যে সময়ের কথা বলছি সেটা আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগের কথা, ২০১৫ সালের অক্টোবর মাস। সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি, ২০১৫ এর এপ্রিল থেকে ক্লাস শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের উন্মাদনা আর যা ভেবেছিলাম তা না পাওয়ার হতাশায় প্রথম সেমিস্টার কেটে যাচ্ছিল নিজের নিয়মে। যথাসময়ে ফাইনাল পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে আসলো। বন্ধু এবং রুমমেট হাসিব প্রস্তাব দিল সেমিস্টারের ব্রেকের ছুটিতে সিলেট থেকে ঘুরে আসার। হাসিবের চাচাতো ভাইয়ের বাসা শ্রীমঙ্গলেই, পল্লী বিদ্যুতের পাশে। তখনো ঘুরতে যাওয়াটা নেশা হয়ে দাঁড়ায়নি, ট্যুরের হাতেখড়ি বলা চলে। বন্ধু বললো টাকা পয়সা নিয়ে কোনো চিন্তা না করতে, সব তার ভাই ব্যবস্থা করবেন।
আজ থেকে তিন বছর আগে কেউ নেট ঘেটে ঘুরতে যেতো না, অত তথ্যও সহজলভ্য ছিল না। নিজের ডিপার্টমেন্টের বেশ কয়েকজন আগ্রহ দেখাল ট্যুরটা নিয়ে, তাই ঠিক করলাম পরীক্ষা দিয়েই দৌড় দেব সিলেট আর শ্রীমঙ্গল পানে। একসময় পরীক্ষা শুরু হলো, দেখতে দেখতে শেষও হয়ে গেল। আমরা আট জন রওনা হয়ে গেলাম শ্রীমঙ্গলের দিকে। সিলেট আমি এর আগেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি, তবে আত্মীয়ের বাসা থাকায় ভ্রমণ স্থান তেমন ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এর আগে জাফলং দেখে আসলেও দেখা হয়নি অধিকাংশ ভ্রমণস্থান। এবার সব দেখার আশায় ছুটে চললাম জলের দেশ সিলেটে।
আমরা রাতে খুলনা থেকে রওনা দিয়ে ঢাকায় পরদিন সকালটা থেকে দুপুরের বাসে রওনা দিলাম হানিফ পরিবহনে আরামবাগ বাসস্ট্যাণ্ড থেকে, তখন ভাড়া নিয়েছিল ৩৮০ টাকা। এখন ভাড়া ৪০০ টাকা। রাত আটটার আগেই আমরা শ্রীমঙ্গল পৌঁছে যাই। শ্রীমঙ্গলে আমাদের থাকার জায়গা হলো হাসিবের চাচাতো ভাইয়ের বাসায়। বাসার উপর তলাটা যেন আমাদের অপেক্ষায়ই ছিল, সুন্দর বারান্দার সাথে দুটো রুম আর রুমের সাথে বাথরুম। সব মিলিয়ে খুব পছন্দ হলো আমাদের বাসাটি।
চাচাতো ভাইয়ের বিভিন্ন ব্যবসা, সেই ব্যবসার কাজে ১০ জন বসা যায় এমন একটা পিক-আপ আছে বাসায়। ভাই বললো আমরা যতদিন এখানে আছি, যে জায়গায়ই ঘুরতে চাই না কেন সমস্যা নেই। এই পিক-আপ আর একজন ড্রাইভার আমাদের সাথে থাকবে প্রতিদিন। ব্যস সকাল সকাল উঠেই এই কথা শুনে মনটাই ভালো হয়ে গেল। প্রথমেই আমরা শ্রীমঙ্গল দেখে নিতে চাইলাম। তাই নাস্তা করে সবার পছন্দ অনুযায়ী রওনা দিলাম মাধবকুণ্ডের পথে।
যারা ঢাকা থেকে আসবেন, শ্রীমঙ্গল রেল স্টেশন থেকে চৌমুহনী বাজার এসে পড়বেন প্রথমে। চৌমুহনী বাজার থেকে মাধবকুণ্ড যাওয়ার সরাসরি বাস বা সিএনজি পাওয়া যায় না, যেতে হলে রিজার্ভ নিতে হবে, ভাড়া পড়বে ৫০০-৭০০ টাকার মতো। তাই বাজেট ট্যুরে খরচ বাঁচাতে হলে যেতে হবে ভেঙে ভেঙে। প্রথমেই চৌমুহনী বাজার থেকে বড়লেখাগামী সিএনজি বা বাসে চলে যেতে হবে কাঁঠালতলী বাজারে, ভাড়া ৫০-৬০ টাকা। কাঁঠালতলী বাজার থেকে মাধবকুণ্ড যাওয়ার সরাসরি সিএনজি পাওয়া যাবে, ভাড়া ২০-৩০ টাকার মতো। তবে উভয় ক্ষেত্রেই সিএনজি না পেলে ভাড়ার পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে।
আমরা যেহেতু নিজস্ব পিক-আপ নিয়ে রওনা হয়েছি তাই আমাদের অত চিন্তা ছিল না। মাঝপথে একবার তেল ভরে নিয়েছি পিক-আপে, পিক-আপখানা অনেকটা বান্দরবানের চান্দের গাড়ির ছোট সংস্করণ মাত্র। উপরে ছাউনি সহ দাঁড়িয়ে যাত্রা উপভোগ করার সুযোগ সবই আছে পিক-আপটিতে। শ্রীমঙ্গলের শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্য হলো এর বিশাল বিশাল সব চায়ের বাগান। রাস্তায় গাড়ির চাকা যতই গড়াচ্ছিল ততই সবুজতার পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছিল। চা বাগানের বিশাল প্রান্তর জুড়ে সৌন্দর্যের লীলা দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম মাধবকুণ্ডের দিকে।
মাধবকুণ্ড যেতে যেতে দুপুর হয়ে গেল। ১০ টাকার টিকেট কেটে ঢুকে পড়লাম মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক। প্রায় ১ কিলোমিটার পায়ে হাঁটার পর চোখের সামনে সৌন্দর্যের ভাণ্ডার উন্মোচিত হলো মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের মাধ্যমে। তখন প্রচুর সুন্দর ছিল জলপ্রপাতটি। এখন নাকি জলপ্রপাতে যাওয়ার রাস্তায় টাইলস লাগিয়ে সৌন্দর্য বর্ধন করতে গিয়ে সৌন্দর্য কমিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে তিন বছর আগের মাধবকুণ্ড বেশ সুন্দর ছিল বলতেই হবে। যদিও যাওয়ার রাস্তাটিতে পানি জমে একটু পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল, আমরা আশেপাশের কলকল শব্দে বয়ে যাওয়া মাধবকুণ্ডের জলধারা দেখে বেশ মুগ্ধই হয়েছিলাম বটে।
যখন হেঁটে মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের কাছে পৌঁছাই তখন একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম ঝর্ণাটির দিকে। এই ভ্রমণ-জীবনে আমার দেখা প্রথম ঝর্ণা মাধবকুণ্ড ঝর্ণা। প্রায় ১৬৮ ফুট উঁচু এই ঝর্ণার জলধারা প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়ছে নিজস্ব নিয়মে। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেলাম সবাই, প্রস্তুতি নিলাম ঝর্ণার একদম কাছাকাছি চলে যাবো। কিন্তু কথায় আছে অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায়। মাধবকুণ্ডের কর্তৃপক্ষ তখনকার দিনে দুপুরের পরে কোনো পর্যটককে ঝর্ণার কাছে যেতে দিত না। আমরা যাওয়ার ঠিক একটু আগেই সকল পর্যটকদের সরিয়ে আনা হয়েছে ঝর্ণার কাছ থেকে। শেষে আর নামতে পারিনি মাধবকুণ্ডের পানিতে। প্রচুর পর্যটক ছিল সেদিন মাধবকুণ্ডে, এত পর্যটকের ভিড়ে পানিতে নামার ইচ্ছে এমনিতেই অর্ধেক চলে গিয়েছিল, আর বাকি অর্ধেক কর্তৃপক্ষ জোর করে কেড়ে নিলো।
তখনকার দিনে আমাদের দামী ফোন বা ডিএসএলআর ছিল না, একটা ডিজিটাল ক্যামেরা আর একটা হ্যাণ্ডিক্যামই ছিল সহায়সম্বল। সেগুলো দিয়েই কয়েকটা ছবি তোলার চেষ্টা করলাম, তবে ক্যামেরা না থাকলে এক অন্যরকম ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়। ছবি তোলার কোনো চিন্তা নেই, শুধু দুই চোখ ভরে ইচ্ছেমতো চারপাশের দুর্দান্ত সৌন্দর্যের অফুরন্ত ধারা উপভোগ করা যায়। সিলেট ঘুরতে এলে এখানে আসা যায়, ১,০০০ টাকার মধ্যে খুব কম খরচে একদিনের ভ্রমণ হয়ে যাবে। আমরা একটু বিকেল পড়লে মাধবকুণ্ড থেকে ফেরার পথ ধরি। আগামী ২ দিন সিলেটেই আছি, পরিকল্পনা রাতারগুল আর হামহামে যাওয়ার। কোনটাতে যাবো পরদিন সকালেই না হয় বলবো, সেই গল্প থাকছে পরের লেখাগুলোতে। ভ্রমণ হোক সুন্দর আর উচ্ছল।
ফিচার ইমেজ- সৌনক চাকমা
সিলেট ভ্রমণের ইতিবৃত্তান্ত: প্রথম দেখায় শ্রীমঙ্গলের মাধবকুণ্ড

Loading...