ভোর রাতে টাইগার হিলে যাওয়ার কথা থাকলেও প্রচণ্ড ক্লান্তি চেপে ধরায় আর যাওয়া হয় না। সেই সাথে ড্রাইভারের ফোন দেওয়ার কথা থাকলেও সে বেচারাও ফোন দেয়নি। ঘুম যখন ভাঙল তখন সকাল ৬টা বাজে। ঐদিন আর টাইগার হিলে যাওয়া হলো না। তখন অবশ্য ভেবেই নিয়েছি আজ আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাবো না। তো এই ভাবনার উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত হলো আজ দার্জেলিংয়ের চারপাশটা ঘুরে দেখবো।
ফ্রেশ হয়ে হোটেল থেকে তৎক্ষণাৎ বের হই। ততক্ষণে ১০টা বাজে। নাস্তা সেরে জীপ ভাড়া করে টি-গার্ডেনের দিকে যাই। তেনজিং রকের একটু আগেই হঠাৎ বিপু’দা চিৎকার করে ওঠে, “কাঞ্চনজঙ্ঘা, কাঞ্চনজঙ্ঘা”। বিপুদার চিৎকার শুনে তক্ষুনি জীপের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি কাঞ্চনজঙ্ঘা।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কিছুক্ষণ। মনে হচ্ছিল একটা ব্যানার কেউ টাঙিয়ে রেখেছে। জীপের সাথে সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘাও এগিয়ে যাচ্ছে তখন বুঝতে পারি এটা আসলে ব্যানারে আঁকা ছবি না, এটা আসলেই কাঞ্চনজঙ্ঘা।

জীপ থেকে নামার বায়না ধরতেই ড্রাইভার বলল, সামনে টি-গার্ডেন, সেখান থেকে আর পরিষ্কার দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। টি-গার্ডেনে নেমেই দেখা পাই তার। অপলক বিস্ময়ে আর অপার মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। প্রথমবারের মতো নিজের চোখে সাদা পাহাড় দেখছি তা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।

বিস্ময়ে ভরা দু’নয়ন নিয়ে তাকিয়ে থাকতেই মনে পড়ে গেল পেছনের গল্পটা। মাস তিনেক আগে আমি, জয়’দা আর সাইমুন এই বছরের ছুটি নিয়ে আলাপ করছিলাম। একসাথে বড় কোনো ছুটি আছে কিনা। আমি আর জয়’দা ক্যালেন্ডার খুঁজে বের করি নভেম্বর মাসের ২১ তারিখের একটা ছুটি আছে, সাথে দুই একদিন ছুটি নিয়ে নিলে বেশ বড়সড় একটা ছুটি হয়ে যায়। তখন পর্যন্ত আমাদের পরিকল্পনা নেই আমরা কোথায় যাবো। হুট করেই পরিকল্পনা হয় ভারত যাবো। ঝামেলা হলো গিয়ে অন্য জায়গায়। আমি, জয়’দা বা সাইমুন কেউই তখনও ভারত যাইনি।
যদি যাওয়া হয় এটা আমাদের প্রথম বিদেশ বিভূঁইয়া ভ্রমণ হবে। জয়’দা বলে উঠল, বিপু’দা একমাত্র লোক যে আমাদের সাহায্য করতে পারে। ভারতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে তাকে অভিজ্ঞ বলা যায়। মুহূর্তের মধ্যে কাছের কিছু বড় ভাই-বোন নিয়ে টিম হয়ে গেল। ১০ জনের টীম রেডি। বিপু’দা হলো আমাদের টীমের ক্যাপ্টেন আর মাজহার ভাই হলো ভাইস ক্যাপ্টেন।
এই টিমের মধ্যে অনেকের পাসপোর্ট নেই। তারমধ্যে অন্যতম হলো আমি, সাইমুন আর মাজহার ভাই। অনেক দৌড়ঝাঁপ করে আমি আর সাইমুন পাসপোর্ট করি। বাকি এখন মাজহার ভাই। তিনি সরকারী কর্মকর্তা হওয়ায় জিও এবং এনওসি বের করতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়।

প্রত্যেক বৃহস্পতিবার পথের পাঁচালিতে (আমার বাসা, ভাইবোনদের অনেকে আবার হেড কোয়াটার বলে) রাত জেগে আগত ভারত ট্যুর নিয়ে ব্যাপক প্ল্যান-প্রোগ্রাম চলে। চা শ্রমিক হিসেবে সাইমুন আর রাতের খাবার খাওয়ানোর জন্য আমি বিখ্যাত হয়ে উঠি রাতারাতি। এভাবেই রোজ আমাদের পরিকল্পনা একটু একটু করে আলোর মুখ দেখে।
দিন যত গড়ায় আমাদের ট্যুর প্ল্যান তত বেশি পরিমার্জিত এবং পরিবর্তিত হতে থাকে। আমি, সাইমুন, জয়’দা, বিপু’দা, মাসুদ ভাই আর সৌরভ ভাই পাসপোর্ট-ভিসা রেডি করে ফেলি। বাকিরা একে একে ঝরে যেতে থাকে। কারও বিয়ে, কেউ বা অফিসিয়াল কাজের জন্য যেতে পারছে না। এরই মাঝে নাছোড়বান্দা মাজহার ভাই অনেক কাহিনী করে পাসপোর্ট করে। আমরা ভেবেছিলাম সে অফিসিয়াল পাসপোর্ট পাবে কিন্তু সে গুড়ে বালি। শেষ সময়ে রেগুলার পাসপোর্ট নিয়ে ভিসার জন্য দৌড়ঝাঁপ করেও কোনো গতি করতে পারেনি।

ট্যুরে যাওয়ার সপ্তাহ দুই আগে বিপু’দা একদিন বলল, পাসপোর্ট যত ডলার এনডর্স করানো হয় সেটা নাকি অনেক সময় পোর্টে দেখতে চায়। আমরা পড়ে গেলাম মহা মুশকিলে। হাভাতের দলের মধ্যে ছিল জয়’দা, সাইমুন আর আমি। ৫ দিনের ট্যুরের খরচ ধরা হয়েছিল ১০০ ডলারের মতো। এইটা জোগাড় করতেই আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। বাকিটা কই পাবো সেইটা চিন্তা করে মাথা ঘুরছিল আমাদের। শেষমেশ আমাদের ত্রাণ কর্তা হিসেবে হাজির হলেন আরেক বড় ভাই অংকুর। তাকে কাঁদো কাঁদো গলায় বলতেই সে রাজি হয়ে গেলেন টাকা দিতে। মাসুদ ভাইয়ের কাছে সে টাকা আমরা জমা রাখি।

নভেম্বরের ২০ তারিখেও মাজহার ভাইয়ের ভিসা পাওয়ার সব রকম চেষ্টা করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। আগে থেকে বাসের টিকিট কাটা ছিল। মাজহার ভাই সহ আমরা ৭ জন কনফার্ম ছিলাম। সে যেতে না পারায় আমাদের সকলেরই মন খারাপ। রাত ৯.৩০টায় কল্যাণপুর থেকে আমাদের বাস। ইন্ডিয়ান এমব্যাসি থেকে রাগে গজগজ করতে করতে বাসায় এসে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি অমায়িক লোকটা (মাজহার ভাই) এখানেও আসছে। নিজে যেতে পারেনি তাতে কী? একগাদা ওষুধপত্র দিয়ে সহায়তা করতে আসছে। তার অমায়িক ভাব দেখে আমার আরও বেশি মন মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
রাত ৯.৪৫ এ বাস ছাড়ে কল্যাণপুর থেকে। একদিকে মাজহার ভাইয়ের জন্য মন খারাপ হচ্ছিল অন্যদিকে প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে উত্তেজনা কাজ করছিল।

সকাল ৭.৩০ এর দিকে পঞ্চগড় শহরে পৌঁছাই। সকালের নাস্তা সেরে লোকাল বাসে করে তেতুলিয়া বাংলাবান্ধার দিকে রওনা দেই। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক লাগে বাংলাবান্ধায় যেতে। পোর্টে গিয়ে ফর্মালিটি শেষ করে জিরো পয়েন্টে ছবি তুলে ভারতের মাটিতে পা রাখি।
***ফিচার ইমেজ সাইমুন ইসলাম
(চলবে)
কারো বিয়ে কারো অফিসের ব্যস্ততা ।আহা আহা।
লেখনিতে এক ধরনের সুখ পাঠ্য ভাব আছে।প্রথা গত নই। আড্ডার ছলে বয়ান
ধন্যবাদ।