২০১৮ সালের যথাযথ ভ্রমণ মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। যদিও আজকাল বছরের সব সময়ই তিন বা চার দিনের ছুটি পেলেই আমাদের ভ্রমণের কোনো না কোনো পাগলামি শুরু হয়ে যায়। তবে সেটা সবার জন্য হয়ে ওঠে না। যারা একটু ভবঘুরে, উন্মাদ আর খ্যাপাটে ধরনের তারাই শুধুমাত্র ছুটির ছুতো পেলেই পালিয়ে যায়। কিন্তু পরিবারের সকলকে নিয়ে, একটু বড় একটা গ্রুপ করে দূরের কোনো দুর্লভ গন্তব্যে যেতে চাইলে সবাই মোটামুটি বছরের এই সময়টাকেই বেছে নিয়ে থাকি। এই সময় বলতে বছরের শেষ মাস ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত।
তবে আমি বরাবর অল্প খরচে ঘুরে বেড়ানোর গল্প বলে থাকলেও আজকে একটু ভিন্ন ধরনের গল্প বলতে চাই। আর সেটা হলো ভ্রমণ অবশ্যই যত অল্প খরচে সম্ভব করবেন, কিন্তু যত অল্পই খরচ করতে চান না কেন, তাই বলে শুধুমাত্র সেইটুকু টাকা নিয়েই যেন আবার পরিবার নিয়ে বেরিয়ে না পড়েন সেটা মাথায় রাখবেন। যখন দূরে কোথাও যাবেন, যতই বাজেট ট্রিপ হোক না কেন, নিজের আর অন্য সবার কাছে অবশ্যই পর্যাপ্ত অর্থ রাখবেন, ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে, নইলে পড়তে পারেন মহা বিপদে! কারণ বিপদে পড়লে কেউ আপনাকে সাহায্য করবে না, আরও সেটা যদি হয় টাকা শেষ হয়ে যাওয়ার মতো মহা বিপদ।

কারণ নিজের কাছে যদি প্রয়োজনের চেয়ে বেশী অর্থ থাকে তবে সেটার জন্য অনেক অনেক মানসিক শক্তি পাওয়া যায়। অনেক কিছুই তখন খুব সহজ হয়ে যায় নিজের কাছে। অনেক বিপদকে সহজেই মোকাবেলা করা যায়। যা আপনাকে ভেঙে যাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করবে, পরিবার ও অন্যান্য সদস্যদের জন্য যেটা অনেক বড় একটা প্রশান্তি বয়ে আনবে। যার প্রমাণ আমি, আমার পরিবার আর অন্যান্য সদস্যরা হাতেনাতে পেয়েছিলাম সেবার। সেই গল্পটা একটু সংক্ষেপে বলি।
সেবার আমরা কাশ্মীর থেকে ফিরছিলাম। শ্রীনগর থেকে আমাদের প্লেন ছিল বেলা তিনটায়। যেটা দিল্লী এসে পৌঁছানোর কথা মোটামুটি এক ঘণ্টার মধ্যে। তার মানে চারটায় আমরা দিল্লী পৌঁছে যাবো। দিল্লী থেকে আমাদের ট্রেন সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে। অর্থাৎ চারটায় দিল্লী পৌঁছে স্টেশনে যাবার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের হাতে ৩:৩০ ঘণ্টার লম্বা সময় হাতে আছে। বেশ হেলেদুলে যাওয়া যাবে ভেবে রেখেছি।

কিন্তু শ্রীনগর এয়ারপোর্টে পৌঁছে জানতে পারলাম আমাদের যে প্লেন সেটা এখনো এসে পৌঁছায়নি, আবহাওয়া খারাপ থাকায়। প্রথমে কিছুই মনে হয়নি। প্লেন তো, এসে যাবে। আমরা উঠে বসলেই এক ঘণ্টায় পৌঁছে যাবে। কিন্তু না প্লেন যখন এক ঘণ্টা পরেও এসে পৌছালো না তখন আমাদের টেনশন শুরু হয়ে গেল। কত রকম দুশ্চিন্তা যে ছিল বলে বোঝানো মুশকিল। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা ছিল আমাদের অনেক দাম দিয়ে, প্রায় দুই মাস আগে থেকে দিল্লী থেকে কলকাতার দুরন্ত এক্সপ্রেসের টিকেট কাটা আছে এসি থ্রি টায়ারের।
যদি কোনো কারণে সেটা মিস হয়ে যায় তো সবই গেল! কারণ টাকা পয়সা যা ছিল সেগুলো প্রায় সবই শেষ করে ফেলেছে সবাই। দুঃখ যখন আসে তখন চারপাশ থেকেই আসে, যেটার প্রমাণ সেদিন পেয়েছিলাম। অবশেষে আমাদেরকে পূর্ণ হতাশ করে দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা পরে প্লেন এলো। কিন্তু যেহেতু এর আগে তেমন একটা প্লেনে ওঠা হয়নি তাই জানতাম না যে, প্লেন এলেই সাথে সাথে আবার উড়ে যেতে পারে না। বেশ কিছু রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শেষে আরও প্রায় এক ঘণ্টা পরে প্লেন ছাড়ল! ততক্ষণে আমাদের ট্রেন পাওয়ার আশা পুরোটাই শেষ হয়ে গেছে! আর সেই দুঃখের সাথে আরও যোগ হয়েছিল, দিল্লীর আকাশে গিয়ে প্লেনের আরও ৩০ মিনিট ওড়াউড়ি। বাজে আবহাওয়ার জন্য ল্যান্ড করতে না পারা।

সবকিছু মিলে আমাদের বিভীষিকা শুরু হয়ে গেছে। ট্রেন ছেড়ে গেছে জেনেও শেষ আশা ধরে রেখে স্টেশনে গেলাম, ততক্ষণে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার। সবাই মুষড়ে পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। কেউ ব্যাগের উপরে, কেউ মেঝেতে বসে পড়েছে মাথায় হাত দিয়ে। এখন তিন রকমের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সেদিন রাতে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে, রাতে, পরদিন সকালে, দুপুরে খেতে হবে আর তার চেয়েও বড় ভাবনা আমাদের দিল্লী থেকে কলকাতা যাওয়ার ট্রেনের টিকেট করতে হবে! কিন্তু টাকা? অনেক টাকার ব্যাপার সবকিছু মিলে। কোথা থেকে আসবে এত টাকা? দিল্লীতে তো পরিচিত কেউ নেইও। কলকাতায় হলে তবুও না হয় চেষ্টা করা যেত। কিন্তু এখানে কোথায় আর কীভাবে সেসবের ব্যবস্থা হবে? সবাই এই দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়েছে।
অবশেষে সবাইকে আশ্বস্ত করলাম। দুশ্চিন্তা না করতে বললাম। যার কাছে যা আছে দাও আর আমার কাছে কিছু আছে সেটা দিয়ে ম্যানেজ করা যায় কিনা দেখা যাক। সবাই তাদের কাছে যা যা ছিল সবই দিল। সব মিলিয়ে যা ১০ হাজারের মতো হবে। আর আমার কাছে মোটামুটি পুরো বাজেটের আরও অর্ধেক টাকা রাখা ছিল নিরাপত্তা স্বরূপ। যেটা কাউকে জানাইনি। কয়েকবার কেনাকাটার জন্য ধার চাওয়াতেও আমি দেইনি। কারণ ওটা শুধুমাত্র নিরাপত্তা অর্থ। শুধুমাত্র কোনো বিপদে পড়লে আর সত্যিকারের টাকার দরকার হলেই খরচ যোগ্য। কেনাকাটা বা অতিরিক্ত কোনো খরচের জন্য নয় আদৌ।

শেষ পর্যন্ত সেই নিরাপত্তা অর্থের কারণে, খুব বড় কোনো সমস্যায় না পড়ে পরিবার নিয়ে পথে পথে না ঘুরে,না খেয়ে না থেকে। ভালো হোটেলে, ভালো খেয়ে, পরদিনের জন্য ভালো ট্রেনের দামী টিকেট কিনে, সারাদিন দিল্লী ঘুরে, কলকাতায় ফিরে এসেছিলাম আর তারপরে ঢাকায়। উফ, আর হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। সেদিন সবাই শিখে গিয়েছিল যে ভ্রমণে নিরাপত্তা অর্থের গুরুত্ব কতখানি আর কেন? আর কেনই বা সেই অর্থ অন্য কোনো খাতে খরচ করা উচিৎ নয়? প্রয়োজন নাহলে সেই টাকা ফেরত আসবে, কিন্তু কোনো ফালতু খরচ বা কেনাকাটার জন্য কিছুতেই সেই টাকা খরচ করা যাবে না।