মেঘালয়কে বলা হয় মেঘের নিবাস। মেঘেরা যেখানে নির্দ্বিধায় ভেসে বেড়ায়, সূর্যের হাসি নিয়ে লুকোচুরি খেলা খেলে, কখনো অন্ধকার কখনো আলোর মেলা বসায়, মনে হয় নিজ বসতিতেই বসে সুখ-দুঃখের কথা বলে বেড়াচ্ছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান অঙ্গরাজ্য হচ্ছে মেঘালয়।
মেঘালয়ের প্রতি বরাবরই আলাদা একটা আকর্ষণ ছিল আমার। কবি-সাহিত্যিকদের কাব্য, উপন্যাসে কিংবা সিনেমা অথবা অন্তর্জালের দুনিয়ায় যেভাবে মেঘালয়ের সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে তাতে মেঘালয়কে খুব কাছে থেকে অনুভব করার ইচ্ছা বহুদিন ধরেই ছিল। সময় আর সুযোগ একদিন মিলেই গেল। তাই রওনা হয়ে গেলাম আমার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য।

মেঘালয় যাওয়ার জন্য আপনার ভারতের ডাউকি বর্ডার দিয়ে ভিসা থাকতে হবে। সিলেট শহর থেকে ডাউকি বর্ডার মাত্র ২-২.৩০ ঘণ্টার পথ। অন্য বর্ডারের ভিসা থাকলেও যাওয়া যাবে কিন্তু সেক্ষেত্রে অনেক ঘুরে যেতে হবে আপনাকে।
আমরা ঢাকার আরামবাগ থেকে রাতে সিলেটগামী বাসে উঠে পড়লাম। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। একদম কাকডাকা ভোরেই সিলেট পৌঁছে গেলাম। তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তামাবিল-ডাউকি বর্ডারে যেসব বাস যায় তারই একটাতে উঠে বসলাম। বৃষ্টি তখনও অঝোরে ঝরেই যাচ্ছিল। পথেই এক জায়গায় বাস থামিয়ে প্রায় ভিজে ভিজেই নাস্তা করে নিলাম। সকাল ৭টার দিকেই সিলেটের তামাবিল-ডাউকি বর্ডারে চলে এলাম। বাংলাদেশের এপাশে তামাবিল আর ওপাশে ডাউকি (ভারত অংশের বর্ডারের নাম)।
বাংলাদেশের তামাবিল বর্ডারের অভিজ্ঞতা বেশ তিক্তই বলা যায়। ছোট্ট টিনের ঘর, সেখানেই কাজ চলছিল সিল-ছাপ্পড় মারার। এখানে প্রায় ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষা করতে হয় আমাদের। এরপর সব কার্যক্রম শেষ করে বর্ডার পার হয়ে ডাউকিতে পদচিহ্ন দিয়েই ফেললাম। খুশিতে ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছা হচ্ছিল। ডাউকির এপাশে কাজ শেষ হতে সময় লাগল মাত্র ৩০ মিনিট।
ওখানকার অফিসের সামনেই ট্যুরিস্টদের জন্য বিভিন্ন ধরনের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। দরদাম করে তার একটাতেই উঠে পড়লাম। আপনি যখনই নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাবেন তখনই মনে মনে তুলনা চলে আসবেই। মেঘালয়ে দিন কয়েক থাকার পর আমার যেটা ধারণা হয়েছে সেটা হচ্ছে যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে ট্যুরিজমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান উপায় এর অবকাঠামোগত উন্নয়ন। অবকাঠামোগত উন্নয়ন বলতে কেবল সুন্দর সুন্দর রাস্তাঘাটই বোঝানো হচ্ছে না, কিংবা হাতের নাগালেই সবকিছু পাওয়া বোঝাচ্ছে না। এর অর্থ হচ্ছে সুন্দরের সাথে সুরক্ষার মেলবন্ধন।
মেঘালয়ের রাস্তাঘাট যেমন সুন্দর তেমনি বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটগুলোও বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ওখানকার অধিবাসীরাও সচেতন। সকলের সহযোগিতার ফলেই এই অবকাঠামো উন্নয়ন সম্ভবপর হয়েছে। আমাদের দেশের ট্যুরিজমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবার এই সম্মিলিত পদক্ষেপ কবে চোখে পড়বে এই অপেক্ষায় আছি।
আমাদের মেঘালয়ের এই ট্যুরটি ছিল মূলত ঝর্ণা দেখার ট্যুর। এখানে আনাচে-কানাচে এত এত ঝর্ণা দেখে চোখ পুরো কয়েকদিন ধাঁধিয়ে ছিল! সিলেটে যেসব ঝর্ণা দেখে ‘এত কাছে তবু এত দূরে কেন’ এই ধরনের আক্ষেপ হতো সব এই ক’দিনে ধুয়ে মুছে গিয়েছিল।
প্রথমেই গিয়েছিলাম মাওলিনং গ্রামে, একে এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম বলা হয়ে থাকে। গ্রামের আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে পার্কের কথা মনে হচ্ছিল। একদম সাজানো-গোছানো ছবির মতো গ্রাম। একটু দূরেই ছিল একটি লিভিং রুট ব্রিজ। এই ব্রিজগুলো প্রাকৃতিকভাবে তৈরি। জোরে হাঁটা, একসাথে অনেকজন হাঁটা একদমই নিষেধ। গ্রামেই আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।

উমক্রেম ঝর্ণা (Umkrem Falls) :
ডাউকি বর্ডার থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে এই ঝর্ণার অবস্থান। ঝর্ণাটিকে খুব কাছ থেকে দেখার জন্য ছোট্ট একটি কাঠের সেতু রয়েছে। ওখানে দাঁড়ালেই ছিটে ছিটে পানির কণা খুব সহজেই শরীর মন সব ভিজিয়ে দিয়ে যাবে। ডাউকি থেকে এত কাছে এই বিশাল ঝর্ণা দেখে সবাই আনন্দে মোটামুটি পাগল হয়ে গিয়েছিল।

বপহিল ঝর্ণা ( Bophill Falls) :
উমক্রেম ঝর্ণা দেখা শেষ করে আমরা চললাম বপহিল ঝর্ণা দেখার জন্য। এই দুটি ঝর্ণাই ডাউকি থেকে খুব কাছে। সিলেট থেকে পান্থুমাই দেখে আমরা যে পরিমাণ হা-হুতাশ করে থাকি বপহিল হচ্ছে সেই ঝর্ণা। এখানে এসে আমি যারপরনাই খুশি হয়ে উঠলাম প্রত্যাশার প্রাপ্তিতে। ঝর্ণার বিশালত্বের কাছে নিজেকে আরেকবার ক্ষুদ্র মনে হলো। এই ক্ষুদ্র হওয়াতে কোনো গ্লানি নেই। পানির যে তীব্র গতি এই ঝর্ণায় তাতে এর রঙ দুধ-সাদা বললেও কোনো ক্ষতি নেই।

পরপর দুটি বিশাল ঝর্ণা দেখে মনে তো আনন্দের খই ফুটছিল। এর পরেই বিশাল বিস্ময়ের সম্ভার নিয়ে মেঘালয়ের পথ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল! একপাশে মেঘ, একপাশে পাহাড় আর মাঝে আমাদের গাড়ি। মনে হচ্ছিল মেঘের ভেলায় ভাসছি। আমরা গিয়েছিলাম বর্ষাকালে। একটু পরপরই বৃষ্টি এসে যেন তারই জানান দিয়ে যাচ্ছিল।

পথের দুপাশের এই সৌন্দর্য আমাদের স্বাগতম জানাচ্ছিল সব ধরনের রূপ নিয়ে। যা এখানে দেখলাম, অনুভব করলাম তা ভাষায় প্রকাশ করা এখানে কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিছু কিছু সুন্দর অবর্ণনীয়, এখানে এসে তা বুঝতে পারছিলাম। এরপরে শিলং শহরে রাতে প্রবেশ। পুলিশ বাজার এর একদম কাছেই ছিল আমাদের হোটেল। টুরিস্টদের জন্য এটি অতি পরিচিত একটি জায়গা।
(চলবে)
ফিচার ইমেজ- অনুপমা দেবনাথ