পাবনা মূল শহরে বসে আছি। বৃষ্টিতে কোথাও নড়তে পারছি না। এত অস্বস্তি লাগছে যে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ঘুরতে এসে বৃষ্টিতে আটকে থাকতে কারই বা ভালো লাগতে পারে!
খানিকক্ষণ পর বৃষ্টিটা একটু কমলো, কিন্তু তখনও পুরোপুরি থামেনি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি লেগেই আছে। ক্যামেরাটা ভালো করে পলিথিনে মুড়ে ব্যাগের তলার দিকে ঢুকিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। রিক্সাওয়ালা, ডাবওয়ালা, দোকানদার কারো কাছেই শুনতে বাদ দিলাম না। সবার কাছে একটি কথাই জানতে চাইলাম, তাড়াশ ভবনটা কোন দিকে!

ইন্টারনেট থেকে একটা আর্টিকেলে পড়েছিলাম, তাড়াশ ভবন পাবনা মূল শহরেই কোথাও আছে, কিন্তু কোথায় সেটা! এত নাম করা একটা স্থাপত্য আর কেউ তার খবর জানে না, ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ অদ্ভুত লাগছিল। তাই আবার জানার চেষ্টা করলাম যে, এর আলাদা কোনো নাম আছে কিনা।
খানিক আগেই আমার ফোনের চার্জটা শেষ হয়ে গেছে। তাই গুগল সার্চ করেও জানার উপায় নেই। আর যেহেতু এখানে আমার কোনো পরিচিত লোক নেই, সেহেতু সেই মাধ্যমটাও বন্ধ। অনেকক্ষণ ধরে মাথা চুলকে একটা বন্ধুর নাম্বার মনে করলাম। তারপর একটা দোকান থেকে তাকে ফোন করে আমার অবস্থাটার কথা জানালাম এবং তার কাছ থেকে সাহায্য চাইলাম। সে সাথে সাথে ইন্টারনেট ঘেঁটে আমাকে জানালো, ওটা স্থানীয়ভাবে ‘রায় বাহাদুর গেট’ নামে পরিচিত।
ফোনটা রেখে দোকানদারকে ‘রায় বাহাদুর গেট’ নামটা বলা মাত্রই তিনি এক নিমেষে চিনে ফেললেন এবং বললেন, এই তো একটু সামনে এগিয়ে যান দেখবেন একটা সিএনজি স্ট্যান্ড আছে, ওটাই রায় বাহাদুর গেট। আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেদিকে এগিয়ে গেলাম।

সিএনজি স্ট্যান্ডে গিয়ে রাস্তার উপর থেকেই চোখে পড়ে একটা বিশাল গেট। আকৃতি এবং ডিজাইন দেখে জমিদারী আমলের বলে মনে হলেও, চাকচিক্য দেখলে মোটেও তা মনে হয় না। সম্ভবত এটি সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। বাংলাদেশে এই ধরনের প্রবেশ তোরণ দুর্লভ বলেই জানি। এতে ৮টি থামের মাঝে অর্ধ বৃত্তাকার খিলান পথ রয়েছে, যা এর নির্মাতার অর্থ-প্রতিপত্তির প্রকাশ ঘটায়।
গেটের ভেতরে ঢুকে পঞ্চাশ পা এগিয়ে গেলেই তাড়াশ ভবন। দ্বিতল বিশিষ্ট এই ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন,পাবনার বিখ্যাত জমিদার বনওয়ারী লাল রায়। এটি গ্রিক স্থাপত্য শৈলীর অন্যতম একটি রীতি ডোরিক অর্ডারে নির্মিত হয়েছিল।
প্রাসাদোপম এই ভবনটির সম্মুখে একটি আকর্ষণীয় দ্বিতল গাড়ি বারান্দা রয়েছে, যা চারটি কোরিনথিয়ান স্তম্ভ দ্বারা নির্মিত হয়েছে। এছাড়া এর অর্ধবৃত্তাকার খিলান পথগুলোর সুষম অবস্থানের কারণেও প্রাসাদটি দেখতে বেশ আকর্ষণীয় লাগে।
আমি যখন ভবনটির বারান্দার উপরে উঠলাম তখন দেখি সেখানে কিছু কাঁথা-বালিশ-মশারি-জামা-কাপড় রাখা। আমি সেগুলো দেখে বিস্মিত হয়ে বারান্দার অপর প্রান্তের দিকে তাকাতেই দেখি, একজন লোক সেখানে বসে কিছু ভাঙারি বস্তায় পোরার কাজ করছে। লোকটি আমাকে ক্যামেরা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সোৎসাহে আমার সাথে কথা বলতে উদ্যত হলেন।

আমি তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে, সে আর তার বাবা প্রায় বিশ বছর ধরে এখানেই থাকে। তার কাছে ভবনটির আগের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইতেই তিনি হতাশার সুরে বলে উঠলেন, ‘এটা আগে আরো ভালো ছিল। এখন দেখেন না, সামনে সিএনজি স্ট্যান্ড হইছে। মানুষ শুধু শুধু ভেতরে এসে বসে থাকে। কেউ কেউ আবার এখানে এসে গাঁজা-টাজাও খায়’।
আমি তার সাথে কথা বলতে বলতে পাশের একটা ভাঙা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে ভেতরের দিকে দেখি, ওখানে ইট সাজিয়ে একটা রান্নার চুলা বানানো আছে। আর তার ভেতরে পোড়া কয়লার চিহ্নও দেখলাম। বুঝতেই পারছিলাম যে, এখানে অনেক মানুষের রান্নাবান্নার কাজ হয়েছে। লোকটির কাছে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম যে, ‘ঘরটিতে কিছু দিন আগেও একটি ক্লাব ছিল। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির পর পুলিশ তা উঠিয়ে দিয়েছে’। আমার ভাবতেই অবাক লাগে যে, এটা ১৯৯৮ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করা হয়, এমন অবস্থায় এখানে ক্লাব কী করে থাকতে পারে!

লোকটির পাশে বসে আমি আরো বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করতে লাগলাম। আর তিনি বেশ উৎসাহের সাথেই আমাকে উত্তর দিতে লাগলেন।
– ‘এখানে কোনো সরকারী কর্মচারী থাকে না?’,
– ‘অন্য সময় থাকে, কিন্তু এখন ঈদ তো তাই সবাই ছুটিতে আছে।
– এখানকার গেটটা কি সব সময়ই খোলা থাকে!
– হ্যাঁ, সব সময়ই।
সবশেষে যখন তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসবো তখন তিনি আমাকে জানালেন, গেট দিয়ে বের হয়ে রাস্তা ক্রস করে সোজা গিয়ে আরও কিছু পুরাতন ভবন আছে। আপনি সেগুলোও ঘুরে দেখতে পারেন। তার কথামতো কিছু দূর হেঁটে যেতেই চোখে পড়ল দুটি ধ্বংস প্রায় ভবন। এগুলো কে নির্মাণ করেছিলেন বা কার সময়কার তা আমি জানি না। এগুলো সম্পর্কে আমি আগে কখনো শুনিনি বা পড়িনি।

আমি ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে তুলতে যখন ভেতরে ঢুকে গেলাম। তখন ফ্লাশ ছাড়া ছবি তোলা যাচ্ছিল না। ভেতরটা একেবারে অন্ধকার। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে গেলেও মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে যেতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় আমি যখন সিঁড়ির পাশে গিয়ে ছবি তুলছিলাম তখন অদ্ভুত একটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দে আমার গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠলো। ভালো করে কান পেতে মনে হলো উপর থেকে দুই পা ওয়ালা কিছু একটা নিচের দিকে নেমে আসছে।
আমার আবার ভয় কম তাই চুপ করে প্রাণী/ভূত/জীনটিকে দেখার অপেক্ষায় সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। এখানে উল্লেখ্য যে, আমি এর কিছুদিন আগেই ভূতের খোঁজে ফরিদপুর ভ্রমণ করে ভূতের দেখা পাইনি তাই আমার সাহসটা স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের থেকে বেশি।

ভূতের গল্প শুনে যাদের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায় তারা যদি এসময় আমার সাথে দাঁড়িয়ে থাকত তাহলে নিশ্চিত ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠত। ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে নেমে আসা প্রাণীটি যখন চোখের সামনে এলো তখন দেখলাম সে আসলে একটা মানুষ, এবং অদ্ভুত চেহারার একটা মানুষ।
আমি তার কাছে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি কে? এই পরিত্যক্ত ভবনের ভেতরে কি করেন?’ সে জবাবে তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘উপরে গিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম’। আমি মাথা চুলকালাম, এমন পরিত্যক্ত ভবনের ভেতরে গিয়ে একজন মানুষ কী করে ঘুমিয়ে থাকতে পারে!
আমি লোকটির যাওয়ার পথ ছেড়ে দিয়ে সোজা উপরে উঠে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি চারদিকে গাঁজা খাওয়ার সরঞ্জাম আর ফেনসিডিলের বোতল ছড়ানো ছিটানো। দৃশ্যটি দেখে আমি নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।