কলকাতা, আমাদের বাংলাদেশিদের জন্য কেনাকাটার এক অনন্য নাম। আমরা যারা বাংলাদেশ থেকে নানা সময়, নানা কারণে কলকাতায় যাই, আর যে যে কারণেই কলকাতায় যাই না কেন ফিরে আসার সময় কিছু না কিছু কেনাকাটা যেন অনিবার্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
হোক সেটা দরকারি বা অল্প দরকারি বা বেশি দরকারি। কিছু কেনাকাটা না করে কলকাতা থেকে ফেরা মানেই যেন একটা ভীষণ অপূর্ণতা! আর এই নগন্য ইচ্ছা বা প্রয়োজনীয়তাকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়েই গড়মিল করে ফেলি আমাদের অনেকে বা অধিকাংশই। তাই এই লেখাটা কলকাতায় গিয়ে কেনাকাটায় আমরা যে গড়মিলগুলো করে ফেলে শেষে টাকা-পয়সার হিসেবের তালগোল পাকিয়ে ফেলি সেসব নিয়ে।

প্রথমে আমরা যেটা করি টাকা বা ডলার এক্সচেঞ্জ করে যদি ধারণার চেয়ে মাত্র ১০/২০ পয়সা বেশি পেয়ে যাই তাতেই খুশিতে বেহিসেবি হয়ে যাই! ধীরে ধীরে যে খুশির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে কেনাকাটা আর হিসেবের খাতায়। অথচ আমরা খুব কম জনই ভেবে দেখি যে, ১০ বা ২০ পয়সা বেশি পাওয়া মানে খুব বেশি কিছু পাওয়া নয়। ১০০ টাকায় ১০ বা ২০ টাকা মাত্র।
এরপর মনের আনন্দে, বেজায় খুশিতে নাচতে নাচতে যাই শপিং নামের বেহিসেবি কাজে বা আমার মতে অধিকাংশই অকাজে! কারণ আমি খুব কমই দেখেছি যে আমার পরিচিত বাংলাদেশিদের যারা সত্যিই খুব খুব দরকারি কিছু কেনাকাটা করছি। এই ক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে তুলনামূলক বেশ কম ভুল করে থাকে। আমি খুব খুব মনোযোগ দিয়ে দেখেছি মেয়েরা কী কী ভুল করে।

দল বেঁধে গিয়ে ৫/১০ রুপি করে মাথার ব্যান্ড, চুলের ক্লিপ, চিরুনি, কারচুপির এটা সেটা, টিপ, চুড়ি-ফিতা, ছোট ছোট কম দামি হাত ব্যাগ কিনে কিনে যখন দুই হাত আর নিজের কাছের ব্যাগ ভরে যায় তখন এরা সেসব বইবার জন্য ফুটপাথ থেকে একটা কম দামি বস্তা টাইপ ব্যাগ কিনে সেসব রাখে আর সামনের দিকে এগোতে থাকে। তার মানে এই নয় যে তার এসব কম দামি কেনাকাটা শেষ হয়ে গেছে!
উঁহু, তা মোটেই নয় কিন্তু। কারণ দেখা যায়, যতই সামনে আগায় ততই একই জিনিসের নানা রকম রঙ দেখে গলে গিয়ে অনেকগুলো কিনে ফেলে শুধুমাত্র দাম কম বলে। অথচ কেউ একবারও ভেবে দেখে না এই জিনিসগুলো আমাদের এখানেও সমান সমান দামেই পাওয়া যেত। ব্যাগ, রিকসা বা কার ভাড়ার হিসেব আর রুপির সাথে টাকার এক্সচেঞ্জ রেট মিলিয়ে দেখলে।

তো এসব কেনাকাটা করতে করতে যখন তারা আসল কেনাকাটার দোকানে যায় তখন দেখতে পায়, যা বাজেট ছিল তার অনেকটাই ফালতু কেনাকাটায় চলে গেছে, শুধু কম দামের লোভে পড়ে! তবুও সাধের কেনাকাটা কি আর শেষ হয়? হয় না। এ নেশা মাদক নেশার মতো, কখনো সহজে ছেড়ে যায় না, যেতে পারে না। এ নেশাকে নিজের কাছে নিজেকেই পরাজিত করতে হয়। এটা নিজের সাথে নিজের মেডিটেশনের মতো একটা ব্যাপার।
এরপর কসমেটিক্সের দোকানে গিয়ে তো পাগলের মতো হয়ে যায়! কী নেবে? আর কী নেবে না? সেই দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পরে এমন বিমর্ষ হয়ে যায় যে চতুর সেলস গার্লগুলো তাদেরকে পেয়ে বসে। তারপর এমনভাবে একটার পর একটা কসমেটিকস দেখাতে শুরু করে যে অচিরেই সে নিজেকে নিজের মাঝ থেকে হারিয়ে ফেলে কখন যে ১০/১৫ হাজার রুপির কসমেটিকস কিনে ফেলেছে বুঝতেই পারে না! এরপর সবগুলো কসমেটিকসের দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে থাকে, কোনটা নেবে আর কেনটা বাদ দেবে সেই আক্ষেপ নিয়ে।

অবশেষে খুব বেশি কিছু বাদ দিতে পারে না মেয়েদের কোমলমতি মন আর চোখের লোভাতুর জ্বালাতন! তাই একটু কষ্ট করে হলেও দুই একটা জিনিস দারুণ অনিচ্ছায় বাদ দিলেও, মন আনচান করতে থাকে সবকিছু কিনতে না পারার বেদনায়! টাকা পে করে বাইরে এসে নিজের ব্যাগের পরিণতি দেখে নিজেই আবার ভেঙে পরে নিজের কাছেই! ইশ, ইশ, ইশ জুতা যে কেনা হলো না! এটাই তো সবচেয়ে বেশি দরকারি ছিল! তারপর থ্রি পিস আর দুই একটা শাড়ি তো রয়েছেই কেনাকাটার তালিকায়! সেসবের কী হবে এখন?
তবুও নিজের আক্ষেপ ঢাকতে, সেসবও কেনা হয়, অল্প সল্প, আর সাধ্যের মধ্যে থেকে। সেই সাথে নিজেই নিজেকে অভিসম্পাত করতে থাকে আগেই দরকারি আর আসল কেনাকাটাগুলো শেষ না করে, কেন শুরুতেই একগাদা ফালতু কেনাকাটা করে টাকাগুলো শেষ করে ফেলাতে!

অবশেষে, মনের মতো আর আসল কেনাকাটা করতে না পারার আজন্ম আক্ষেপ নিয়ে হোটেলের পথ ধরে বিরস বদনে। মন খারাপ করে, বারে বারে শাড়ি, জামা আর জুতার দোকানগুলোর দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে তাকিয়ে।
তাই বলি কী? আগেই অল্প দামের, কম দরকারি আর ফালতু কেনাকাটা করে টাকা শেষ না করে, আগে যেটা দরকারি আর সত্যি সত্যি কাজের সেসব কিনে নিয়ে তারপর টাকা বেচে থাকলে নাহয় ওসবের দিকে যাওয়া যাবে?

তাতে করে মন খারাপ হলেও কম হবে, আক্ষেপ কিছু জাগলেও সেটা নিজেকে কম পোড়াবে, হতাশা একটু হলেও সেটা নিজেকে খুব বেশি কষ্ট দেবে না। কিন্তু কাজের আর দরকারি জিনিসগুলো ঠিক ঠিক কেনা হয়ে যাবে আর সেই আনন্দে নিজের কলকাতা ভ্রমণ বেশ আনন্দময় স্মৃতি হয়েই রইবে। নইলে কি হয় আর হতে পারে সে নিশ্চয়ই বুঝতেই পারছেন?