অজন্তা এবং ইলোরা গুহার নাম শোনেনি এমন সিরিয়াস ভ্রমণ পিয়াসু মানুষ খুবই কমই আছেন। বিশেষ করে প্রত্নতত্ত্ব যাদের প্রিয় বিষয় তাদের তো কথাই নেই। ভারতীয় উপমহাদেশে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এই অজন্তা- ইলোরা গুহা।
এমনকি আমাদের প্রদোষ চন্দ্র মিত্তির ওরফে ফেলুদাও এখানে একবার তোপসে আর জটায়ুকে নিয়ে মারমার কাটকাট অ্যাকশন করে এসেছে। কিন্তু আজ গোয়েন্দা গল্প নয়, সে না হয় অন্য কোনোদিন হবে। তারচেয়ে বরং চলুন আজ অজন্তা আর ইলোরা থেকেই ঘুরে আসি।
অজন্তা এবং ইলোরা মূলত দুটি আলাদা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের রাজ্য মহারাষ্ট্র। এই রাজ্যেই রয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত অজন্তা-ইলোরা গুহা যা তার সুনিপুণ ভাস্কর্য আর গুহাচিত্র দিয়ে মুগ্ধ করে রেখেছে পৃথিবীকে। এদের মধ্যে ইলোরা গুহা আওরঙ্গবাদ শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে ও খুলদাবাদের নিকটে অবস্থিত।

অপরদিকে অজন্তা গুহা আওরঙ্গবাদ থেকে ১০৫ কিলোমিটার উত্তরে জলগাঁও রেলস্টেশনের কাছে, অজন্তা গ্রামের পাশে পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত। গুহা দুটির মধ্যকার দূরত্ব ১০৮ কিলোমিটার। ভূতত্ত্ববিদদের মতে প্রাচীনকালে আগ্নেয়গিরির উদ্গীরনের ফলে এই এলাকা গঠিত হয়েছিল। ফলে পাহাড়ি অঞ্চলে বিভিন্ন শিলার প্রাচুর্য সহজেই লক্ষণীয়। এর মধ্যে রয়েছে শক্তিশালী গ্রানাইট পাথর। অজন্তা আর ইলোরা গুহা এই শক্তিশালী মজবুত পাথর কেটে নির্মিত হওয়ায় তারা এতদিন যাবত টিকে রয়েছে।
স্থাপত্যশৈলী, নির্মাণ প্রভৃতির কারণে আলাদা হওয়া সত্বেও অজন্তা-ইলোরা একই সাথে উচ্চারিত হয়। এই লেখায় আমরা দুটি পর্বে অজন্তা ও ইলোরা গুহা নিয়ে আলোচনা করব। আজকে রইলো ইলোরার কথা।
বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদায় ভূষিত ইলোরার গুহা মন্দিরগুলো চরনন্দীর পাথুরে পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে। এই পাহাড় শক্ত গ্রানাইটে নির্মিত। চতুর্থ থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে কালাচুরি, চালুক্য ও রাষ্ট্রকূট রাজবংশের শাসনামলে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ২ কিমি এলাকা জুড়ে তৈরি হয়েছিল এই গুহাগুলো।
ইলোরাতে রয়েছ খোদাইকৃত বহুতল বাসভবন, মন্দির এবং রান্নাঘর। এখানে মোট ৩৪টি গুহা রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম বারোটি গুহাতে মহাযান পন্থী বৌদ্ধদের ঐতিহ্য উপজীব্য করে নির্মিত হয়েছে। পরের সতেরটি গুহার বিষয়বস্তু হিন্দুধর্ম আর শেষ পাঁচটি গুহা জৈন ধর্মের নিদর্শনে পরিপূর্ণ। সেই প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের পারস্পারিক ধর্মীয় সহাবস্থানের এক অনুপম নিদর্শনও এই ইলোরা।

বৌদ্ধ গুহাগুলোর মূল উপজীব্য বৌদ্ধমূর্তি, বোধিসত্ত্ব আর অপ্সরা। এদের মধ্যে ৫ নং গুহাটি সবচেয়ে বৃহত্তম। অপরদিকে হিন্দু গুহাগুলোর মুখ্য উপজীব্য শিব। নানা ভাস্কর্যে নানান দৃশ্যে মহাদেব শিবকে দেখা যায় এখানে।
কখনও তিনি দৈত্য বধ করছেন আবার কখনও তিনি নৃত্যরত। ইলোরার সব থেকে উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রকূট রাজাদের সময়কালে নির্মিত ১৬ নং গুহা যা কৈলাস মন্দির নামে খ্যাত। এটির নির্মাণের কৌশল, নিপুণতা এবং পরিশ্রম এতই অবাক করে দেওয়ার মতো যে পর্যটকরা তো প্রশ্নই তুলে বসে আছেন যে এটি আদৌ মানুষে করেছে নাকি কোনো মহাজাগতিক শক্তি কিংবা দেবতারা এটা করেছেন। এটি নিয়ে আলাদাভাবে পরে এক পর্বে লেখার ইচ্ছা রইলো।
শিলা কেটে তৈরি ইলোরা গুহাগুলোতে অজন্তার মতো ছবির অভাব থাকলেও অসাধারণ সব ভাস্কর্য তার অভাব পুষিয়ে দিয়েছে। ত্রয়োদশ শতকে প্রথমবার এবং পরে মুঘল শাসক আওরঙ্গজেবের রোষানলে অনেকখানি ধ্বংস হয় ইলোরার মন্দিরগুলো। তবে আজও যা অবশিষ্ট রয়েছে তাই মুখ হা করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট!
আপনার যদি সময়ের অভাব থাকে এবং সবগুলো গুহায় ঢুকতে না পারেন তবে অবশ্যই ৬, ১০, ১১, ১২, ১৫, ১৬, ২১, ২৯, ৩২ আর ৩৪ নং গুহাগুলোর ভাস্কর্য দেখতে ভুল করবেন না। আসুন আমরা কয়েকটি চমৎকার নিদর্শনের দেখে আসি এক পলকে।

রাবণের সভাগৃহ
কৈলাস মন্দির থেকে ৩৫০ মিটার দূরে চৌদ্দ নম্বর গুহা অবস্থিত। একে বলা হয় রাবণের সভাগৃহ। এটি আনুমানিক সপ্তম শতকে তৈরি হয়েছিল। এখানে বৃহৎ স্তম্ভ দিয়ে সজ্জিত সভাগৃহ, একটি মণ্ডপ, একটি শিবলিঙ্গ রয়েছে যার চারদিকে প্রদক্ষিণ পথ রয়েছে। প্রবেশপথে রয়েছে দেবী গঙ্গার মূর্তি। মণ্ডপের দুই পাশের দেওয়াল মোট পাঁচটি অংশে বিভক্ত। এখানে শৈব বিশ্বাস এবং বৈষ্ণব বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত অসংখ্য নিপুণ ভাস্কর্য রয়েছে।
কৈলাস মন্দির থেকে ৫০০ মিটার দূরে দশ নম্বর গুহাটি বিশ্বকর্মা গুহা নামে পরিচিত। এটি বৌদ্ধ গুহাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। এটি ছুতার-কা-ঝুপড়ি নামেও পরিচিত। কারণ স্থানীয় ছুতার সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে গৌতম বুদ্ধের মূর্তিকে বিশ্বকর্মা হিসেবে পূজা দেয়। বিশ্বকর্মা হিন্দু ধর্মের সাথে সম্পর্কিত। তিনি সমস্ত শিল্পের স্রষ্টা হিসেবে হিন্দুদের কাছে পূজনীয়।
ছুতার-কা-ঝুপড়ি
ইলোরার গুহাগুলোর মধ্যে এটি সম্ভবত সবচেয়ে সুন্দর গুহা। পাথর কেটে দু’পাশে অসাধারণ সব কারুকাজ ফুটিয়ে তুলে এটি শেষ মাথায় চলে গেছে। একেবারে মাথায় এগার ফুট উঁচু গৌতম বুদ্ধের নিখুঁত মূর্তি স্থাপিত। এটি মহাযান শৈলীতে নির্মিত। সাধারণভাবে দেখলে এটিকে আর পাঁচটি চৈত্য গৃহ মনে হয়। কিন্তু আপনি যখন মাথায় আনবেন বিপুল আয়তনের এই গুহার এর সমস্তটুকুই একটি পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে, তখন আপনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবেন।

ইন্দ্রসভা
কৈলাস মন্দির থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার উত্তরে ৩২ নম্বর গুহা অবস্থিত। এটি একটি জৈন গুহা। জৈন গুহাগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে সুন্দর এবং বৃহৎ। এটি মহাবীর এবং অন্যান্য জৈন ধর্মগুরুদের উৎসর্গ করে নির্মিত।
কীভাবে যাবেন:
দিল্লি থেকে ট্রেনে আওরঙ্গবাদ পর্যন্ত- ১,২৫৮ কিলোমিটার।
হায়দ্রাবাদ থেকে ৫৩৪ কিলোমিটার।
আর মুম্বাই থেকে ৩৫০ কিলোমিটার।
কোথায় থাকবেন
ইলোরাতে রাত্রিবাসের জন্য রয়েছে-
হোটেল কৈলাস
ভাড়া ১,৯০০-৩,৮০০ টাকা।
যোগাযোগ-০২৪৩৭২৪৪৫৪৩।
হোটেল চৈতন্য
ভাড়া ১,০০০ টাকা।
যোগাযোগ-০৯৮২৩১৪২৮৪১।
Feature Image: Wondermondo