মেঘালয়ের তৃতীয় দিন ছিল শিলং শহর আর তার আশেপাশের এলাকা ঘোরাঘুরি করার জন্য। সকালে নাস্তা করেই আমরা চলে যাই শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরের উমিয়াম লেকে। মেঘালয়ের অন্যতম জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট এটি। লেকের চারপাশে সুন্দর বসার ব্যবস্থা রয়েছে। এখানে কায়াকিং, স্পিড বোট ও বিভিন্ন ধরনের জলযানের ব্যবস্থাও আছে। আমাদের মধ্যে কয়েকজন বোটে উঠলেন। আর কয়েকজন থেকে গেলেন চারপাশ আরও ভালোভাবে দেখার জন্য। এখানে বাচ্চাদের খেলার জন্যও খেলাধুলা করার প্রয়োজনীয় উপকরণ রয়েছে।
আমি ও আমার এক বন্ধু চলে গেলাম সেখানে। দোলনা দেখে বসার লোভ সামলাতে পারলাম না। বসেই পড়লাম দোলনায়। কিছুক্ষণ পর একজন বললেন এখানে বাচ্চাদের খেলনাগুলোতে বড়রা বসলে ১,২০০ রুপি গচ্চা দিতে হয়! একটু দূরেই সাইনবোর্ডে লেখা ছিল। খেয়ালই করিনি! অতএব দোলনায় বসার এখানেই ইতি ঘটল।

লেকের কাছে প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের মতো সময় কাটাই আমরা। এই বৃষ্টি, এই রোদ, আবার এই মেঘ এরকম করেই চলতে থাকে আমাদের মেঘালয়ের দিন।
এলিফ্যান্ট ফলস (Elephant Falls):
উমিয়াম লেক দেখার পর আমরা চলে যাই শিলং শহরের একদম কাছে এলিফ্যান্ট ফলস দেখতে। এই ঝর্ণাটি তিনটি স্তরে সজ্জিত। উপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামা যায়। এই ঝর্ণাটি দেখে হতাশই হয়েছি বলতে হবে। ঝর্ণাটির জন্য নয়, ঝর্ণাটি মানুষকে দেখানোর জন্য কর্তৃপক্ষ যে কৃত্রিম সুব্যবস্থা করেছেন তার জন্য। এত বেশি লোক দেখানো সুব্যবস্থার কারণে ঝর্ণাটি তার প্রকৃত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারিয়েছে।

আমার মতো যারা আদি অকৃত্রিম প্রকৃতিকে ভালোোবাসেন তারা ঝর্ণাটির কাছে গেলে সেই অনুভূতিটুকু থেকে বঞ্চিত হবেন বলেই আমার ধারণা। সহজলভ্যতার কারণে এখানে প্রচুর জনসমাগম হয়। শেষের দিকে বৃষ্টি নেমে গিয়েছিল। তখন একটু একটু ভালো লাগছিল। একদম শেষ স্তরে একটা পুকুরের মতো জায়গা রয়েছে। সেখানে নামা নিষেধ। রশি দিয়ে বেড় দেয়া হয়েছে জায়গাটিতে।
শিলং গলফ কোর্স (Shillong Golf Course):
এরপর আমরা চলে গেলাম পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর গলফ মাঠে। শিলং এর গলফ মাঠকে পৃথিবীর সেরাদের মধ্যে একটি বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। প্রকৃতিই তাকে নিজ রূপে অনন্য করে সাজিয়ে দিয়েছে। একপাশে পাইনের বন আরেকপাশে অবারিত মাঠ, সব কিছুই যেন ছবির মতো সাজানো গোছানো। এখানে এসে কেউ গলফ খেলল, কেউ বা সবুজের গালিচায় শুয়ে তার স্পর্শ নিল।

এখানে রাস্তার পাশেই একটি ছেলে আইসক্রিম বিক্রি করছিল। তার কাছে থেকে আমি আইসক্রিম কিনি শুধুমাত্র চেখে দেখার জন্য। কেনার সময় সে আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল তার কাছে ময়লা ফেলার ঝুড়ি আছে, খাওয়া শেষে আইসক্রিমের খোসাটি যেন সেখানে ফেলে দিয়ে যাই। আরেকবার মুগ্ধ হয়েছিলাম, আইসক্রিমে নয়, মেঘালয়বাসীর সচেতনতায়। মেঘালয়ে এসে খাবারের সংকটে ভুগেছি। কী একটা পাহাড়ি মসলা ব্যবহার করে ওরা, গলা দিয়ে কয়েকদিন খাবার নামছিলই না। শুকনো খাবার আর চকলেটই ছিল প্রধান ভরসা!

শেষ বিকেলে গলফ মাঠটি আরও বেশি স্নিগ্ধ লাগছিল। আরও কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে চলে গেলাম শিলং শহরে শপিং করার জন্য। শিলংয়ে শপিং করার জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হচ্ছে পুলিশ বাজার। আশেপাশে প্রচুর দোকান রয়েছে। ফুটপাতেও অসংখ্য দোকান। জায়গাটি অনেকটা আমাদের দেশের গুলিস্তানের মতো। এ দোকান ও দোকান ঘুরে ঘুরে সবাই বেশ ভালোই কেনাকাটা করল। কেনাকাটা করতে করতে রাত।
আগেই বলেছি মেঘালয়ে এসে খাবারের কষ্টে পড়েছি। পুলিশ প্লাজার মোড়েই কেএফসি আছে। এখানে ১৪৯ রুপিতে একটা মিল পাওয়া যাচ্ছিল। বলতে গেলে এই খাবারই আমাদের জীবন বাঁচায়। প্রতিদিন ঘোরাঘুরি শেষে রাতে এসে এই খাবার খেতাম আমরা।

খাবার এর তৃপ্তি যে কী জিনিস, এখানে এসে বুঝছি। আপনার চারপাশে অনেক খাবার কিন্তু আপনি খেতে পারছেন না- এরচেয়ে কষ্টকর অবস্থা বোধহয় আর নেই। যাই হোক, কিছু পেতে গেলে কিছু তো দিতেই হয় এই ভেবে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি। যা দেখেছি তার তুলনায় এই কষ্ট কিছুই না! আরও বাকি ছিল দেখার, তাই ভেবে অস্থির ছিলাম।
রাতের খাবার শেষে হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার নেমেছি রাতের অন্ধকারে শিলং শহরকে আবিষ্কার করার জন্য। রাত ৮টায় সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু ফুটপাথের খাবারের দোকানগুলো খোলা থাকে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ঘুরে পরে চা এর দোকান খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। আরেকবার চা-চক্রের আসর জমে গেল। রাতের বেলা অন্য দেশে একঝাঁক বাঙালি নিয়ে চায়ের আসর জমানোর মতো আনন্দ আর কিছুতেই নেই। এ গল্প, সে গল্প করতে করতে দিব্যি সময় কেটে যাচ্ছিল। বলা হয়ে থাকে, ট্যুরের সময় আপনার সাথে যারা ট্যুর দিচ্ছেন তারা যদি সঙ্গী হিসেবে ভালো হয়ে থাকে আপনার ট্যুরের আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে যায়। মেঘালয়ের দিনগুলোতে ঠিক তাই ঘটেছিল। চোখের পলকেই সময় কেটে যাচ্ছিল এই ভালো মনের সঙ্গীদের সাথে। গল্প শেষে আবার চলল রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাঘুরি আর সাথে পরের দিনের পরিকল্পনা।
(চলবে)
ফিচার ইমেজ- নীল তোহা