প্রথমবার রাজধানী এক্সপ্রেসে উঠি কলকাতা থেকে দিল্লী হয়ে শিমলা-মানালি যাবার সময়। সেটা ২০১৩ সালের শেষে। ওঠার পরের আতিথেয়তা আর মুগ্ধতায় পরে ঠিক করে রেখেছিলাম একদিন না একদিন ছেলে আর ছেলের মাকে এই ট্রেনের রাজসিক ভ্রমণটা দেখাবো। ওদের নিয়ে একবার এই ট্রেনে চড়ার মজাটা উপভোগ করবো সবাই মিলে।
তো সেই পরিকল্পনা থেকেই এবারের কাশ্মীর ভ্রমণের সকল কিছুর মাঝে রাজধানী এক্সপ্রেসের অনুরূপ দুরন্ত এক্সপ্রেসের টিকেটও কেটে রেখেছিলাম, দিল্লীর দিনটা কাজে লাগিয়ে রাতের ট্রেনে উঠবো বলে। কিন্তু ভাগ্যের মুচকি হাসিতে রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনেই যে চড়ব সেটা বুঝতে পারিনি। দুরন্ত ট্রেনে চড়তে চেয়েছিলাম সেটাতে আর চড়া হয়ে ওঠেনি প্লেন দেরি হয়ে যাওয়ায় ট্রেন মিস করাতে। আর ওই যে সেই কবে যেন ঠিক করে রেখেছিলাম মা-ছেলেকে নিয়ে রাজধানী এক্সপ্রেসে উঠবো, উপরওয়ালা সেটা বোধহয় সেদিনই কবুল করে রেখেছিলেন।
তাই তো আগের দিনের ট্রেন মিস, এরপর রাজধানী এক্সপ্রেসেই টিকেট কাটা হলো। তাও থ্রি টায়ারের পরিবর্তে আরও রাজসিক টু টায়ারের। অনেকটা নিরুপায় আর বাধ্য হয়েই। কারণ থ্রি টায়ার আর শেষ দিন অবশিষ্ট ছিল না বলে। টাকা গেছে যাক, ইচ্ছা তো হাতে ধরা দিল, সাথে একদিনের দিল্লী ভ্রমণ, আর বাড়তি আরাম, এই ছিল সান্ত্বনা।
পরদিন নির্ধারিত সময়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে। নিজেদের আসনে গিয়েই সবাই অবাক, এই বিছানার মতো একটি করে সিট, এক এক জনের? আর সবার ভাবনা ছিল ট্রেনের জানালা না যেন আমাদের জানালার মতো হয়, খোলা যাবে না বা ছোট ছোট দেখা যাবে বাইরের সব কিছু এই ভেবে। কিন্তু ট্রেনের জানালা ছিল ঠিক সিটের মতোই রাজসিক আর বিশাল, যেন শুধু কাঁচ দিয়েই ঘেরা সিটের পাশের সবটুকু। দেখা যায় বাইরের সবটুকুই, যতদূর চোখ যায়। বাহ দারুণ তো! ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া যাবে, আবার পর্দাও আছে দেখছি নিজেদের প্রাইভেসির জন্য। একবেলা কম খেয়ে এমন ট্রেনে যাওয়াই ভালো দেখছি।
আরে কী যে বল, এক বেলা কম কেন খাবে, একটু অপেক্ষা কর, এক বেলা কেন, খাবার খেয়ে শেষ করার কোনো সময়ই পাবে না।
আচ্ছা, তাই নাকি?
এই কথা বলতে বলতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। আর ট্রেন ছেড়ে দিতে না দিতেই একটু পরে ওয়েটার তার পসরা নিয়ে হাজির, সবার জন্য একটি করে গরম পানি সমেত ফ্লাক্স, একটি করে ওয়ান টাইম কাপ, ঠিক একবার আর একজনের জন্য চা-চিনি-দুধ সাথে ছোট বিস্কিটের লাঠি! ওই লাঠির মতো বিস্কিট আরকি। আর সবচেয়ে মজার, দারুণ স্বাদের একটা করে লেমন জুস! ওয়াহ, দারুণ মুখরোচক ছিল সেটার অম্ল স্বাদ।
আর জানতে চাইলো রাতে ডিনারে কি ভেজ না নন ভেজ?
সবাই চায়ের সাথে হালকা লাঠি বিস্কিট উপভোগ করতে না করতেই, চলে এলো স্যুপ, স্যান্ডউইচ, সমুচা আর সস, সাথে একটি করে পানির বোতল। এই মাত্র চা খেয়েই এসব ভারি খাবার খেতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল সবার। তার উপর রয়েছে বেশ ভালো ডিনার একটু পরেই। তবুও যে যা পারে একটু করে খেয়ে নিল। ডিনার পরে, বেশ রাতে করবে বলে।
ট্রেন তার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। চলছে দুরন্ত বেগে। সবাই যার যার বিছানায় চাদর-বালিশ পেতে, কম্বল গায়ে চাপিয়ে গল্প করতে লাগলাম আর সেই সাথে কাশ্মীরের তোলা ছবিগুলো দেখতে লাগলাম, এক সাথে। ছবি দেখতে দেখতে রাত ৯টা বেজে গেল। ট্রেন চলছে ট্রেনের মতো করে নন স্টপ। আর গতি? বাইরে চোখ দিলে কিছুই দেখা যায় না, কোনো শহরের চিহ্নও নেই। এমনকি কোনো প্ল্যাটফর্ম যখন ক্রস করে সেটা যেন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, চোখের পলকেই।
এরই মাঝে ডিনার চলে এলো ট্রেতে করে। র্যাপিং করা বাসমতী চালের সুগন্ধি ভাত, দুটি ছোট রুটি বা পরাটা, ডাল, মুরগির মাংস, সালাদ, পানি একদম একজনের জন্য আদর্শ খাদ্য। কম তো নয়ই, আবার একদম বেশিও নয়। কীভাবে যে ওরা মাপটা বোঝে ভেবে দেখার মতো।
ধীরে ধীরে সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আরাম করে গা-টা এলিয়ে দিতেই চলে এলো মজার, ঠাণ্ডা আমুলের দারুণ স্বাদের আইসক্রিম! সবাই একটি করে, কিন্তু আমাদের ছটুর জন্য দুটিই দিল, ওর হিন্দিতে মুগ্ধ হয়ে! সবাই মিলে আয়েশ করে আইসক্রিম উপভোগ করে, আবারো গল্পে জমে গেলাম। তবে এবারের গল্প রাজধানী এক্সপ্রেসের রাজসিক আপ্যায়ন আর সেবা পাওয়ার। এরপর যে যার মতো করে একটা আরামের ঘুম দিলাম। হিমহিম ঠাণ্ডা এসির মধ্যে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমের একটা অন্যরকম মজা আছে।
সকালে ঘুম ভাঙল ট্রেনের সার্ভিস স্টাফের ডাকে। চায়ের ফ্লাক্স, কাপ, বিস্কিট, মাখন, চিনিসহ ট্রে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাহ, সকাল সকাল এমন আপ্যায়নে তো আমি ছাড়া সবাই আরও বেশি বেশি মুগ্ধ! চায়ের সাথে ছোট ছোট বাটার আর চিনির প্যাকেট দেখে ওদের খরচের তারিফ না করে কেউ পারলো না। কী অনন্য উপায়ে মানুষের মানসিকতা মেপে ওরা খাবার দিয়েছে, যে কেউ বেশি চাইবেও না আবার কেউ নষ্টও করতে পারবে না, এমন একটা পরিমাণ।
চা শেষ হবার প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে চলে এলো সকালের বিলাসি নাস্তা। টোস্ট, জেলি, মাখন, দুটো করে ডিম আর জুস! এক সকালে আর কী চাই? এসব খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতেই জানতে পারলাম আর মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা পৌঁছে যাবো কলকাতায়। সেই কথা শুনে আমার ছেলে আর তার মায়ের ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল!
কেন বাবা, মানুষ তো তার গন্তব্যে চলে এলে আনন্দিত হয়, তবে তোরা কেন মন খারাপ করছিস? ওরা মন খারাপ করেছে কারণ ওরা এত তাড়াতাড়ি এই রাজসিক রাজধানী এক্সপ্রেস থেকে নেমে যেতে চায় না। ওরা এত এতটাই মজা পেয়েছে আর উপভোগ করেছে রাজধানী এক্সপ্রেসের বিলাশ বহুল লম্বা যাত্রাটা। কিন্তু ওদের কাছে নাকি এটা খুবই সংক্ষিপ্ত যাত্রা মনে হয়েছে! কেন জার্নিটা আরও লম্বা হলো না সেই আফসোস করছে মা আর ছেলে দুজনেই! ওদের আনন্দ, উচ্ছ্বাস আর আফসোস দেখে আমার দারুণ তৃপ্তি হয়েছে।
এরপর ট্রেন কলকাতার আরও কাছাকাছি চলে আসার পরে মা আর ছেলে ঘোষণা দিল। এরপর আবার ভারতে বেড়াতে এলে, প্লেনে আর কখনো নয়। সব সময় এমন ট্রেনে যেন নিয়ে যাই বা আসি। যেন ট্রেন জার্নিটা আরও বেশ লম্বা সময়ের হয়, এমন দূরের কোনো জায়গায় নিয়ে যাই! দারুণ লেগেছে ওদের এই তৃপ্তি আর পরবর্তী আকাঙ্ক্ষার কথা জেনে।
ফিচার ইমেজ- st.indiarailinfo.com
রাজসিক রাজধানী এক্সপ্রেসের কথকতা

Loading...
ভারতের দূরপাল্লার ট্রেন ভ্রমণ সত্যিই অসাধারণ। মাইসোর এক্সপ্রেসে কলকাতা থেকে ব্যাঙ্গালোর পর্যন্ত ১৯২০ কিলোমিটার আর ৩৪ ঘন্টা কখনো ভোলার নয়। যদিও রাজধানী বা দূরন্ত’র মতো এতো সুবিধা পাইনি। সীটও ছিলো এসি থ্রি টায়ার। তারপরও প্রতিবেশী এই দেশ আর ট্রেন যেন একে অন্যের পরিপূরক। ভারত ভ্রমণে ট্রেন সবসময়ই প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকবে।