২০১০ সাল থেকে আমাদের তিন বছরের লালিত স্বপ্ন ছিল, শিমলা-মানালি যাবো এবং সেটা দিল্লী থেকে জীপে করে শিমলা আর তারপর শিমলা থেকে মানালি। রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনে কলকাতা থেকে দিল্লী পৌঁছাতে সকাল ১১টা বেজে গেল। দিল্লী থেকে অনেক দেরি হয়েছিল জীপ ছাড়তে, রুট পারমিট সংক্রান্ত কালক্ষেপণে। চণ্ডীগড় ছাড়িয়ে হিমালয়ান হাইওয়েতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যার আঁধার চারদিকে। যতদূর চোখে যায় সুন্দরী পাহাড়দের মন ব্যাকুলতার অপেক্ষায়! নিচু থেকে উঁচু, আর উঁচু থেকে আরও উঁচুতে। এঁকেবেঁকে, হেলেদুলে, ঢেউ খেলে পাহাড় উঠে গেছে আকাশের কাছাকাছি যেন।
মন একটু খারাপই হলো, প্রেয়সীদের সঠিক সঙ্গটা পাবো না বলে। কিন্তু আমরা কী জানতাম যে আমাদের জন্য অপার বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছে পাহাড়ি চাঁদ, কোটি-কোটি আলোকবর্তিকা! পাহাড়ের গায়ে-গায়ে এ এক অপার আনন্দ, বিষম বিস্ময়, মোহাচ্ছন্ন মন, ব্যাকুল হৃদয়ের সকল সুখের পসরা সাজানো সাজ নিয়ে!
হ্যাঁ তাই, কারো যদি রাতে বাই রোডে শিমলা যাবার অভিজ্ঞতা থেকে থাকে সে বা তারা মাত্রই জানেন, সে মহিমা। কেমন মোহাচ্ছন্নতায় মাখা! সবাই বেজায় খুশি, আনন্দে ডগমগ, এই পার্থিবতায় অপার্থিব সৌন্দর্য পেয়ে। এক-একটা পাহাড়ের বাঁকে, এক-এক রকম আলোকছটা। এক-এক উচ্চতায়, এক-এক রঙের বর্ণিলতা! কাছের পাহাড়ে ঝলমলে আলো আর দূর পাহাড়ে রাতের রংধনু! এই গল্পটা শুধুই মুগ্ধতার, নেই এক বালুকণা খেদ।
মুগ্ধতায়, মুগ্ধতায় মোহাচ্ছন্ন অবস্থায় আমরা পৌঁঁছে গেলাম আমাদের তিন বছরের লালিত স্বপ্নের শিমলায়! সবাই ভীষণ উত্তেজিত আনন্দের বেদনায়! দারুণ উচ্ছ্বসিত সবার স্বপ্নের নীলিমায়। যে কারণে -৫ ঠাণ্ডায়ও কারো কোনো কষ্ট বা কাতরতা নেই! রাতে দারুণ একটা ডিনার শেষে ভালো ঘুম হলো।
ভোরবেলায় ভেঙে গেল ঘুম। এবার বিস্ময় আরও সীমাহীন, যা রাতে বুঝতেই পারিনি কুয়াশায়-মেঘে আর বর্ণিল আলোকছটায়! আমরা একটি মাঝারি পাহাড়ের ঠিক চূড়ায়। যার নিচে এক অসাধারণ মেঘময়, ধোঁয়া ওঠা লেক! আর চারপাশটা পাহাড় দিয়ে ঘেরা! বড়-বড় পাহাড়, ওপারে কী আছে বা নেই কিছুই দেখা বা বোঝা যায় না। শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলেই দেখা মেলে মাথার সিঁথির মতো আঁকাবাঁকা মসৃণ পীচ ঢালা পথের। যা প্রতিটি পাহাড়ের গায়ে-গায়ে লেপ্টে আছে। পাহাড়কে জড়িয়ে ধরেছে পরম আদর ও মমতায়। যেন একজন ছাড়া অন্যজন অবলম্বনহীন, অসাড় ও অবোধ।
সেসব মুগ্ধতাকে ছাড়িয়েও যে মুগ্ধতা আমাদেরকেই অসাড় করেছিল তা ছিল শিমলা থেকে মানালি যাবার রাস্তা, শুধু রাস্তাটাই!
মানালি যাওয়ার সকাল। আমাদের কেউ একজন ভেবেছিল শিমলা থেকে মানালি ৮০ কিমি বা এর আশেপাশে। আমরা সেটাই ধরে নিয়েছিলাম। যদিও রুট প্ল্যান করাই ছিল, তবুও অতি আনন্দে মনে ছিল না। যাই হোক, সবাই গাড়িতে উঠে বসলাম। ভাবলাম, ৮০ কিমি? কতক্ষণই বা লাগবে? এই ২ বা ২:৩০ ঘণ্টা। তারপর সারাদিন মানালির বরফে শুয়ে-বসে কাটাব। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম, কত সময় লাগবে? উনি বললেন ৬-৭ ঘণ্টা। কেন? কারণ প্রায় ২৫০ কিমি পথ!
সবাই বেশ অবাক এবং খুশি। কিছুটা বিস্মিতও আমাদের চিন্তা ও বাস্তবতার বিস্তর ব্যবধান দেখে। শুরু হলো এক স্বপ্নিল রাস্তায় এক স্বপ্নিল যাত্রার। যেখানে আনন্দ, অভিভূত হওয়া, প্রকৃতির বিস্ময় পাহাড়, তাদের এক-এক সময় এক-এক রূপের ঝলক আর রাস্তার মসৃণতায় আমাদের মোহাচ্ছন্নতা! আকাশ এত নীল। এর আগে কখনও দেখিনি। নীলের মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করবে যে কারোর। পাহাড়ের এত-এত বৈচিত্র্য আগে কখন চোখে পড়েনি। পাহাড়ি ঢলের এমন বীভৎস সুন্দর রূপ হতে পারে? কল্পনাতেও আসেনি কখনো!
সবুজ যে এতটাই সবুজ, না দেখলে বোঝানো মুশকিল। এমন আঁকাবাঁকা, সর্পিল কিন্তু এতটুকু খাঁদ বা উচু-নিচু নেই মখমলের মতো মসৃণ রাস্তায়। যেখানে সারাদিনেও একবারের জন্যও এতটুকু ঝাঁকি লাগেনি। হাইওয়ে, তাও আবার পাহাড়ের মাঝে? কল্পনাতীত! এমন একটা মিনিট পর্যন্ত পাইনি যে কোনো বাঁক বা উত্থান-পতন নেই! একবার ডানে তো একবার বায়ে, এই উঁচুতে উঠছে তো এই নিচে নামছে।
আর বিলাসপুর, সুন্দরনগরে যেখানে খাওয়া-দাওয়া করেছি, সে তো পার্থিবতা পেরিয়ে! উঁচু পাহাড়ের খাদে অবস্থিত ধাবা। নিচে বিশাল বিয়াস-প্রমত্ত-পরাক্রমশালী-প্রখর-প্রাচুর্যতায় ও পূর্ণতায়! অন্য পাশে আবার পাহাড়, এবার বরফে মোড়া, পাইনে সুশোভিত, আপেলের পত্রহীন বৃক্ষের ব্যাঞ্জণ। ছোট-ছোট এক-একটা কটেজ যেন জোড়া চড়ুইয়ের অবসরের সীমাহীন আবেগের আবাস! যা শুধু দেখে-থেকে-ছুঁয়েই উপভোগ করার জন্য। লিখে বা বলে বর্ণনা করার সাধ্য-সীমার অনেক-অনেক বাইরের!
আর আমার মতো পাগল ভ্রমণ বিলাসীর স্বল্পবোধের শব্দে বর্ণনার অসাধ্য রাস্তা পেরুতে লাগলাম। এভাবে আবেগে-আনন্দে-আশ্চর্যের বিহ্বলতায় ভেসে-ভেসে স্বপ্ন পথের শেষে আরও একটা স্বপ্নের স্বপ্নিল শহর, মানালির কাছাকাছি পৌঁঁছে গেলাম।
জীবনে এই প্রথম সবাই সমস্বরে, সত্যিকার ভাবেই, মনের আকুল আবেগ দিয়ে গেয়ে উঠেছিলাম-
এই পথ কেন যে শেষ হয়…
বসে বসে দিন গোনা, মিথ্যের জাল বোনা…

যেভাবে এই পথের মাধুর্য উপভোগ করা যায়:
ঢাকা থেকে কলকাতা বাস, ট্রেন বা প্লেন। দিল্লী থেকেই মূলত বাই রোডেই প্রশস্ত রাস্তায় পথের আনন্দ শুরু হয়, হাইওয়েতে দ্রুতগামী বাহনের ছুটে চলার সাথে সাথে। চার ঘণ্টা চলার পরে চণ্ডীগড় ছাড়ার পরেই হিমালয়ান হাইওয়েতে শুরু হয় আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের দুর্ধর্ষ রোমাঞ্চকর যাত্রা। ৪/৬/৮ জনের গ্রুপ করে দিল্লী থেকে জীপ বা নিজেদের গাড়ি রিজার্ভ করে যাওয়াই সবচেয়ে উপভোগ্য। কারণ তাতে করে যেখানে ভালো লাগে সেখানেই নেমে বিশ্রাম বা স্মৃতি ধরে রাখা যায় ইচ্ছামতো, বাসে যেটা সম্ভব হয় না।
ফিচার ইমেজ- লেখক