রোমান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের দেশ ইতালি। স্বাভাবিকভাবেই ইতালি চিত্রকর্মের সংস্কৃতি এবং স্থাপত্যে কারুকলায় বেশ উন্নত একটি দেশ। রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ইতালি যে শুধু কারুকার্য আর স্থাপত্যে বিশ্ববিখ্যাত ব্যাপারটা এমন নয়, প্রাকৃতিক দিক দিয়ে ইতালি বেশ সমৃদ্ধ। এখানে আছে পাহাড়, পর্বত, হ্রদ আর নাটকীয়ভাবে সুন্দর সমুদ্রসৈকত। প্রতি বছর আমাদের দেশ থেকে বেশ ভালো সংখ্যক মানুষ ইতালি যায়, তবে ঘুরতে নয় জীবিকার সন্ধানে।
ঘুরতেও যায় মানুষ, তবে তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। একটু খরচ বেশি হলেও বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো দেশ ইতালি, ইচ্ছে আর টাকা থাকলে ইতালি ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করা যেতেই পারে। যেকোনো দেশে বা জায়গায় যাওয়ার আগে দেখে নিতে হয় ঠিক কোথায় কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় সে দেশের, কোথায় আছে অনন্য সাধারণ কিছু। ইতালির সে সব ভ্রমণস্থানের গল্প নিয়েই থাকছে আজকের লেখা যা আপনার ইতালি ভ্রমণকে করে তুলবে সহজ এবং আনন্দময়।
কলোসিয়াম

রোম বা ইতালি যাই বলুন, এই অঞ্চলের শীর্ষ ভ্রমণস্থান হিসেবে সবার আগে কলোসিয়ামের নামটি উঠে আসবে। প্রাচীন রোম থেকে শুরু করে আজকের ইতালির পুরো ঐতিহ্যকে বুকে ধারণ করে আছে কলোসিয়াম নামক এই স্থাপনাটি। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে জানা যাবে, এটি ছিল মূলত বিভিন্ন রাজকীয় খেলাধুলার প্রধান প্রাঙ্গণ। বর্তমানেও এটি বড় বড় খেলাধুলার আয়োজক স্থান।
মল্লযুদ্ধ, তরবারি খেলা থেকে শুরু করে হিংস্র জানোয়ারের সাথে মানুষের লড়াই সবই আয়োজন করা হয়ে থাকে কলোসিয়ামে। কলোসিয়াম শুধু ইট পাথরের স্থাপনা নয়, এখানে আছে কাঠের তৈরী বিশাল মেঝে যা ৮৩ বাই ৪৮ ফুটের বিশাল জায়গা জুড়ে বানানো। আরো আছে পাতাল ঘরে যোদ্ধাদের থাকার জায়গা, জন্তু-জানোয়ার রাখার খাঁচা প্রভৃতি।
ভ্যানিস ক্যানেল

ইতালির ভ্যানিসে পানির উপরে নৌকা ভ্রমণের দৃশ্য এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় কিছু ল্যান্ডস্কেপের মধ্যে পড়ে। দশকের পর দশক ধরে পুরো ভ্যানিসের মূল সড়ক হয়ে আছে এই ভ্যানিস ক্যানাল। এখানকার ছোট ছোট নৌকাগুলোকে “গন্ডোলা” বলা হয়। বেশ রোমান্টিকতায় সাজানো প্রতিটি নৌকায় চড়ে দেখে নেয়া যাবে ভ্যানিসের অসাধারণ সব প্রাসাদ।
প্রাসাদগুলো এমনভাবে পানির দুপাশ ধরে গড়ে উঠেছে যে নৌকা দিয়েই দেখে নেয়া যায় প্রায় সব কটা প্রাসাদ। এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় পানিপথ হলো “দ্যা গ্র্যান্ড ক্যানাল”। গ্র্যান্ড ক্যানালে চড়ে বেড়ানোর বাহনকে বলা হয় “ভ্যাপোরেট্টো”। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত বছর পানির ধারে থাকা সত্বেও একটুও ক্ষয় হয়ে যায়নি বা কমেনি প্রাসাদগুলোর সৌন্দর্য।
পোম্পেই

ইতালির সব সৌন্দর্য মানুষে গড়া নয়, কিছু সৌন্দর্য প্রকৃতি নিজ হাতে গড়েছে। পোম্পেই ঘুরে গেলে ঠিক এ কথাটাই মাথায় ঘুরবে যেকারো। তবে প্রকৃতির এই পোম্পেই গড়ার ধরণটা একটু ধ্বংসাত্মক ছিল। ৭৯ অব্দে ইতালির মাউন্ট ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি সক্রিয় হয়ে লাভা ঢেলে দেয় পোম্পেই নগরীতে। পুড়ে যায় বাজার, জনপদ, মন্দির, থিয়েটার, রাস্তাঘাট সবকিছু। এরপর প্রায় কয়েক শতক ধরে পোম্পেই নগরীর খননকাজ চলতে থাকে যার বদৌলতে আমরা পাই আজকের পোম্পেই। পুড়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ বেশ ভালোভাবে সংরক্ষণ করেছে এখানকার কর্তৃপক্ষ। পর্যটকরা চাইলে ঘোড়ার গাড়িতে পুরো পোম্পেইয়ের চক্কর লাগাতে পারে অনায়াসেই আর সাক্ষী হতে পারে প্রায় ২০০০ বছর আগের রোমান প্রকৌশলের।
হেলে পড়া পিসার টাওয়ার

ইতালির পিসা শহরের এই হেলে পড়া টাওয়ারের গল্প শুনেছেন নিশ্চয়ই? অত্র অঞ্চলের বেশ নামকরা ভ্রমণস্থান এটি। ১১০০ অব্দে কাজ শুরু হওয়া এই টাওয়ারের প্রকৌশলে ঝামেলা থাকার ফলে এটি মাটির ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে অল্প অল্প করে। এই মাটির ভেতর ঢুকে যাওয়া শুরু হয় যখন এর কাজ প্রায় ৩য় তলা পর্যন্ত শেষ। ১৯৯০ এর দিকে ৬ তলা বিশিষ্ট এই টাওয়ারের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় যে ২০০০ সালের মধ্যে এটি ভেঙে পড়বে। কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি ভেঙে পড়া তো দূরের কথা, মিডিইভাল পাথরে গড়া এই টাওয়ারের সিঁড়ি বেয়ে প্রচুর পর্যটক উঠে যায় এর ছাদে আর উপভোগ করে পুরো পিসা নগরীর সৌন্দর্য।
লেক কমো

ইতালির শীর্ষ হ্রদগুলোর কথা বলতে চাইলে প্রথমেই লেক কমোর নাম চলে আসবে। অদ্ভুত স্নিগ্ধতায় যেন পুরো এলাকাটিই গমগম করে লেক কমোর। লেক কমোকে ঘিরে কয়েকটা ছোট ছোট ভিলা আর ছোট শহর রয়েছে। হ্রদের আশেপাশেই গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল সব প্রাসাদ যেগুলোর বেশ কয়েকটিই সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রাসাদের সামনে বাগান আর বাগানের সামনে কাঠের বেষ্টনী দেয়া সুন্দর ঝকঝকে হ্রদের পাড় মন কেড়ে নেবে এক নিমেষেই। হ্রদের আশেপাশেই পাওয়া যাবে থাকার হোটেল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র।
আমালফি কোস্ট

জানামতে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণাকৃত সবচেয়ে বেশি জায়গার অধিকারী দেশ ইতালি। আমালফি কোস্ট সেই হেরিটেজ সাইটগুলোর মধ্যেই একটি। সাগরের তীর ঘেঁষে উঁচু উঠে যাওয়া পাহাড়ের বুকে নানান রঙয়ের ঘরবাড়ি আর গির্জার সমারোহে চোখ জুড়াতে আমালফি কোস্টে আসতেই হবে আপনাকে। নেপলস আর সোরেন্টোর দক্ষিণে অবস্থিত সোরেন্টাইন পেনিনসুলা সমুদ্রতট ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দুটি শহর, পজিতানো আর আমালফি।
এদের মধ্যে আবার আমালফির জনপ্রিয়তা একটু বেশি। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে প্রায় নব্বই ডিগ্রি খাড়া পাহাড়ের গাড়ে গড়ে ওঠা আমালফি শহরটি যেকারো মন কেড়ে নেয়ার যোগ্যতা রাখে। সাগরের তীর ঘেঁষে নৌকা দিয়ে অথবা গাড়িতে চড়ে দুভাবেই ঘুরে ফেলা যাবে আমালফি শহরটি। সেক্ষেত্রে দুই ধরনের ভ্রমণে একই শহরে পাওয়া যাবে দুটি ভিন্নরকম রুপের সন্ধান।
ফ্লোরেন্স দৌম সান্তা মারিয়া দেউ ফিওরি

বিশ্বের দারুণ কিছু গির্জার নামের তালিকা করলে সবসময় একটি বড় নাম সামনের দিকে থাকবে, সেটি হলো ফ্লোরেন্স দৌম সান্তা মারিয়া দেউ ফিওরি। নামের মতোই বিশাল এর আকার। দুর্দান্ত নকশায় তৈরী এর বিশাল গম্বুজের আকর্ষণে প্রতিবছর ঘুরতে আসে এখানে শতশত পর্যটক। এর নকশাবিদের নাম গিয়ত্তো যার নকশায় গির্জাটি নিমার্ণ করা হয়েছিল ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়টায়। ১৪৩৪ সালে গির্জাটির কাজ সমাপ্ত করেন ফিলিপ্পো ব্রুনেলেশচি। প্রায় ৪১৪টি সিঁড়ি বেয়ে একদম উপরে ঘণ্টা-ঘরে উঠে যাওয়া যায় এই গির্জায় আর উপভোগ করা যায় পুরো শহরের প্যানারোমিক এক অবর্ণনীয় দৃশ্য।
চিংকোয়ে তেররে

ইতালির সমুদ্রতটের পাশে গড়ে ওঠা আমালফির মতো চিংকোয়ে তেররেও সমুদের পাশে পাঁচটি গ্রাম নিয়ে গড়ে ওঠা এক জনপদের নাম। অসাধারণ এই জায়গাটির মূল আকর্ষণ পাঁচটি গ্রামের নাম হলো মন্টেরসসো আল মারে, ভারনাজ্জা, করনিগলিয়া, মানারোলা আর রিওম্যাগিউর। পাঁচটির যেকোনো একটি থেকে যাত্রা শুরু করে বিভিন্ন পথে ঘুরে আসা যায় একে একে পাঁচটি গ্রামই। প্রতিটি গ্রামেই আছে রেলভ্রমণের পূর্ণ সুযোগ।
আপনি ইচ্ছে করলে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে গাড়ি দিয়েও ঘুরে আসতে পারেন পাঁচটি গ্রাম থেকে। সমুদ্রের তীর ঘেঁষে নৌকাভ্রমণের মাধ্যমে গ্রাম ঘোরার সুযোগ তো থাকছেই। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাধ্যম হলো এই পাঁচটি গ্রামে হাইকিং করা। হেঁটে হেঁটে গ্রাম দেখা, গ্রামে থাকা আর সাগরের বিশালতা উপভোগ করার মাঝে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করে। গ্রামগুলো এমনভাবে তৈরী যে আপনাকে পুরাতন বিশ্বের মৎস গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেবে। এ যেন আধুনিক পর্যটনের আদলে পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ।
ফিচার ইমেজ- 4hdwallpapers.com