মাদাগাস্কারে বসতি স্থাপন করেছিল। বর্তমানে বোর্নেও দ্বীপ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও ব্রুনেইয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে গিয়েছে। বোর্নেও দ্বীপ থেকে ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে মানুষ সর্বপ্রথম মাদাগাস্কারে যায়। তারও ৫০০ বছর পর আফ্রিকার মানুষ মাদাগাস্কারে আসে।
সময়ের আবর্তে দেশটিতে আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপ থেকে ঔপনিবেশিকদের আগমন ঘটে। তারা সঙ্গে নিয়ে আসে নিজেদের সংস্কৃতি। আর তাই মাদাগাস্কারে এখন এই তিন মহাদেশীয় সংস্কৃতির মেল বন্ধন দেখা যায়।

ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের পূর্বে মাদাগাস্কারে নারী শাসন ছিল
রানী তৃতীয় রনাওয়ালোন ছিলেন মাদাগাস্কারের সর্বশেষ সার্বভৌম শাসক। তিনি ১৮৮৩ থেকে ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। পরে ফরাসী ঔপনিবেশিকরা তাকে পদচ্যুত করে। এই রানীর নামকরণ করা হয়েছিল রানী প্রথম রনাওয়ালোনের নামানুসারে। রানী প্রথম রনাওয়ালোনের শাসনকাল ছিল ১৮২৮ থেকে ১৮৬১ সাল পর্যন্ত। তিনি ইউরোপীয় প্রভাব থেকে মাদাগাস্কারের সার্বভৌমত্ব রক্ষার চেষ্টা করেছেন।

মাদাগাস্কারের স্থানীয় অনেক উদ্ভিদের ঔষধি গুণ রয়েছে
মাদাগাস্কারেরঅনেক স্থানীয় উদ্ভিদের ভেষজ ঔষধি গুণ রয়েছে। যেমন হডগিনস ডিজিস, লিউকেমিয়া ও অন্যান্য অনেক ক্যান্সারের ঔষধ এখানকার ভেষজ উদ্ভিদ থেকে তৈরি হয়। vinblastine এবং vincristine নামক ঔষধ দুটি মাদাগাস্কারের periwinkle গাছ থেকে তৈরি করা হয়। periwinkle হলো চির-শ্যামল লতা বিশিষ্ট একপ্রকার বন্য লতা। মাদাগাস্কারে প্রাপ্ত এই ভেষজ উদ্ভিদ থেকে ক্যান্সারের ঔষধ তৈরি করা হয়।

ইউরোপীয় জলদস্যুদের বিশ্রাম স্থলের কল্পলোক মাদাগাস্কার
তখন ১৭০০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যকার সময়। এই সময়ে মাদাগাস্কারে ইউরোপীয় দস্যুরা বিশ্রাম নিতে নোঙ্গর করত। লোকমুখে এখনো প্রচলিত আছে যে মাদাগাস্কারেই ছিল ভয়ংকর দস্যু রাষ্ট্র লিবারটেলিয়া। আবার অনেকের ধারণা, এমন কোনো রাষ্ট্রের অস্তিত্বই কখনো ছিলো না।
মাদাগাস্কারের দস্যু সম্পর্কিত গল্পগুলোতে দস্যুদের জাতীয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। এই পরিচয় হলো তারা লিবেরি। গল্পে লিবেরি দস্যুদের নিজস্ব সরকার ও আইন সম্পর্কেও জানা যায়। এমনও শোনা যায় তারা বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আইন প্রণেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বন্দীদের মুক্ত করতো।

মাদাগাস্কারে মানবাধিকার রক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী
মাদাগাস্কার সংবিধান ও স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে জনগণের মানবাধিকার রক্ষা করে। স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তির মধ্যে Universal Declaration of Human Rights ও Convention on the Rights of the Child অন্যতম। জাতিগত, ধর্মীয় এবং যৌন সংখ্যালঘুদের দেশটিতে আইনগতভাবে রক্ষা করা হয়। এছাড়া আইন ও মন্ত্রীপরিষদের স্বাধীনতাও কঠোরভাবে সংরক্ষণ করা হয়। দেশটিতে রাষ্ট্রীয় দমন ও অত্যাচার অনেক কম। এছাড়া মাদাগাস্কার বর্তমানে দুর্নীতি নিরোধে কাজ করছে।

মাদাগাস্কারে রন্ধন প্রণালীতে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতিফলন রয়েছে
মাদাগাস্কারে যে সকল খাবার খাওয়া হয়ে সেগুলোতে এশিয়ান, আফ্রিকান, ভারতীয়, চীনা ও ইউরোপীয় অধিবাসীদের প্রভাব রয়েছে। তবে এখানকার খাবারের ভিত্তি ভাত। মালাগাছি ভাষায় ‘খাওয়া’ কে বলা হয় ‘মিনিহাম-বেরি’। এর শাব্দিক অর্থ হলো ‘ভাত খাওয়া।’

আধুনিক মালাগাছি রন্ধন প্রণালীতে রসুন, পেঁয়াজ, আদা, টমেটো, কুরি, নারকেল, ভ্যানিলা, লবঙ্গ এবং হলুদ সুবাসের জন্য সাধারণত ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে দেশটি বিশ্বে ক্লোভ, এবং ইয়ালং-ইয়ালং ও ভ্যানিলার প্রধান সরবরাহকারী । মাদাগাস্কার কফি, লিচু ও বাগদা চিংড়িরও অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী।
ফিচার ইমেজ- peregrineadventures.com