সন্ধ্যার দিকে মল চত্বর বেশ রমরমা হয়ে ওঠে। রাস্তার পাশ জুড়ে বাহারি রকমের স্ট্রীট ফুডের পশরা বসে। মোমো, নুডুলস চিকেন হরেক রকম স্ট্রীট ফুডের সমাহার। ভারতে মোমোর বেশ সুখ্যাতি আছে। তাই এই সুযোগে ভেজ এবং নন ভেজ দুধরনের মোমোই চেখে দেখি। খেতে বেশ ভালো। তবে ভেজের থেকে নন-ভেজ মোমো বেশি সুস্বাদু।

কাশ্মীরি শাল কেনার ইচ্ছা ছিল আমার। সেই জন্য বেশ কয়েকটা দোকানেও যায়। সাধ এবং সাধ্য এক করতে পারলাম না। তাই মল চত্বর ঘুরে দেখে চলে গেলাম রাতের খাবার খেতে। রাতের খাবার শেষ করে বাইরে বেশিক্ষণ ঘোরাঘুরি না করে সোজা চলে যাই রুমে। কেননা ভোর ভোর টাইগার হিল যেতে হবে। সেই প্রস্তুতি স্বরূপ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে।

বিপু’দার এলার্মে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন রাত ৩টা বাজে। সবাইকে ডেকে তুলে ফ্রেশ হয়ে নেই। জীপ ড্রাইভার ৪টার দিকে হোটেলে চলে আসে। সবাই রেডি হয়ে এলে টাইগার হিলের দিকে রওনা দেই। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছিলাম আমি। শীতের সব কাপড় পরেও ঠাণ্ডাকে আটকান যাচ্ছে না। আকাশ জুড়ে হাজার নক্ষত্রের মেলা তখন। আর রাস্তার দু’পাশে রাত প্রহরী হয়ে পাহারা দিচ্ছে পাইন গাছের সারি।
৩০ থেকে ৪৫ মিনিটের মধ্যে দিয়ে পৌঁছে যাই টাইগার হিলের কাছেই। টাইগার হিল থেকে বেশ খানিকটা দূরে নামিয়েছে আমাদের। ফেরার সময় গাড়ি ঘুরাতে বেশ সমস্যা না হয় সেই জন্য। যেখানে নামিয়েছে সেখান থেকে টাইগার হিল পায়ে হাঁটা পথে ১৫ মিনিট হবে। টাইগার হিলের যখন খুব কাছে চলে এসেছি তখন মাসুদ ভাই আবিষ্কার করল তার পকেটে ফোন নেই। খুব সম্ভবত গাড়ির আশেপাশে বা গাড়িতে পড়েছে। খাড়া পথ বেয়ে মাসুদ ভাই আর জয়’দা নেমে গেল। ভাগ্য পক্ষে থাকায় ফোন পাওয়া গেল। ড্রাইভার সাহেবের হাতেই পড়েছে। তাই রক্ষা। অক্ষত ফোন নিয়ে ফিরে আসলে সবাই মিলে একসাথে টাইগার হিলে উঠি।

ঐ মুহূর্তে টাইগার হিলে মানুষের সৃষ্ট জন-জ্যাম হয়েছে। কোনোরকম এক কোণে জায়গা করেনি সবাই। বলে রাখা ভালো, টাইগার হিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জেলিং শহরে অবস্থিত। এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য দার্জেলিং হিমালয়ের রেলওয়ের উচ্চতম ঘুম স্টেশনের সর্বোচ্চ স্থান। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যায়। কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়াও আরও বেশ কিছু পর্বত পরিষ্কার দেখা যায়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা দার্জেলিং শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান টাইগার হিল। সূর্যোদয় দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে এই পয়েন্টে। টাইগার হিল সমতল থেকে প্রায় দশ হাজার ফুট উপরে অবস্থিত। আর দার্জেলিং শহর থেকে ১০ থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।

হিমশীতল হাওয়ার ভেতরে টাইগার হিলে দাঁড়িয়ে থাকাটা একটা বড় রকম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় আমার জন্য। হাড়ের মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডা লাগছিল। হিম মেশানো বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্য দিয়ে অপেক্ষা করছি অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে কীভাবে আলোর রেখা ফুটে উঠে তা দেখার জন্য। এক পাশে চাঁদের মোহনীয় আলো আরেক পাশে কাঞ্চনজঙ্ঘা; এ যেন প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাখেলা!

একটু উষ্ণতার আশায় এক কাপ কফি খাই। এরই মাঝে একটু একটু পূব আকাশে সূয্যি মামা উঠি উঠি করছে। অন্যপাশে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সূয্যি মামার রঙের সাথে ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। পুরো টাইগার হিলের সমবেত লোক একসাথে চিৎকার করে উঠল এই দৃশ্য দেখে।
সফেদ সাদা মেঘের আস্তরণ ঘিরে আছে দার্জেলিং শহরকে। সেই মুহূর্তে সূর্যোদয়ের দৃশ্য প্রাণ ভরে অবলোকন করে সবাই। সূর্য দেবতাকে প্রণাম জানিয়ে প্রচণ্ড হিম শীতল বাতাসের কথা ঐ মুহূর্তে ভুলে যায় সবাই। পূর্বদিকে লাল আভা যত বাড়তে থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা তত বেশি সোনালী রং ধারণ করে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে প্রকৃতির এই অপরূপ দৃশ্য যেন সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে।

সাইমুন আর বিপুদার হাত জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। টাইগার হিল যাওয়ার পর থেকে সাইমুন একটার পর একটা ক্লিক ক্লিক করেই যাচ্ছে। অন্যদিকে, বিপু’দা নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘণ্টা দুই ধরে টাইম ল্যাপস নিচ্ছে। এরপর দেখা গেল তাদের হাত আর হাত নেই। ওরা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ফ্রেম বন্দীতে ব্যস্ত থাকলেও আমি নয়ন ভরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে নিয়েছি। কী অপরূপই না দেখতে!

সূর্যের আলোয় চারিধার ঝলমল করছে। টাইগার হিলে ৩০-৪০ রুপির বিনিময়ে দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে হিমালয় পর্বত দেখা যায়। রাতের অন্ধকার এবং অধিক মানুষ থাকায় টাইগার হিল ভালো করে দেখতে পারিনি। ভোরের আলো ফোটার পর খেয়াল করলাম টাইগার হিলের চূড়ায় আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিং আছে।
সম্ভবত এখানে বসে সূর্যোদয় দেখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আরও এক কাপ কফি খেয়ে গ্রুপ ছবি তুলে ধীরে ধীরে নামতে থাকি টাইগার হিল থেকে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর সারি সারি পাইন গাছের মধ্যে দিয়ে জীপ এগিয়ে যেতে থাকে। আর জীপের সাথে সাথে কাঞ্চনজঙ্ঘাও এগিয়ে যাচ্ছে।

রুমে গিয়ে গোসল সেরে ব্যাগপত্র গুছিয়ে হোটেল চেক আউট করে বেরিয়ে পড়ি। আগে আগে ঘুম থেকে উঠলে ক্ষুধাও লাগে আগে। পেট তখন রাক্ষস হয়ে আছে। দ্রুত পায়ে ইসলামিয়া হোটেলে গিয়ে সকালের নাস্তা শেষ করে। মাসুদ ভাই আর বিপু’দা যায় জীপ ঠিক করতে। আমাদের এবারে গন্তব্য কালিম্পং হয়ে রিশপ।
*** ফিচার ইমেজ- সাইমুন ইসলাম
(চলবে)