চাঁদপুর জেলা যে ‘ইলিশের বাড়ি’ হিসেবে খ্যাত সে কথা বোধ করি আমরা সকলেই জানি। ইলিশ মাছের অন্যতম প্রজনন অঞ্চল এই চাঁদপুর। যেটি চট্টগ্রাম বিভাগের নদীবিধৌত একটি অঞ্চল আর অবস্থিত বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে। যদিও একটা সময়ের আগ পর্যন্ত অঞ্চলটি ছিল বৃহত্তর কুমিল্লারই একটি অংশ।
টাটকা ইলিশ খাওয়ার লোভেই বলি আর চর এলাকায় প্রথম পা রাখার জন্যই বলি, সেমিস্টার ফাইনাল শেষ করে এবারের ঘোরাঘুরি হিসেবে জায়গা নির্ধারিত হলো এই চাঁদপুর। কয়েকজন বন্ধু মিলে যাবো। একসাথে বসে পরিকল্পনা করে ফেললাম।
চাঁদপুরের বিখ্যাত ওয়ান মিনিট আইসক্রিম, প্রধান তিনটি চর, বড় স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত আকর্ষনীয় মোলহেড, ট্রেনে করে যাওয়ার প্রথম অভিজ্ঞতা কোনটা রেখে যে কোনটায় ছুটবো আগে সেই নিয়েই রীতিমতো উত্তেজনা চলছে সবার মধ্যে।

মোলহেডে অবস্থিত ইলিশের ভাস্কর্য; Source: লেখিকা
কুমিল্লা থেকে একদিনের ট্যুর যেহেতু রওনা দিতে হবে সকাল সকাল। তবে ট্রেন ছাড়ার সময়সূচির সাথে আমাদের মিলছিলো না বলে বাসে করেই রওনা হলাম সকাল ৭টার বাসে। সবাই মিলে সিদ্ধান্তও নিলাম ফেরার পথে যে করেই হোক ট্রেনে আসা চাই।
বাস ছাড়লো কুমিল্লার জাঙ্গালিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে। বিশ্বরোড, লাকসাম ছাড়িয়ে বাস এগুচ্ছে তরতর করে আর আমরা উপভোগ করছিলাম মন ভোলানো সকালের হাওয়া। রাস্তা কিছুটা খারাপ থাকায় চাঁদপুরে শহরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে লাগলো দুই ঘণ্টা প্রায়। বাস থামলো শহরের বাসস্ট্যান্ডে।

রক্তধারা স্মৃতিসৌধ; source: লেখিকা
সেখানে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। স্ট্যান্ড থেকে দশ টাকার ভাড়ায় অটো রিকশায় করে পৌঁছালাম বড় স্টেশনে। এখানে নেমেই একটা ফটক দেখতে পাবেন যেটি পেরুলেই আপনি পা রাখবেন মোলহেডে। সামনে তাকালেই দেখা যাবে ইলিশ মাছের একটি বিশাল ভাস্কর্য।
মোলহেড মূলত চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের একটি অংশ। আর তিন নদী যথা পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়ার মিলনস্থলই হচ্ছে রূপালী ইলিশের উৎকৃষ্টতম প্রজনন কেন্দ্র।
প্রজননের সময় এই মোলহেড সংলগ্ন মোহনায় সাগর থেকে উঠে আসে মা ইলিশ। নদীতে এসে ডিম ছাড়ে। জাটকা থেকে কিশোর ইলিশ পর্যন্ত মাছের বৃদ্ধি এই মোলহেড সংলগ্ন ত্রিমোহনাতেই ঘটে। তাই বলা চলে দেশের ইলিশ উৎপাদনে এই ত্রিমোহনার গুরুত্ব অসীম।

মোলহেডের চরকি; source: লেখিকা
মোলহেড একটি চত্বরের মতো যার তিন দিকেই নদীর পানি। একটা বড় চরকি আর বাচ্চাদের জন্য খানিকটা বিনোদনের ব্যবস্থাও দেখলাম।
এই চত্বরের মূল আকর্ষণ রক্তধারা স্মৃতিসৌধ। যা কিনা চাঁদপুর জেলার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে তৈরি করা একটি স্থাপনা বা স্মৃতিসৌধ। টকটকে লাল তিনটি রক্তবিন্দুর সম্মিলিত স্থাপনা সত্যিই নান্দনিক।
বলা হয়ে থাকে,, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী চাঁদপুর জেলার তিন নদীর মোহনা সহ চাঁদপুর পুরান বাজার এবং বড় স্টেশনে কয়েকটি টর্চার শেল তৈরি করে এই জেলার মুক্তিকামী মানুষদের ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালানোর জন্য।

পুরো চত্বর; source: লেখিকা
মৃত অসহায় বাঙালিদের লাশ ভাসতো নিজেদের মেঘনা, ডাকাতিয়া নদীর স্রোতে। মূলত এই হত্যাযজ্ঞে যারা শহীদ হন, তাদের স্মরণেই এই রক্তধারা স্মৃতিসৌধটি তৈরি করা হয় ২০১১ সালে।
চত্বরের চারপাশটা একটু দেখে নিয়ে আমরা গেলাম বাঁধানো ঘাটের সারি সারি ট্রলারের কাছে। ঘড়িতে তখন বারোটার মতো। যদিও বিকেলের দিকে চরে গেলে ভালো লাগতো বেশি, রোদও থাকতো কম। কিন্তু অতটা সময় বের করতে পারবো না বলেই ট্রলারের মামার সাথে আমরা কথা বললাম। তিনি জানালেন এখানে নদীর মাঝখানেই জেগে ওঠা চরের সংখ্যা অনেকগুলো হলেও মূলত পর্যটকরা ঘুরতে আসলে তিনটি চরেই যায়।

ঘাটে বাঁধা ট্রলারের সারি; source: লেখিকা
চর তিনটি- রাজরাজেশ্বর চর, ঈশানবালার চর আর পদ্মার চর। পদ্মার চরকে বালুর চরও বলে। আর মেঘনার চরকে কাশফুলের চর। মামা জানালেন পুরো ট্রলার ভাড়া করে তিনি দুইটি চর দেখাবেন। ভাড়া চাইলেন ৬০০ টাকা।
সময় স্বল্পতার কারণে আমরাও সবগুলো চরে যেতে পারবো না। অগত্যা যাত্রা করলাম পদ্মার চরের দিকেই। দর কষাকষি করে দাম ঠিক করলাম ৫০০ টাকায়। যদিও বিকেলের দিকে অনেক লোক একসাথে গেলে মাথাপিছু ৫০ টাকাতেই ট্রলার ছাড়ে। ট্রলারে চেপে বসলাম আমরা।

পাড়ের জীবন; source: লেখিকা
ইঞ্জিনের শব্দটাও আনন্দ দিচ্ছিলো তখন। বিশাল কিছু লঞ্চের দিকে তাকিয়ে, বাঁধাই করা পাড়ে স্থানীয়দের জীবনযাত্রার প্রবাহধারা, ঘুরতে আসা লোকজনের আনাগোনা সব মিলিয়েই চারপাশটা ভালো লাগছিলো ভীষণ।
আশপাশটা মুগ্ধ চোখে দেখে যাচ্ছি সবাই এমন সময়ই মামা ডেকে দেখালেন তিন নদীর সঙ্গমস্থল আর পানির রঙ। আহা! সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। তিন নদী মিশে আছে যেখানে তিন রকমের রঙ নিয়ে। পদ্মার পানি একটু কালচে সবুজ আর মেঘনার পানি ঘোলাটে।

আমাদের ট্রলার; source:লেখিকা
যাত্রীবাহী নৌকা আর লঞ্চ দেখতে দেখতে মাত্র দশ মিনিটের মাথাতেই পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত চরে। হৈ হৈ করে নেমে পড়লাম সবাই। কেমন ধূ ধূ বালি যতদূর চোখ যায়। তার মাঝেমাঝেই কিছু কাশফুল বা জংলী আগাছা। মাটিতে পা রেখেই বুঝলাম পায়ের পাতা ডেবে যাচ্ছে অনেকটাই।
ঘোলা পানিতে পা ভিজিয়ে তাকালাম তীরবিহীন প্রশস্ত নদীর দিকে। কোনো সাগর সৈকতে দাঁড়িয়ে আছি মনে করেও ভুল হতে পারে। চরে কিছুক্ষণ ছবি তোলা আর হাঁটাহাঁটি করে ট্রলারে করে পৌঁছালাম এবার অন্য আরেকটা চরে। সেখানে দেখলাম কাশফুলের ছড়াছড়ি।

চর থেকে ট্রলার; source: লেখিকা
মন সতেজ হওয়ার মতো একটা সময় ছিল তখন। চারপাশে নদী আর আমি যেন দাঁড়িয়ে আছি মাথা উঁচু করা কোনো দ্বীপে এমন অদ্ভুত এক অনুভূতি সেটা। প্রায় দুই ঘণ্টার মতো সময় কাটিয়ে ফের উঠে গেলাম রিজার্ভ করা ট্রলারে। আপনারা চাইলে নৌকা করেও আসতে পারেন চরে।
মোলহেডে যখন পৌঁছালাম পেটের ক্ষুধায় তখন সবার কাহিল অবস্থা। দুপুরের খাবার সেরে নিলাম একটা হোটেলে ঢুকে। সবাই মিলে অর্ডার করলাম সরষে ইলিশ, ভাত কেউ আবার মোরগ পোলাও। বেশ লেগেছিলো চাঁদপুরের ইলিশ। অনায়াসে তৃপ্তির ঢেকুর চলে আসবে।

চরের মাটি আর গাছ; source: লেখিকা
খাওয়া শেষ করে এবার রওনা হলাম কালীবাড়ি মোড়ে ওয়ান মিনিট আইসক্রিম খাওয়ার জন্য। সেখান থেকে কিছুক্ষণ হেঁটে দেখা পেলাম দোকানটির। সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা ‘ওয়ান মিনিট’। প্রতি কাপ ৪০ টাকা। দুধ আর কলার ফ্লেভারের আইসক্রিমটি খারাপ লাগবে না আপনার। বিশেষ করে আইসক্রিমটির শেইপ চমকপ্রদ।

এই সেই বিখ্যাত ওয়ান মিনিট আইসক্রিম; source: লেখিকা
আয়েশ করে আইসক্রিম খাওয়া শেষে আবার ফিরে গেলাম মোলহেডে। উদ্দেশ্য বিকেলের সূর্যের আলোয় নদীর ঝিকিমিকি দেখা আর পসরা সাজিয়ে বসে থাকা ফুচকা, চটপটি আর অপূর্ব করে সাজিয়ে রাখা মিষ্টি পান মুখে দেওয়া।
বিকেলের প্রায় সমস্তটাই কাটিয়ে দিলাম বাঁধাই করা ঘাটে বসে। মন আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল সেই অভূতপূর্ব আলোয়। সময় ফুরিয়ে এলে হুইসেল শুনলাম ট্রেনের। উঠে পড়লাম আমরা। দারুণ একটা দিন পার করে এবার ফিরতে হবে ঘরে। মন কিছুটা বিষণ্ণ হলেও ট্রেনে চড়ার আনন্দকে পুঁজি করেই বাড়ির পথে রওনা হলাম সবাই।

বিকেলের আলোয় নদীর প্রতিচ্ছবি; source: লেখিকা
খরচ
কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর বোগদাদ বাসের ভাড়া – ১২০ টাকা
শহরের ভেতর মোট অটোভাড়া – ৫০ টাকা
খাবার খরচ – ২০০ টাকা
ট্রলার ভাড়া – ১০০ টাকা (প্রতিজনে)
চাঁদপুর থেকে কুমিল্লা ট্রেন ভাড়া – ৩৫ টাকা
যেভাবে যাবেন

ফিরতি পথের ট্রেন; source: লেখিকা
কুমিল্লা থেকে গেলে বাস বা ট্রেনে খুব সহজেই চাঁদপুর পৌঁছানো যায়। তবে ঢাকা বা অন্যত্র থেকে লঞ্চ ভ্রমণটাই সবচেয়ে আনন্দদায়ক।
Feature Image: লেখিকা