বায়েজিদ বোস্তামির নাম শোনেনি এমন লোক পাওয়া কঠিন। কথিত আছে, একদা বায়েজিদ বোস্তামির মা অসুস্থ ছিলেন। এমন অবস্থায় এক রাতে অসুস্থ মায়ের পানির পিপাসা পায় এবং তিনি বায়েজিদ বোস্তামিকে পানি নিয়ে আসার জন্য আদেশ দেন। বায়েজিদ ঘরে পানি না পেয়ে রাতের অন্ধকারকে উপেক্ষা করে দূরের একটি নদী থেকে পানি নিয়ে আসেন। এসে দেখেন মা শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন। মায়ের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে তিনি পানি হাতে সারা রাত দাড়িয়ে থাকলেন। সকালে যখন মায়ের ঘুম ভাঙল তখন তিনি দেখলেন, তার ছেলে পানি হাতে নিয়ে তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে । এই দৃশ্য দেখে তিনি অত্যধিক খুশি হন এবং নিজের ছেলের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করেন। আল্লাহ মায়ের এই দোয়া কবুল করেন এবং সেই বায়েজিদই মায়ের দোয়ায় পরবর্তীতে ওলি বায়েজিদ বোস্তামি নামে পুরো পৃথিবীতে খ্যাত হলোেন।
এই ঘটনা ইসলামের নৈতিক মূল্যবোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে অনেকেই বলে থাকেন। আর আমি আজ বলব, এই খ্যাতিমান মানুষের মাজারে ভ্রমণের গল্প। এক সময় এই মাজারে ঘুরতে যাওয়াটা কোনো ভ্রমণ হিসেবে দেখতাম না। ঠিক যেমন বাড়ির পাশের ঐতিহাসিক কোনো দীঘিতে স্নান করতে যাওয়াকে কেউ ভ্রমণ বলে না।
বায়েজিদ বোস্তামির মাজার ছিল আমাদের বাসা থেকে পায়ে হাঁটার দূরত্বে। তখন শের-শাহ কলোনিতে আমি আমার পরিবারের সাথে থাকি। আলাদা করে দেখার মতো এখানে তেমন কিছু আছে বলে আমার মনে হতো না। ঠিক যেমন, গরু গোয়ালের কাছের ঘাস খায় না। যখন চট্টগ্রাম ছাড়লাম তখন বার বার এই মাজারের কথা মনে হতো, তাই অনেক দিন ধরে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আর সেই অপেক্ষার প্রহর পেরিয়ে যখন সুযোগ এলো তখন সদ্ব্যবহার করে নিলাম।
মাজারটি মেইন রোডের পাশে হওয়ায় গাড়ি থেকে নামলাম একেবারে মাজারের গেটে। ওখান থেকে ভেতরের দিকে যাচ্ছিলাম আর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বিগত ১০ বছরের পরিবর্তন খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু নাহ! সব কিছু সেই একই রকম। রাস্তার পাশ দিয়ে সেই মোমবাতি, আগরবাতি আর রুটির দোকান একটু এগিয়ে সেই দীঘি যেখানে রয়েছে শত শত বড় বড় কচ্ছপ। আর তাদেরকে রুটি খাওয়াচ্ছে বায়েজিদের ভক্তরা।
আমিও একসময় ঐ পাড়ে দাঁড়িয়ে লাঠির মাথায় রুটি গেঁথে কচ্ছপের জন্য অপেক্ষা করেছি; কখন একটি ক্ষুধার্ত কচ্ছপ আসবে আর আমার হাতের রুটি খেয়ে নেবে। একসময় এই কচ্ছপেরা আমার পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। খাবার দিলেই খাওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ত। কারণ, ওগুলো আমার মা নিজের হাতে বানিয়ে দিতো। মায়ের হাতে এই একটা অসাধারণ গুণ। তার বানানো খাবারে হুমড়ি খেয়ে পড়তেই হয়।
কচ্ছপদের খাইয়ে আমি অনেক আনন্দ পেতাম। তাই আজও কিছু রুটি আর কলা নিয়ে তাদের সামনে ধরলাম কিন্তু আজ আর তাদের তেমন সাড়া নেই। তারা খাবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। শুধু আমার না, কারো খাবারই তেমন খাচ্ছে না। কারণটা স্পষ্ট, চারদিকে কচ্ছপকে খাওয়ানোর জন্য প্রতিযোগিতা চলছে। এই ক’টা কচ্ছপ কয়জনের খাবার খাবে! এখানে মোট কচ্ছপ আছে মোট ১৫০-৩০০টি, কিন্তু মানুষ আছে অনেক।
এই মাজারে এসে প্রত্যেকেই কচ্ছপের জন্য কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখে। বাচ্চারা কেউ কেউ কচ্ছপের সাথে মুখ লুকনোর খেলায় মেতে ওঠে। আবার, খেলা শেষে পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়।
বোস্তামীর এই কচ্ছপগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি অত্যন্ত বিরল এবং চরমভাবে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি। বর্তমানে বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার প্রাঙ্গণ ব্যতীত বিশ্বের আর কোথাও এদের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। মাজারের দেখাশোনার দ্বায়িত্বে থাকা মাজার তত্ত্বাবধায়ক কমিটির লোকদের দ্বারাই এদের প্রতিপালন করা হয়।
দীঘির পাড় ধরে মাজারের দিকে যাওয়ার সময় একটা কচ্ছপ রাস্তার সামনে এসে পড়ল। আপনারা হয়তো ভাবছেন কচ্ছপ পানি ছেড়ে আবার উপরে উঠে আসে নাকি? হ্যাঁ আসে, কচ্ছপ ডিম পাড়ার সময় হলোে পানি ছেড়ে উপরে উঠে আসে। তারপর একজন লোককে দেখলাম কচ্ছপটিকে ট্রলিতে উঠিয়ে নিয়ে গেলো। এখানে হয়ত এদের ডিম পাড়ার জন্য কোনো স্থান নির্দিষ্ট করা আছে। আর লোকটি একে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে।
এগিয়ে গেলাম মাজারের দিকে। এখানে খানিকটা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়; এটি একটি ছোট পাহাড়। পাহাড়ের পাদদেশে এবং দীঘির পাড়ে একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মোঘল রীতির আয়তাকার মসজিদ রয়েছে। স্থাপত্যশৈলী থেকে ধারণা করা হয়, মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। বর্তমানে সামনে দিয়ে আরো নির্মাণ কাজ করে মসজিদটিকে সম্প্রসারণ করা হয়েছে।
উপরে উঠে প্রথমে রয়েছে বায়েজিদ বোস্তামির সমাধিস্থল, যার সামনে বসে মানুষেরা মোনাজাত করছে। বলা হয়, এখানে দাঁড়িয়ে বায়েজিদ বোস্তামি তার আঙ্গুল কেটেছিলেন এবং মাজার স্থাপনের আদেশ দিয়েছিলেন।
আসলে এটি সমাধিস্থল নয় বা মাজার নয়। এটি হলো বায়েজিদ বোস্তামির দরগা যেখানে বসে তিনি এবাদত করতেন। পাহাড়ের চূড়ায় তাঁর দরগার এই অবয়ব সর্বপ্রথম ১৮৮৩ সালে একটি দেয়ালঘেরা আঙ্গিনার মাঝে আবিষ্কার করা হয়। পরবর্তীতে তার আধুনিক রূপ দেওয়া হয়।
পাশ কাটিয়ে সামনে এগোলাম। এখানে রয়েছে কিছু অদ্ভুত গাছ আর এই গাছের গায়ে বাঁধা রয়েছে লাল-হলুদ রঙের হাজারও সুতা। এর মধ্যে হয়তো আমারও একটা আছে। ছোটবেলায় বেঁধেছিলাম, মা বলেছিলেন এখানে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করে সুতা বাঁধলে নাকি ইচ্ছা পূরণ হয়।
এরপর মাজারের অন্যান্য প্রান্ত ঘুরে দেখতে লাগলাম। পাহাড়ের শেষ প্রান্তের দিকে রয়েছে আরও কিছু সমাধি। এগুলও মাজারের খাদেমগণের সমাধি। এছাড়াও এখানে বারো আউলিয়ার আস্তানা শরীফ লেখা আছে। মনে করা হয়, এখানে বসেই তিনি অন্যান্যদের সাথে কথা বলতেন।
কিভাবে যাবেন:
এখানে যেতে হলে আপনাকে প্রথমে চট্টগ্রামে যেতে হবে। চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ এলাকায় অবস্থিত এই মাজার। সুতরাং শহর থেকে খুব সহজেই যেতে পারবেন এই মাজারে।
কোথায় থাকবেন:
চট্টগ্রাম শহরে বেশ কয়েকটি বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। সেখান থেকে আপনার সাধ্য এবং পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো একটি আজই বুক করে নিতে পারেন।
ফিচার ইমেজ: ThePinsta