প্রতি চার বছর পর পর বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনায় একত্রিত হয়ে যায় পুরো বিশ্ব। টুর্নামেন্ট চলাকালীন কয়েকটা সপ্তাহ বিশ্ববাসী ভুলে যায় সকল সমস্যার কথা। আলোচনায় তখন শুধু একটা শব্দই থাকে- ফুটবল!
বিশ্বের সেরা সেরা ফুটবলারদের অংশ নেওয়ার কারণে এবারের স্বাগতিক দেশ রাশিয়া পুরোটাই পরিণত হয় ফুটবলপ্রেমীদের মিলনমেলায়। দেশের প্রতিটি শহরের প্রতিটি পানশালা ও আনাচে-কানাচে এখন শুধু ফুটবলের গুঞ্জনই চলছে। তবে ফিফার অফিসিয়াল ফ্যান ফেস্ট জোনের চেয়ে বেশি গুঞ্জন বোধহয় আর কোথাও নেই।
যারা খেলা দেখার জন্য টিকিট পায়নি বা নিতে পারেনি, তাদের জন্য ফিফা আয়োজন করেছে এই অফিসিয়াল ফ্যান ফেস্ট জোনের। পুরো রাশিয়া জুড়ে ১১টি ফ্যান ফেস্ট সাইট রয়েছে। বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের একাংশ যেন একত্রে বসে খেলা উপভোগ করতে পারে এবং অন্যদের সাথে খেলা নিয়ে পর্যালোচনা করতে পারে; এজন্যই ফ্যান ফেস্টগুলোর আয়োজন করা হয়েছে।
বিশাল বিশাল জায়ান্ট স্ক্রিনসহ ফ্যান ফেস্ট সাইটগুলো নিশ্চিতভাবেই টুর্নামেন্ট চলাকালীন সময়ে পরিণত হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্পোর্টস বারে, যেটির এবারের স্থায়িত্ব হলো ১৪ জুন থেকে শুরু করে ১৫ জুলাই পর্যন্ত।
এবারের সবচেয়ে বড় ফ্যান ফেস্ট সাইটটি রয়েছে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের পাশের ভোরোবিয়োভি গোরি পার্কে। এর সর্বোচ্চ ধারণ ক্ষমতা ২৫,০০০ পর্যন্ত। রাশিয়ায় বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার সুবাদে কয়েকদিন আগেই আমি সেখানে গিয়েছিলাম। নিচে সেই অভিজ্ঞতাটাই ব্যক্ত করছি।
২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপ থেকেই ফিফা অফিসিয়াল ফ্যান ফেস্ট জোনের আয়োজন করে আসছে। স্বাগতিক দেশের নাগরিক এবং ভ্রমণরত ফ্যানরা যেন একসাথে বসে বিশ্বকাপের খেলা উপভোগ করতে পারে সেজন্যেই এটা আয়োজন করা হয়। এবারের মস্কোয় থাকা জোনটিতে খেলা দেখতে যেতে হলে, প্রথমে যেতে হবে রাশিয়ার জাতীয় স্টেডিয়াম এবং টুর্নামেন্টের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ বিন্দু লুঝনিকি স্টেডিয়ামে।
লুঝনিকি থেকে ত্রিশ মিনিটের হাঁটা দূরত্বেই রয়েছে সাইটটি। মস্কোর মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া মস্কোভা নদী পেরিয়ে ওখানে যেতে হয়। আমি যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন ছিল সোমবার। বিকালের সময়টায় আবহাওয়া ছিল বেশ উজ্জ্বল এবং উষ্ণ।
ফ্যান ফেস্ট সাইটটি আসলে রয়েছে ভোরোবিয়োভি গোরিতে। এই পার্ক থেকে পুরো মস্কো শহরটাই দেখা যায়। এর আরেক নাম স্প্যারো হিলস। শহরের সবচেয়ে উচুঁ চূড়াগুলোর একটি এই পার্ক। তবে আমার কাছে পার্কটিকে মস্কোর সেন্ট্রাল পার্কের মতোই লেগেছে।
ফ্যান ফেস্টের নিরাপত্তা খুবই কড়া। ভিড় সামলানোর জন্য জায়গাটিতে রয়েছে শতাধিক পুলিশ ও নিরাপত্তাকর্মী। ধারণক্ষমতা যেহেতু ২৫ হাজার, সেহেতু এমন কড়াকড়িই স্বাভাবিক। ২০০৬ সালে ফ্যান ফেস্ট চালু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ ফ্যান ফেস্ট সাইটে এসেছে।
নিরাপত্তার বেষ্টনি পেরুলেই সামনে পড়বে ফিফার অফিসিয়াল ফ্যান শপ। দিনের উত্তপ্ততা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তবে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত শপটাতে ঢুকলে এই গরমের মধ্যে এক ধরনের স্বস্তিই পাওয়া যায়।
সব দেশের অফিসিয়াল জার্সি রয়েছে শপের ডিসপ্লেতে। এগুলোর দাম ৭০ ডলার থেকে শুরু করে ১০০ ডলার পর্যন্ত।
জার্সি ছাড়াও শপে রয়েছে আরো নানান রকমের বিশ্বকাপ থিমের সামগ্রী। যেমন উশুঙ্কা বা পশমের হ্যাট, টি-শার্ট, মোজা, ফুটবল এবং এই বিশ্বকাপের মাস্কট যাবিভাকা অ্যাকশন ফিগার। রাশিয়ান ভাষার এই মাস্কটটি একটি নেকড়ের এবং এর অর্থ ‘যে গোল করে’।
আমার অবশ্য আগ্রহ বেশি ছিল যাবিভাকা থিমের ম্যাট্রিওশকা বা রাশিয়ান নেস্টিং ডলগুলোর ওপর। কিন্তু এগুলোর দাম ১১০ ডলার হওয়ায়, ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও কিনতে পারিনি।
শপ পেরুলেই শুরু হয় আসল মজা। খেলার মতো অনেক কিছুই রয়েছে সাইটের ভিতরে। বাউন্স-হাউস ফুটবল ম্যাচ এগুলোর একটি। আমি যদিও নিশ্চিত না এই ফোলানো ফুটবল প্যাডগুলোর উদ্দেশ্য কী, তবে এটা বেশ মজার ছিল।
আরো আছে ফুটবলের সবুজ মাঠের একটি প্রতিকৃতি, যেখানে স্টেডিয়ামের মাঠের মতোই ফুটবল খেলা যাবে।
এছাড়াও পেনাল্টি শ্যুট-আউটের জন্য রয়েছে টায়ারের গোলকিপার। তবে আমার মনে হয় না এই খেলা থেকে নিজের সম্মান ছাড়া আর কিছু অর্জন করা যাবে।
এসব ছাড়াও ভিতরে রয়েছে বাচ্চাদের জন্য অসংখ্য ট্রাম্পুলিন এবং বাউন্স হাউজ। আমারও ইচ্ছা করছিল ওগুলোতে লাফাতে, কিন্তু বয়স বেশি বেড়ে গেছে। ২৮ বছর বয়সী কেউ নিশ্চয় বাউন্স হাউজে গিয়ে সবার চোখে উদ্ভট সাজতে পারবে না।
ফ্যান ফেস্ট সাইটের প্রাণ হলো এখানকার বিশাল বিশাল স্ক্রিনগুলো। কেন্দ্রের বড় পর্দাটার সামনে একটা স্টেজও রয়েছে। খেলার ফাঁকে ফাঁকে স্থানীয় ব্যান্ড গান পরিবেশন করে স্টেজে।
এখানে যারা আসে, তারা সবাই তাদের নিজ নিজ দেশের জার্সি, টুপি পরিহিত। কেবল আমি বাদে। হয়তো ইউএস ফুটবল বিশ্বকাপে নেই বলেই। পরের বিশ্বকাপে হয়তো আমিও সাজবো। নিজ নিজ দেশের হয়ে চিয়ার করা দর্শকদের উন্মাদনার কোনো কমতি নেই। সেইন্ট পিটার্সবার্গের ফ্যান ফেস্টে থাকা ব্রাজিল ফ্যানদের দেখে তো সেটাই বোঝা যাচ্ছে।
আমার কাছে এই ফ্যান ফেস্টের আইডিয়াটা চমৎকার লাগে। এখানে এসে বিভিন্ন দেশের ফ্যানরা এক হতে পারে, ছবি তোলার সুযোগ পায় প্রবল প্রতিপক্ষের ফ্যানদের সাথে, আড্ডা দিতে পারে। এটা হয়তো শুনতে ন্যাকামির মতো লাগতে পারে, কিন্তু বিশ্বকাপ তো এজন্যই আসে।
বিয়ারপান এবং ফুটবল দুটো একসাথেই দারুণ চলে। অন্ততপক্ষে আমার ধারণা পাগলাটে ফুটবল ফ্যানরা এই দুটো একসাথে পেতেই পছন্দ করে। সেজন্যেই সাইটে প্রচুর পরিমাণ বিয়ারের সরবরাহও রয়েছে।
তিউনিসিয়ার বিপক্ষে জয়ের পর ইংল্যান্ড ফ্যানদের বিয়ার নিয়ে উদযাপন দেখে তো আমার ধারণাটাকেই সঠিক বলে মনে হচ্ছে।
সাইটের ভিতর একটা অংশে ছাতা দিয়ে ঢাকা কিছু পিকনিক টেবিলও রয়েছে। খাবার এবং পানীয়ের জন্যই তৈরি করা হয়েছে এই অংশটা। আশ্চর্যজনক ব্যাপারটা হলো, ফ্যানফেস্টের ভেতরে থাকা খাবারের মূল্য কিন্তু বাইরের পার্কে থাকা স্ট্রিট ফুডের চেয়ে অনেক কম। ছবিতে পেছনে থাকা দালানটা হচ্ছে শহরের ঐতিহ্যবাহী লোমোনোসভ মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটির একটি অংশ।
কোনো দল গোল করলেই ফ্যান ফেস্টের পরিবেশটা বেশি মুখর হয়ে যায়। ‘ভেতরে আসলেই সত্যিকারের পার্টি পরিবেশ থাকে। আমার ধারণা পুরো পৃথিবী থেকেই ভক্তরা এখানে এসে জড়ো হয় বলে এখানকার পরিবেশটা অনেকটা বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়ে থাকে,’ গত তিন বিশ্বকাপেই ফ্যান ফেস্টে যাওয়া ব্রাজিলিয়ান ফ্যান বেট্রিজ আন্দ্রাদে ফিফাকে একথাই বলছিল।
ভেতরে একটা ভিআর স্টেশন আছে, যেখানে ফুটবল গোলকিপার হিসেবে নিজের যোগ্যতা কেমন তা যাচাই করা যায়। তবে গেমটা যেন একটু কেমন, আমার বারবারই মনে হচ্ছিল আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবো। তারপরেও কিন্তু গেমটা প্রচণ্ড মজার।
যদি ভিআর গেম ভালো না লাগে, তাহলে এয়ার হকি (ফুটবল?) টেবিলও আছে। আমি এক রাশিয়ানের সাথে খেলেছিলাম এই টেবিলে। বেশ শক্ত প্রতিপক্ষ ছিল লোকটা।
ঐতিহ্যবাহী রাশিয়ান সামগ্রী বিক্রির একটি স্ট্যান্ডও রয়েছে ভেতরে।
এছাড়াও রয়েছে চমৎকার সব ছবি তোলার জন্য অসংখ্য জায়গা। যেমন নিচের ছবিতে থাকা এই দেয়ালটা। দেখে হয়তো মনে হচ্ছে আমি বাইসাইকেল কিক দিচ্ছি। কিন্তু আসলে দেয়ালটাই এমন করে তৈরি করা হয়েছে ছবি তোলার জন্য। আমি কিন্তু ফুটবলে তেমন পারদর্শী নই।
অবশ্যই বড় বড় কোম্পানিগুলোও সেখানে তাদের বিজ্ঞাপনের জন্য কিছু এন্টারটেইনমেন্টের ব্যবস্থা করেছে। কোকাকোলার উপস্থিতিটা চোখে পড়ার মতো।
তারা ফ্রিতেই আমাদেরকে বিশ্বকাপের হ্যাট এবং ব্লো-আপ #1 ফিঙ্গারগুলো দিচ্ছে।
মুখে পছন্দের দলের পতাকা বা স্মারক আঁকার জন্য হাতে আঁকা আর্টিস্টও রেখেছে কোকাকোলা।
ম্যাকডোনাল্ড তৈরি করেছে মানব ফুটবলের অদ্ভুত এক এরিয়া। এখানে দড়িতে বাঁধা মানুষকে খেলতে হয়। খেলাটা প্রচণ্ড মজার। ছবির বাচ্চাদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা।
এমনকি বাস্তব অ্যাঙরি বার্ড খেলার এরিয়াও রয়েছে এখানে। তবে এই খেলাটা অনেক কঠিন। অনেক দূর যাওয়ার মতো ইলাস্টিসিটি নেই এই গুলতির।
হুন্দাই তৈরি করেছে সবচেয়ে সেরা ফটো স্টেশনের। ব্যাকগ্রাউন্ডে তারা একটা গোলপোস্ট রেখেছে, যেটার সামনে ছবি তুললে মনে হয় যেন আমি গোল বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছি।
দিনের বেলায় ফ্যান ফেস্ট অতটা পূর্ণ থাকে না। তবে খেলা শুরু হওয়ার সময় থেকেই সাইটে লোকজন আসতে শুরু করে। আজও একই অবস্থা। সন্ধ্যা ৬টার খেলা শুরু হওয়ার সময় এগিয়ে আসতেই মানুষের আগমন বাড়তে শুরু করেছে। খেলা শুরু হবে একটু পরই। খেলা দেখায় তেমন আগ্রহ নেই আমার। সাইটের হালহকিকত দেখার জন্যই এখানে এসেছিলাম। তাই আর অপেক্ষা না করে সাইট থেকে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
মূল লেখাঃ HARRISON JACOBS
ফিফা অফিসিয়াল ফ্যান ফেস্ট ভ্রমণের গল্প

Loading...