টাঙ্গুয়ার হাওর নিয়ে সবাই লেখে দিনের অভিজ্ঞতার কথা। তার মধ্যে দুয়েক লাইনে রাতের বর্ণনা দিয়েই কর্মসারা। আমার মতে টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রধান সৌন্দর্য রাতে। টেকেরঘাটে যখন সন্ধ্যা নেমেছে, তখন আমরা সারাদিনে ঘোরাঘুরির পর নীলাদ্রি লেকের পাশের টিলায় আয়েশ করে শুয়ে বসে আছি। এখানে কিছু সবুজ ঘাসে মোড়ানো টিলা আছে। ওখানটায় কেউ আয়েশ করে বসে আছে, কেউ বা শুয়েই পড়েছে।
শুয়ে শুয়ে গোধুলীর আকাশের মেঘের ঘটায় ডানাওয়ালা পরী, ঈগল, ঘোড়া ইত্যাদি বিভিন্ন অবয়ব বানাচ্ছে। আমরা পশ্চিম দিকে মুখ করে বসেছিলাম। আর দেখছিলাম, মেঘালয় পাহাড়ের কোলে মেঘকে বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে দেওয়া সূর্যটার অস্তগমন। হঠাৎ ইভা পিছনের দিকে দেখিয়ে বললো, ‘ওই দেখ!’
দেখলাম, পূর্বদিকে বিশাল বড় এক চাঁদ উঠছে। স্বাভাবিক সময় যতটুকু দেখায়, তার চেয়ে অনেক বড়। আমি আগেও দেখেছি, পূর্ণিমার সময়ে যখন পূর্বাকাশে চাঁদ ওঠে, তখন খুব বড় আর লালচে দেখায়। ঠিক মাথার উপর উঠে গেলে অবশ্য আবার ছোট হয়ে যায়। কিন্তু হাওরের চাঁদ মাথার উপরে উঠলো, তখনো যেন বড়ই থেকে গেল। পরদিন আমরা বাসে করে ঢাকায় ফেরার সময়ে দেখেছি, চাঁদটা আর হাওরের চাঁদের মতো বড় দেখাচ্ছে না।

যাক গে, সে ব্যাপারে পরে আসছি। চাঁদটা যখন পূর্বাকাশে পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো, পশ্চিমাকাশে তখনো সূর্য অস্ত যাচ্ছে। পাহাড় সারি, দিগন্ত বিস্তৃত হাওর, নীলাদ্রি লেক, গোধূলিতে পরিষ্কার নীল আকাশে মেঘের খেলা, একই সাথে চাঁদ আর সূর্যের অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা আর কী হতে পারে, খুঁজে পাচ্ছি না।
মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে এরকম দৃশ্য ধারণ করা সম্ভব না জেনেও কিছুটা চেষ্টা করে গেছে শাওন, তাসমি আর ইভা। শাওন পুরো আকাশের একটা প্যানোরমা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। খুব ভালো না হলেও, চাঁদ আর সূর্যকে একই আকাশে ধরা গেছে ছবিটায়।
মুনহালো; সোর্স- es-static.us
পাহাড়ের রাত খুব অন্ধকার হয়। চাঁদের আলো এখনো ছড়িয়ে পড়েনি। তাই অন্ধকার কাটেনি। আমরা অন্ধকারেই মোবাইলের টর্চ জ্বেলে নৌকায় ফিরে গেলাম। নৌকার ছইয়ের ভিতরে ঢুকে কাপড় বদলে, উপরে গিয়ে বসলাম। চাঁদটা তখন আকাশে চড়ছে। ঘাটে আমাদের নৌকার সাথে আরোও অনেকগুলো নৌকা বাঁধা। আমি গুনে দেখেছি, মোট চব্বিশটা নৌকা।
আমরা গিয়েছিলাম ঈদের বেশ কয়েকদিন পর। ফলে তুলনামূলকভাবে ভিড় ছিল কম। কিন্তু গতদিনও নাকি ২০০ নৌকা ছিল এখানে। আশেপাশের নৌকাগুলো জোরে গান ছেড়ে ডিজে পার্টি করছে। তাই আমাদের মাঝিকে বললাম, নৌকা ছেড়ে মাঝখানে কোথাও নিয়ে যেতে। নিয়ে গেল, তবুও তীরের নৌকা থেকে গানের শব্দ কানে লাগছে খুব। লোকে আসলে প্রকৃতি উপভোগ করতে জানে না। এখানে, এই হাওরে এমন পরিবেশে ডিজে পার্টির বদলে স্নিগ্ধ গান বেশি মানায়।

খোলা আকাশের নিচে নৌকার ছইয়ের উপর শুয়ে আকাশ দেখা, জ্যোৎস্না স্নান, আর গিটারের টুংটাং শব্দে মোহিত হওয়া- এর সবটাই উবে যাবে উচ্চ শব্দে। তাই খোলা হাওরে নাও ভাসালাম আমরা। পাহাড়ের ঢালে বিএসএফের ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো জ্বলে উঠলো একটা একটা করে। পাহাড়, আকাশ আর হাওরের সাথে এই হলুদ আলোর সারিও খুব চমৎকারভাবে মানিয়ে গেছে।
খিদে পেয়ে গেছে। মাঝি দুইজন আরেকটু আগেই খিচুড়ি, বেগুনভাজা আর মুরগির ঝোল রেঁধে প্লেট বাটি সহ উপরে দিয়ে গেছেন, প্লেট টেনে খাবার বেড়ে খেতে শুরু করলাম। আমার ঝোল ঝোল খিচুড়ি তেমন পছন্দ না হলেও, গরম গরম খিচুড়ি মুরগি আর বেগুনভাজা দিয়ে খেতে বেশ দারুণ লাগছিল। চাঁদের আলোয় পানির উপরে নৌকায় বসে ভুরিভোজের অভিজ্ঞতাটুকুও জমা হলো।

রাতের প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকনের অনুভূতিটুকু বান্ধবী ইভার ভাষ্যে শোনাই,
“আজকে জোছনার অচেনা অপার্থিব রূপ দেখে আমি তাজ্জব। “মুনহালো” এত বিশাল হয় আগে কখনো দেখিনি। আকাশের প্রতিচ্ছবি পড়ে পানিটাকেই আকাশ মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে আকাশে ভাসছি, ভাসছি স্বপ্নে।
এটুকুই কি শেষ? নাহ। হঠাৎ আকাশ কালো করে মেঘ জমে গেল আর আমার নৌকায় বৃষ্টিবিলাসের শখটাও পূরণ হয়ে গেল। নৌকার সামনে বসে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মনে হচ্ছিল হাওরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা নৌকাটা কোনো অলৌকিক উপায়ে সামনে চলছে। এখন বাতাসে দাঁড়িয়ে কাপড় শুকাতে শুকাতে উকুলেলের সাথে শাওন আর রুদ্রর গলায় গান শুনছি।

আজকের রাতটা আমার জীবনের সেরা রাত! এতসব অনুভূতি আর ভালো লাগা অল্প কথায় উল্লেখ করা সম্ভব না। কাশ্মীরের ডাল লেক কিচ্ছু না এই হাওড়ের কাছে! কিচ্ছু না!
আমাদের ভাগ্য ভালো ছিলো যে, সে রাতে পূর্ণিমার সাথে সাথে “মুন হালো”ও ছিল। সৌর জগতে ঝড় উঠেছিল আর সেই ঝড়ের তাণ্ডবে জেগেছিল রঙের বন্যা। এই অপার্থিব আলো সব জায়গায় দেখা যায় না। তবে কদাচিৎ কখনও দেখা যায়। কয়েক বছর আগে দেখা গিয়েছিল।
গ্রীষ্মের সময় অরোরা দেখা যায় না। দেখা যায় শরৎ এবং বসন্তের সময়। চাঁদের আলোর এই রূপ সম্পর্কে আগে কিছুই জানতাম না। “মুনহালো” নৃত্য দেখতেও দারুণ লাগলো।

অনেকেই হাওরে দিনে এসে দিনেই ফিরে যায়। আমার মতে, হাওরে গিয়ে রাতের সৌন্দর্য না দেখা মানে হাওরের অর্ধেকটা উপভোগ করা। রাতের আকাশের সাথে সাথে, ভোরের মেঘালয় থেকে বঞ্চিত হওয়া, সূর্যোদয় না দেখতে পারা। সব মিলিয়ে ভ্রমণটা আধাখেঁচড়া থেকে যাবে। সকালে ঘুম ভেঙে দেখেছিলাম, আমাদের নৌকা টেকেরঘাট থেকে একটু দূরে ভাসছে।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির সাথে সকালের স্নিগ্ধ বাতাসটা আলতো পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল সারা শরীরে। কিছুক্ষণ পর মাঝি মামা আমাদের অনুমতি নিয়ে তাহিরপুর ফিরতে শুরু করলেন। তবে ফিরতি পথে শর্টকাট রাস্তা ধরা হয় বলে খুব একটা সুন্দর দৃশ্য পাওয়া যায় না। তবে হাওরের মাঝখানে দ্বীপমতোন জায়গায় মানুষের আবাসস্থল দেখা হয়। ফিরতে ফিরতেই ঠিক করেছিলাম, আবার আসবো এই হাওরে।
সতর্কতা:
সাঁতার জানুন আর না জানুন, লাইফ জ্যাকেট অবশ্যই রাখতে হবে। ১৫-১৬ জনের বড় দল হলে খুব কম খরচে ঘুরে আসতে পারবেন। হাওর, লেক ও নদীর পানিতে কোনো প্রকার ময়লা-আবর্জনা ফেলবেন না। প্লাস্টিক/পলিথিন প্রভৃতি নৌকার এক কোনায় জমিয়ে রাখুন। মাঝির দায়িত্বে দেবেন না। মাঝিরা ময়লা হাওরেই ফেলে। ডাঙ্গায় গিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন। ঘুরতে গিয়ে পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
কারণ যতজন হাওরে বেড়াতে যায়, এরা সবাই যদি একটা করে সিগারেটের গোড়াও ফেলে, একসময় এই হাওড়ও ডাস্টবিন হয়ে যাবে। এসব স্থানের প্রাকৃতিক কিংবা সৌন্দর্যের জন্যে ক্ষতিকর এমন কিছু করা থেকে বিরত থাকুন, অন্যদেরকেও উৎসাহিত করুন। যে কোনো পর্যটন স্থান আমাদের সম্পদ, আমাদের দেশের সম্পদ। দেশ আমাদের, দেশের সকল কিছুর প্রতি যত্নবান হবার দায়িত্বও আমাদের।

ট্রলারে রান্নার জন্য বাজার করতে হলে নিজের পছন্দ অনুযায়ী বাজার করুন, মাঝি কিংবা দোকানদারের কথায় কান দেবেন না। রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই ট্রলারে দরজা জানালা বন্ধ করে ঘুমাবেন। দুয়েকটা ট্রলারে চুরির ঘটনা ঘটেছে।
ভ্রমণ খরচ: আমরা মোট আট জন ছিলাম। জনপ্রতি মোট খরচ ৩,০৪৪/- টাকা
বাস ভাড়া 550+550
রাতের খাবার 237
সকালের নাস্তা প্রথমদিন 15 টাকা (তাহিরপুর)
সুনামগঞ্জ-তাহেরপুর লেগুনা ভাড়া 80
দুপুরে খাবার 175
রাতের খাবার 125
মোটরসাইকেল ভাড়া 125
তাহেরপুর – সুনামগঞ্জ লেগুনা ভাড়া 100
দ্বিতীয় দিন নাস্তা- 66 (400÷6)
হাসন রাজার বাড়ি+রিভার ভিউ ঘোরা- 10+20+15+10
দুপুরের খাবার 58 (350÷6)
লাইফ জ্যাকেট 100
নৌকা 6,000÷8 (1,000 টাকার তেল দিতে হয়েছে) =750
ফানুস = 500÷8=68
- খরচ আরো যেভাবে কমাতে পারবেন:
১. যাওয়া আসা দুটোই মামুন পরিবহনে করলে, যাওয়ার সময় ভাড়া পড়বে ৪৫০-৫০০ টাকা, আসার সময় ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৪০০-৪৫০ টাকা
২. খাওয়া দাওয়াতে আমরা ভালোই খরচ করেছি। নৌকায় রান্না করে খেলে খরচ অনেক কম পড়বে।
৩. যে কোনো সরকারি ছুটি বাদে গেলে অনেক কম খরচে এই ট্রলার পেয়ে যাবেন। ২,৫০০-৩,০০০ এর মধ্যেই এই ট্রলারটা পেয়ে যেতাম অফ সিজনে গেলে।

আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
১. কোনো ছুটির মধ্যে গেলে অবশ্যই ট্রলার আগে থেকেই বুক করে যাবেন।
২. হাওরে ঘুরতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছি টয়লেট নিয়ে। নৌকার টয়লেট খুবই ছোট আর নিচু। তবে তাহিরপুর ট্রলার ঘাটেই পাবলিক টয়লেট আছে, মাঝিকে বললে দেখিয়ে দেবে। আবার টেকেরঘাট বাজারের পাশেও টয়লেট এর ব্যবস্থা আছে। টেকেরঘাট বাজারে কোনো দোকানদারকে বললেই দেখিয়ে দেবে।
কয়েকজন মাঝি, লেগুনা ড্রাইভার এবং বাইক ড্রাইভারের নাম আর ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি।
লোকমান মাঝি (সোনালি পরিবহন)
মোবাইল: 01736447984
তার ট্রলারটা ৭-৮ জনের জন্য
পরাণ মাঝি
মোবাইল: 01718168314
এর ট্রলার ২০ জনের, মোটামুটি বড় সাইজের
বনি ইয়ামিন (তাহিরপুরের লেগুনা ড্রাইভার)
মোবাইল: 01997699824
আকতাস (টেকেরঘাটের বাইক ড্রাইভার)
মোবাইল: 01761214673
মহিবুর মাঝি
নাম্বার ০১৭৪২৪৯৫৯৮৯
কীভাবে যাবেন:
ঢাকা সুনামগঞ্জ সরাসরি বাস সার্ভিস আছে। ভাড়া ৫৫০ টাকা করে। যাওয়া আসা মামুন পরিবহনে করলে, যাওয়ার সময় ভাড়া পড়বে ৪৫০-৫০০ টাকা, আসার সময় ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৪০০-৪৫০ টাকা। সুনামগঞ্জ থেকে বাইক বা লেগুনায় তাহিরপুর আসতে হবে। ভাড়া পড়বে ৮০ টাকা। ট্রলার ভাড়া করে টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে টেকেরঘাট। ভাড়া ট্রলারের আকারের উপর নির্ভর করবে।
ফিচার ইমেজ: পাগলের দল