ভারতের খুব প্রসিদ্ধ শহর দিল্লি। দিল্লির নাম কানে পৌঁছায়নি এমন মানুষ পাওয়া ভার। আর দিল্লি থেকে মাত্র ৩০০ কিলোমিটার দূরের আগ্রার নাম শোনাটাও কেউ এড়িয়ে যেতে পারবেন না। আগ্রা হলো দুর্গের শহর। সেই বৈরি ধূ ধূ মরুভূমির গরম উত্তাপে এক ঝাঁক ভালোবাসার বীজ বুনেছিলেন তৎকালীন মুঘল সম্রাট শাহজাহান তাঁর স্ত্রী মমতাজের জন্য তাজমহল বানিয়ে। ১৬৩২ সালে শুরু করা এই তাজমহলের নকশাকারী ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত স্থাপত্যবিদ উস্তাদ আহমেদ লাহাউরি। তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রায় ২০,০০০ শ্রমিক প্রতিনিয়ত কাজ করে ঠিক ১১ বছর পর এর নির্মাণ কাজ শেষ করে। তাজমহলকে তার নিজের সৌন্দর্যে পৌঁছানোর জন্য আরো ১০ বছর নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখা হয়। অবশেষে ১৬৫৩ সালে যমুনা নদীর দক্ষিণ পাড়ে গড়ে ওঠা ৪২ একরের বিশাল এই স্থাপত্যকর্মের নির্মাণ কাজ শেষ হয়।
ছোটবেলা থেকে ভারত যাবার নাম শুনলেই তাজমহল যেতে ইচ্ছে করতো খুব। একবার না একবার যেতেই হবে এমন মনে হতো। ছোটবেলায় এক আত্মীয়ের তাজের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা ছবি দেখে পাক্কা পাঁচ মিনিট হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম। আইভরি সাদা মারবেলের এই স্থাপত্যের নেশা লেগে থাকতো চোখে-মুখে। একটু বড় হওয়ার পর বেমালুম ভুলে গেলাম। পড়াশোনা থেকে একটু মুক্তি পেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে। ঘুরতে শুরু করলাম এদিক সেদিক, যেদিকে ইচ্ছে। ভারত যাবার পায়তারা করছিলাম বছরখানেক আগ থেকে। ভিসা-পাসপোর্টের সাথে তিনজন সঙ্গীও জুটলো। গন্তব্য কলকাতা, শিমলা, মানালি আর আগ্রার তাজমহল।
কলকাতা, শিমলা, মানালি ঘুরে আমাদের ট্যুর ছিল প্রায় শেষের পথে। মানালি থেকে রাতের বাসে রওনা দিই দিল্লির উদ্দেশ্যে। রাতে ১৫ রুপি দিয়ে কিনে নিয়েছিলাম এক কেজি মানলির আপেল, ওখানটায় আপেলের চাষ বেশ জমজমাট। আপেল খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়লাম একটু রাত বাড়তেই। সকালে উঠে দেখি বাসের গতি মন্থর, দাঁড়িয়ে আছে কোনো এক হায়দ্রাবাদি রেস্টুরেন্টের সামনে। হাতমুখ ধুয়ে চলে এলাম বাসে। দিল্লি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঘড়ি আর আমাদের উভয়েরই বারোটা বাজলো।
দিল্লি থেকে দুই উপায়ে আগ্রা যাওয়া যায়। নিউ দিল্লি রেলস্টেশন থেকে প্রতি আধঘণ্টা পর পরই আগ্রার উদ্দেশ্যে ট্রেন ছেড়ে যায়। ট্রেনের ভাড়া ১০০ থেকে ১৩০ রুপি, সময় লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। কেউ যদি বাংলাদেশ থেকে সরাসরি আগ্রায় আসতে চায় তবে বেনাপোল দিয়ে ঢুকে কালকা বা রাজধানী এক্সপ্রেসে সরাসরি আগ্রা স্টেশনে নামতে পারবে। ভাড়া পড়বে কালকায় সম্ভবত ৪৫০ রুপি, রাজধানীতে ভাড়া বেশি পড়বে। সময় লাগবে ২২ থেকে ২৪ ঘণ্টা। আবার দিল্লি থেকে বাই রোডেও আগ্রা যাওয়া যায়। একই সময় লাগে তবে ভাড়া অত্যধিক বেশি, প্রায় ৬,০০০ রুপির মতো পড়বে।
দিল্লি নেমে বুঝতে পারছিলাম না আগ্রা যাবো কিনা। কারণ এত বড় একটা ট্যুর শেষে শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। টিম মেম্বার দীপ সেন নাছোড়বান্দা। সে যাবেই তাজমহলে। আমাদেরও ইচ্ছে যে একদম ছিল না, তা বললে ভুল হবে। অতঃপর উবারে করে নিউ দিল্লি রেলস্টেশনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলো। উবারে করে যাচ্ছি, ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম এখান থেকে আগ্রা যাবার কোনো বাস নেই? ড্রাইভার একটু বয়স্ক আর দেখতে বেশ বড়লোক একটা ভাব আছে চেহারায়। হিন্দিতে বললো “গাড়ি সে চ্যালে যাও না, আব তো ট্রেন ভি নেহি মিলেগা!” আমরা বললাম, গাড়ি পাবো কই? তিনি বললেন, “যাবেন নাকি? আমার গাড়িতে চলে যান!” ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস করায় উনি বললেন, অনেক আগে ৩,০০০ রুপিতে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং নিয়ে এসেছিলেন ট্যুরিস্টদের। আমরা তো বিশাল খুশি। যাক ৬০০ রুপি, তবুও এসিতে আরাম করে তিন ঘণ্টায় যাবো আর আসবো। রাজী হয়ে গেলাম। উনি নিজেও আসলে প্রকৃত ভাড়াটা জানতেন না।
আমাদের ড্রাইভার পরিবর্তন হলো, সেই ভদ্রলোকের ছোটভাই নিয়ে যাবে আমাদের আগ্রায়। আমাদের চেয়ে ১০ বছরের বড় হবে এখনকার ড্রাইভার। নাম সুরাজ। তাজ এক্সপ্রেস ওয়ে দিয়ে যাবে গাড়ি। এক্সপ্রেস ওয়ে এমনি এক রাস্তা যেখানে ১০০ কিমি প্রতি ঘণ্টার নিচে কোনো গাড়ি চলে না, নেই কোনো থামার ব্যবস্থা। গাড়ি ছুটে চললো আমাদের, পাশের গাড়িগুলোর আপেক্ষিক গতির কারণে বুঝতেই পারছিলাম গাড়ি ১১০ কিমি/ঘণ্টায় ছুটছে। খুলনা থেকে ঢাকার দূরত্ব হলো দিল্লি থেকে আগ্রার দূরত্ব। কিন্তু মাত্র ৩ ঘণ্টায় আমরা পৌঁছে গেলাম আগ্রায়, তাজমহলের এরিয়াতে আসতে বিকেল চারটা বেজে গেল।
গাড়িখানা পার্ক করে সবাই ড্রেস পরিবর্তন করে পাঞ্জাবী পরে নিলাম, তাজমহল বলে কথা। তাজের মূল ফটকের রাস্তা ধরে দশ মিনিট হাঁটতে লাগলাম। মূল ফটকে গিয়ে শুনি যেখানে গাড়ি পার্ক করেছি সেখান থেকে টিকেট কিনে নিয়ে আসতে হবে। আবার দৌড়ালাম টিকেট কিনতে। তাজের টিকেট কাউন্টারে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ! ভারতীয়দের জন্য তাজের টিকেট মাত্র ৩০ রুপি আর সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য ৫৩০ রুপি। যে দেশগুলো সার্কভুক্ত নয় তাদের জন্য ১,০০০ রুপি। ভারতীয় বলে টিকেট নেওয়ার একটা চেষ্টা করলাম, দেখলাম কোনো লাভ নেই।
টিকেট কেনার সময় পাসপোর্ট বা আধার কার্ড চেক করে তারা। সুতরাং ৫৩০ রুপি দিয়েই কিনতে হলো তাজের প্রতিটি ফরেনার টিকেট। সেদিন আবার পূর্ণিমা ছিল। পূর্ণিমার রাতে তাজমহল বন্ধ করা হয় না। সাধারণত ৫টায় বন্ধ হয়ে যাওয়া তাজ সেরাতে খোলা থাকে রাত ১০টা পর্যন্ত। পূর্ণিমায় তাজমহলের অপরূপতা উপভোগ করার জন্যই এই ব্যবস্থা। টিকেট কেনার পর কাউন্টার থেকে পানির বোতল, জুতার ক্যাপ দিলো। মূল ফটকে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভিড় দেখে হতাশ আমরা, এত ভিড়ের মাঝে তাজমহলের ভেতরে তো দূরে থাক, দূর থেকেই দেখতে পাবো বলে মনে হচ্ছিল না। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ জিজ্ঞেস করলো, “ইন্ডিয়ান হো ক্যায়া?” আমরা মাথা নাড়ালাম, বললাম ফরেনার।
হুট করেই সব পরিবর্তন হয়ে গেল। একটা ফাঁকা পথ দিয়ে আমাদের চারজনকে পাঠিয়ে দেয়া হলো, কারণ আমরা ফরেনার। পাচঁ মিনিটের ব্যবধানে ঢুকে পড়লাম মূল কমপ্লেক্সে। চোখের সামনে বিকেলের আভায় জ্বলজ্বল করছিল বিশ্বের অন্যতম সুন্দর নির্দশন তাজমহল। তাজমহলে সেদিন এত ভিড় ছিল যে এক পুলিশ কে বলতে শুনেছিলাম, তার ডিউটির এতগুলো বছরে বিকেল বেলায় সে এত ভিড় আগে কখনো দেখেনি। এগুতো লাগলাম ধীরে ধীরে। খুব সুন্দর করে সাজানো বাগান আর বাগানের মাঝখানে কৃত্রিম ছোট জলাধার আর তার মধ্যে তাজের প্রতিচ্ছবি সব মিলিয়ে অসাধারণ লাগছিল। প্রায় ৭৬ মিটার লম্বা বিশাল এই নির্দশনের সামনে দাঁড়িয়ে বা শুধু তাজেরই ছবি তুলছে তাজ দেখতে আসা প্রচুর পর্যটক। আমাদের অবস্থা দেখে মনে হয়েছে একমাত্র আমরাই একা এসেছি, বাকি সবাই বউ নয়তো প্রেমিকা নিয়ে তাজ দর্শন করছে।
উপরে উঠে গেলাম সিঁড়ি ধরে। জায়গায় জায়গায় পুলিশ দাঁড়ানো, ফরেনার বলতেই ভেতরে পাঠিয়ে দিচ্ছে বা পাস করে দিচ্ছে। ভারতীয়রা যেখানে ঢোকার সুযোগই পাচ্ছে না সেখানে মমতাজের কবর ভেতর থেকে দেখে বেরও হয়ে গেছি আমরা ততক্ষণে। তাজের মূল আকর্ষণ আসলে ভেতরে না। বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝলাম টইটই করে না ঘুরে একটু বসি আর পড়ন্ত বিকেলে তাজ থেকে সূর্যাস্ত দেখি।
সত্যি বলতে, এখন পর্যন্ত প্রচুর বাঘা বাঘা জায়গায় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তাজের সূর্যাস্তের কাছে সেগুলো সব হার মেনে যাবে। গম্বুজের ফাঁক গলে লাল অগ্নিকুণ্ড যখন আস্তে আস্তে নেমে যেতে থাকবে তখন জীবনের মানে খুঁজেছিলাম আমি। কেন জানি মনে হয়েছিল প্রতিদিনকার মতো আজকেও সূর্যের মৃত্যু হলো, আমাদেরও হবে। অপার্থিব সেই গোধুলীতে কখন যে হারিয়ে গিয়েছিলাম বুঝতেই পারিনি।
তাজের আরেকটি আকর্ষণ হলো এর কারুকার্য। দেখলে শুধু দেখতে ইচ্ছে করে। কত সুনিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয়েছে বিশ্বনন্দিত এই স্থাপত্য। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামতে শুরু করে। আমাদের আবার সেদিন রাতেই দিল্লি থেকে কলকাতার ট্রেন ছিল। তাই ইচ্ছে থাকলেও পূর্নিমা-বিলাস করতে পারিনি তাজে। আলোর পসরা দিয়ে সাজিয়ে রাখা রাস্তা ধরে চলে আসার সময় বার বার ফিরে তাকাচ্ছিলাম পেছনে, সত্যিই ভাবুক করে তোলে ভালোবাসায় বানানো এই স্থাপনা, জাগিয়ে তোলে সুপ্ত আবেগ আর তাজের প্রতি প্রেম।
ফিচার ইমেজ– twimg.com
গোধূলি বেলায় আগ্রার তাজমহলে একদিন

Loading...