ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ থানার অন্তর্গত বারোবাজারে রয়েছে ৬০০ বছরের বেশী পুরনো ১৫টি ঐতিহাসিক নিদর্শন। একই এলাকায় এতগুলো নিদর্শন খুব বেশী চোখে পড়ে না। পঞ্চদশ শতকের দিকে এই এলাকাটি মোহাম্মাদাবাদ নামে পরিচিত ছিল। সুলতানী আমলের এই রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ মাটির নিচে লুকায়িত অবস্থায় ছিল বিভিন্ন সময়ে। তবে আশির দশকে অধিকাংশ নিদর্শন উন্মোচিত হয় খননের মাধ্যমে।
এরপর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বিভিন্ন সময়ে এসব নিদর্শন সংরক্ষণ করে আসছে। নিদর্শনগুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার ফলে অনেকেই ঘুরতে এসে দুই একটা নিদর্শন না দেখে ফিরে যান। উপযুক্ত গাইডের অভাবে অনেকের অতৃপ্তি থেকে যায়। তবে গাইড ছাড়াই একা একা সবগুলো নিদর্শন কীভাবে ঘুরে দেখা যায় তা নিয়েই আজকের এই লেখা।

ঢাকা থেকে যশোরগামী যে কোনো বাসে চেপে চলে আসুন যশোর নিউ মার্কেট অথবা পালবাড়ি মোড়। এখান থেকে ঝিনাইদহ বা কুষ্টিয়াগামী যে কোনো বাসে উঠলেই ৩০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাবেন বারো বাজারে। বারো বাজার নেমে খেয়ে নিতে পারেন জামতলার বিখ্যাত রসগোল্লা অথবা বেশ কম খরচে যে কোনো হোটেলে খেয়ে নিয়ে, ভ্যান ভাড়া করতে পারেন।
বলে রাখবেন আপনি সময় নিয়ে সবগুলো নিদর্শন ঘুরে দেখতে চান ও একটিও যেন বাদ না পড়ে। ভ্যান চালকের উপর ছেড়ে দিলে ৫-৬টি নিদর্শন দেখিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারে তাই মনে রাখবেন নিদর্শন ১৫টাই আপনাকে দেখে ফিরতে হবে।

প্রথমেই চলে যান ৫ কিলোমিটার দূরে সাতগাছিয়া ৩৫ গম্বুজ জামে মসজিদে। যাবার পথেই রাস্তার পাশে দুইটি মসজিদ দেখতে পাবেন। এগুলোতে ফেরার পথে ঘুরে নেবেন। এক সময় সাতগাছিয়া জামে মসজিদ ছিলো ৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট।
বাংলা ১৩৮৪ সালেই পুনঃস্থাপন করা হয় এই মসজিদটিকে। প্রায় ধ্বংস অবস্থায় এই মসজিদটি প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো বলে দাবি করে থাকেন অনেক স্থানীয়।

এবার চলে আসুন গলাকাটা জামে মসজিদে। প্রায় ৬০০ বছরের ছয় গম্বুজ বিশিষ্ঠ এই মসজিদটি এবং এর গায়ের কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হবেন বৈকি। এখানে পাবেন প্রাচীন সংগ্রহশালা। সুলতানী আমলের তরবারী, হাতে লেখা কুরআন শরীফ, তৈজসপত্র সহ বেশ কিছু নিদর্শন। মসজিদের বাইরে একটি বিশাল ম্যাপে বারো বাজারের প্রত্যেকটি নিদর্শনের চিত্র দেয়া আছে। সেটি দেখেই এগোতে পারবেন।
গলাকাটা মসজিদ থেকে বারোবাজারের দিকে একটু এগিয়ে হাতের বাঁ দিকের প্রথম রাস্তা ধরে ১০ মিনিটের রাস্তার পর মাঠের মধ্যে পাবেন মনোরম পরিবেশে ঘাসের চাদরে মোড়ানো নামাজ গা কবরস্থান। এখানেই বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে দিতে পারবেন।

মেইন রাস্তায় উঠে একটু এগোলে হাতের ডানপাশে পাবেন বিশাল আকৃতির এক গম্বুজ বিশিষ্ট জোড়া বাংলা জামে মসজিদ। চারপাশে চারটি ভিন্ন কলামের উপর দাঁড়িয়ে আছে বর্গাকৃতির এই মসজিদটি। ইটের খাদ কেটে সুন্দর দেয়ালের এই মসজিদটি নজর কাড়ে সবার আগে।

এরপর হাতের ডানদিকের রাস্তা ধরে হেঁটে বা ভ্যানে করে চলে আসুন মনোহর মসজিদ। তবে মনোহর মসজিদ থেকে আরো ভেতর দিকে আসলে পাবেন জাহাজ ঘাটা নামক একটি স্থান। খালের পাড়ে এই স্থানে মুঘল আমলে নৌকা চলাচল করত। এখানেই ঘাট ছিল তবে জাহাজ আসত কিনা কেউ জানাতে পারেননি।
জাহাজ ঘাটা থেকে দক্ষিণ দিকে আসলে হাতের ডানদিকে পাবেন ঘোপের ডিবি কবরস্থান। চালককে ভালোভাবে বলে রাখবেন অথবা উপরের ম্যাপ দেখে জাহাজ ঘাটা থেকে একটু হেঁটে ভেতরে গেলে দেখতে পাবেন প্রাচীন জনপদের এই কবরস্থানটি। খুব বেশী স্থাপনা নেই এই কবরস্থানে। শুধু প্রাচীন ইটের বেশ কিছু স্তূপ ও কলাম চোখে পড়বে।

এবার মনোহর মসজিদ থেকে চলে আসুন দম দম প্রত্নস্থান ও শুকুর মোল্লা মসজিদ।অর্ধভগ্ন প্রত্নস্থান থেকে শুকুর মোল্লা মসজিদ পর্যন্ত একটু হেঁটে একটু ভ্যানে করে যেতে হবে।

এরপর চলে আসুন ঐতিহাসিক গোড়ার মসজিদ। চার গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের উপরের গম্বুজটি বিশালাকৃতির এবং সামনের তিনটি গম্বুজ এর আকার ছোট। মসজিদের গায়ে অসংখ্য টেরাকোটার কাজে ভরা। এর পাশেই রয়েছে বিশাল দিঘী। ইচ্ছে করলে গোসল সেরে নিতে পারেন এখানেই।

এরপর পীর পুকুর মসজিদ ঘুরে, যেতে হবে ডানে গ্রামের মধ্যে একটি সুন্দর মসজিদ। নুনুগোলা মসজিদ। এই মসজিদের নামকরণের ইতিহাস আমি জানতে পারিনি কিন্তু মাঠের মধ্যে অনবদ্য সুন্দর এই মসজিদটি আমার সব থেকে ভালো লেগেছে।
একটি বিশাল গম্বুজ নিয়ে ৫০০ বছরের এই পুরনো মসজিদ দাঁড়িয়ে আছে একা মাঠের মধ্যে। অনেকে মানত নিয়ে আসেন এই মসজিদে।

এরপর চালককে বললে নিয়ে যাবে খড়ের দিঘী মসজিদ ও সেখান থেকে বারোবাজার ফেরার পথে হাতের বাম দিকে পাঠাগার মসজিদ থেকে ঘুরে আসতে ভুলবেন না। এটি প্রাচীন না হলেও এখান থেকে জানতে পারবেন সমস্ত বারোবাজারের ইতিহাস।

এরপর যশোর- কুষ্টিয়া মহাসড়ক পার হয়ে চলে সোজা চলে আসুন বাদেঢিহি কবরস্থান। এবং এই ১৫টি প্রত্নস্থান ঘোরা শেষে হাতে সময় থাকলে চলে আসুন গাজীকালুর মাজার। এটি কোনো প্রত্নস্থান নয়। কিন্তু কিছু সময়ের জন্য এসে বাউল গানের সাথে বিশালদেহী বটের ছায়ায় বিশ্রাম করে ফিরে আসুন বারোবাজার।
কিছু কথা:
ভ্যানচালক অনেক কিছু না জানতে পারে। দরকার হলে ম্যাপ দেখে এবং স্থানীয়দের কাছে জিজ্ঞাসা করুন। পথ পেয়ে যাবেন। বেশ কিছু পথ হেঁটে যেতে হতে পারে কিছু কিছু জায়গায়। ভ্যান ভাড়া ১৫০-৩০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এটি নির্ভর করবে কয়টি স্থান আপনি দেখবেন এবং কত সময় নেবেন এর উপর নির্ভর করে। এখানে ধার্য্যকৃত কোনো ভাড়া নেই তাই আপনাকে ঠিক করে যেতে হবে।
যেহেতু এই নিদর্শনগুলো আমাদের দেশের প্রাচীন সম্পদ, তাই এমন কিছু করবেন না যাতে করে এগুলোর কোনো ক্ষতি সাধন হয়। যদিও সতর্ক থাকা উচিৎ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় থাকা কোনো নিদর্শনের ক্ষতি সাধন করলে আপনার জেল বা জরিমানা হতে পারে। যেখানে যাবেন পরিবেশের প্রতি খেয়াল রাখবেন যেন নোংরা না হয়।