দেশের পর্যটন খাতে এক অনন্য মাত্রা যোগ করেছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বিভাগ সিলেট। কক্সবাজারের পর দেশের বৃহত্তর পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠা সিলেট যেন এক টুকরো সবুজের ময়দান।
চা চাষের জন্য একদম আদর্শ এই জায়গায় গড়ে উঠেছে উপমহাদেশের বৃহত্তম চা বাজারের একটি। সারি সারি চা বাগানের পাশাপাশি এখানে লেক, ঝর্ণা, জিরো পয়েন্ট ইত্যাদির জন্য দর্শনার্থীদের কাছে সবসময়ই আকর্ষণীয় সিলেট।

মাধবপুর লেক
সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক। পাহাড়ে ঘেরা ছোট এই কৃত্রিম লেকটি সিলেটের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। মৌলভীবাজার জেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত মাধবপুর ইউনিয়নের পাত্রখোলা এলাকার এই লেকটি ন্যাশনাল টি কোম্পানির আওতাধীন।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
চা চাষের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় এই সিলেটেই। মূলত এ কারণেই সিলেটে এত বিশাল চা শিল্প গড়ে উঠেছে। কিন্তু পাহাড়ি অঞ্চলে বৃষ্টি বেশি হলেও ঢালু ভূমির কারণে পানির দ্রুত অপসারণ ঘটে। পানির এই ঘাটতি মেটাতে অধিকাংশ বাগান কর্তৃপক্ষ একাধিক জলাধার তৈরি করে। স্থানীয়রা এই কৃত্রিম জলাধারকে ‘ডাম্প’ বলে থাকে।

এরই ধারাবাহিকতায় চায়ের রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গল থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত, মাধবপুর চা বাগান কর্তৃপক্ষ ১৯৬৫ সালে তিনটি টিলায় বাঁধ স্থাপনের মাধ্যমে পানি জমিয়ে রেখে তৈরি করে এই কৃত্রিম লেক। মাধবপুর ইউনিয়নে লেকটির অবস্থান বলে এটি মাধবপুর লেক হিসেবে পরিচিতি পায়।
যেভাবে যাবেন
ঢাকার কমলাপুর, সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল, কল্যাণপুর সহ বিভিন্ন কাউন্টার থেকে শ্যামলী, এনা, ইউনিক, সৌদিয়া ইত্যাদি পরিবহনের বাস সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। তবে চেষ্টা করবেন রাতের সর্বশেষ বাসে উঠে সিলেট যাওয়ার পথে শ্রীমঙ্গল নেমে যেতে। ভাড়া ৩৮০-৪০০ টাকা (ননএসি)।
ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকার কমলাপুর থেকে সিলেটগামী উপবন এক্সপ্রেসে (বুধবার বন্ধ) রাত ৯ঃ৫০-এ রওনা দিতে হবে। এক্ষেত্রে আলো ফোটার বেশ আগেই আপনাকে শ্রীমঙ্গল নামিয়ে দেবে। তাই স্টেশনে ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

শ্রীমঙ্গল থেকে মাধবপুর চা বাগান পর্যন্ত লোকাল কিংবা রিজার্ভ সিএনজি চলাচল করে। বেশি মানুষ হলে জীপ গাড়িও নিতে পারেন। রিজার্ভ সিএনজি ভাড়া ৫০০-৬০০ টাকা। লোকাল সিএনজি করে যেতে হলে প্রথমে শ্রীমঙ্গল থেকে ভানুগাছ যেতে হবে। ভাড়া ২৫ টাকা প্রতিজন। ভানুগাছ থেকে মাধবপুর বাজার সিএনজি ভাড়া ২০ টাকা। মাধবপুর বাজার থেকে সামান্য হাঁটলেই পৌঁছে যাবেন কাঙ্ক্ষিত মাধবপুর চা বাগানের মূল ফটকে।
এখানে বলে রাখি, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কটিতে যেতে যেতে দুইপাশে বিশাল চা বাগান চোখে পড়বে। দৃষ্টিনন্দন সেই দৃশ্য সত্যিই খুব চমকপ্রদ। উঁচুনিচু পাহাড়ি টিলায় সবুজের অকৃত্রিম ঢেউ খেলানো দৃশ্য দেখে মুহূর্তেই মন প্রাণ জুড়িয়ে যাবে।

প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মাধবপুর লেক পরিদর্শনের জন্য সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। নিরাপত্তার খাতিরেই সন্ধ্যার পর সেখানে কোনো দর্শনার্থীদের থাকতে দেয়া হয় না।
গেট দিয়ে ৫-৭ মিনিট হাঁটলেই চোখে পড়বে রাস্তার দুপাশে বিশাল চা বাগান। সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে একটু উপরে উঠলেই দেখতে পাওয়া যায় মাধবপুর লেকের অনাবিল সৌন্দর্য।
আমরা পথে এক পিচ্চিকে পেয়ে যাই, যে আমাদের গাইড হিসেবে সম্পূর্ণ লেকটি ঘুরিয়ে দেখায়। লেকের পাড় ঘেঁষে কর্তৃপক্ষ সরু হাঁটার রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে। পাহাড়ি আকাঁবাকা পথে সে রাস্তায় হেঁটে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করা অনুভূতি সত্যিই আকাশ ছোঁয়া।

পানি প্রবাহের কোনো জায়গা না থাকায় আর আশেপাশে উঁচু টিলা থাকায় লেকটির পানি একদম স্থির। প্রায় ৫০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত লেকটির প্রস্থ স্থানভেদে ৫০ থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত।
এই লেকের পানিতে দেখা যায় বিলুপ্ত প্রায় নীল পদ্ম ও বেগুনী শাপলা। বিপন্ন এই প্রজাতির পদ্ম আর শাপলা তোলাতে কর্তৃপক্ষের কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
মাধবপুর লেকের ঝলমলে স্থির পানি, পানিতে ভেসে থাকা রঙবেরঙের পদ্ম আর শাপলা, চারপাশে পাখির কিচিরমিচির প্রতিধ্বনি, আশাপাশে পাহাড়ের গায়ে চা বাগানের সবুজের সমারোহ, সব মিলিয়ে প্রকৃতি এখানে এক অদ্ভুত মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে।

এখানে লেকের পাড়ে উঁচু উঁচু গাছগাছালিতে ঘুরে বেড়াতে দেখতে পাওয়া যায় বানর ও হনুমানদের। লেকের জলে দেখা মিলে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস, পানকৌড়ি সহ অনেক জলজ প্রাণীর। শীতকালে লেকের সৌন্দর্য আরও হাজার গুণে বাড়াতেই যেন এখানে এসে বাসা বাঁধে হাজারো অতিথি পাখি। তবে মাধবপুর লেকে নৌকা ভ্রমণের কোনো ব্যবস্থা চোখে পড়েনি।
মাধবপুর লেকের সৌন্দর্য অবলোকের পাশাপাশি ঘুরে আসতে পারেন মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ। আরও আছে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঝর্ণা হামহাম। সাথে শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের অপার্থিব রূপ আপনাকে স্বাগতম জানিয়ে যাবে প্রথম থেকে শেষ অবধি।

চায়ের স্বর্গরাজ্য শ্রীমঙ্গলসহ মাধবপুর লেকের পুরো এলাকাটাই অনেক সাজানো গোছানো এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে বেশ হিমশিম খেতে হয়।
তাই এ ব্যাপারে জনসচেতনতার বিকল্প কোনো পন্থা নেই। যেকোনো ধরনের প্লাস্টিকের আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলুন। লেকের জলে কোনো ধরনের পচনশীল কিংবা অপচনশীল আবর্জনা ফেলবেন না। হ্যাপী ট্র্যাভেলিং।
Feature Image: শত্রুঘ্ন অর্পিত