চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল। ছবির মতো সুন্দর শ্রীমঙ্গল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত মৌলভীবাজার জেলার একটি উপজেলা। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে স্বর্গরাজ্য খ্যাত এই অঞ্চলে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ চা-বাজার। দেশের ১৬৩টি চা-বাগানের মধ্যে এখানেই রয়েছে ৪০টি চা-বাগান যা আয়তনে উপজেলাটির প্রায় অর্ধেক জায়গা জুড়ে রয়েছে।
উঁচু-নিচু টিলার সারি সারি চা-বাগান দেখতে প্রতি বছর এখানে হাজারো দেশি বিদেশী পর্যটক এসে ভিড় করে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সবুজের এই অতিপ্রাকৃত দৃশ্য দেশের আর কোথাও দেখা যায় না। তবে চা-বাগান ছাড়াও এখানে রয়েছে অনেক ট্যুরিস্ট স্পট। আজকে জানাবো এই শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত কয়েকটি ট্যুরিস্ট স্পট সম্পর্কে যা একদিনের প্ল্যানেই ঘুরে শেষ করা সম্ভব।

যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাস ও ট্রেন যোগে খুব সহজেই শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় বাস থেকে ট্রেনে যাওয়াটাই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যকর। তাছাড়া চা-বাগান ও হাকালুকি হাওরের বুক চিঁরে চলে যাওয়া ট্রেনলাইন দিয়ে ট্রেন ভ্রমণ এক অন্যরকম প্রশান্তি অনুভূতির সৃষ্টি করে।
ঢাকা থেকে উপবন এক্সপ্রেস (বুধবার বন্ধ) রাত ৯ঃ৫০-এ সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত ভাড়া ২৯৫ টাকা (প্রথম শ্রেণী চেয়ার)। চট্টগ্রাম থেকে যেতে চাইলে উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়তে হবে (রাত ৯ঃ৪৫)। ভাড়া ৩২০ টাকা (শোভন)। আলো ফোঁটার বেশ আগেই আপনাকে স্টেশনে নামিয়ে দেবে। তাই আলো ফোঁটা পর্যন্ত স্টেশনেই অপেক্ষা করতে হবে।

বাসে যেতে পারেন, সিলেটগামী যেকোনো বাসে উঠে শ্রীমঙ্গল নেমে যেতে হবে। শ্রীমঙ্গল স্টেশন থেকে জীপ রিজার্ভ করতে হবে সারাদিনের জন্য। ভাড়া ২,৫০০ টাকা। মানুষ কম হলে সিএনজি রিজার্ভ নিতে পারেন। ভাড়া ১,২০০ টাকা। কোন কোন স্পটে যাবেন সেগুলো ভালো করে বলে নেবেন।
মূলত আমাদের র্যুটটা ছিল এরকম-
শ্রীমঙ্গল স্টেশন-বাইক্কা বিল-মাধবপুর লেক ও চা-বাগান-লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান-বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউট (BTRI)-নীলকণ্ঠ কেবিন-বধ্যভূমি ৭১।

বাইক্কা বিল
শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওড়ের পূর্বদিকে অবস্থিত প্রায় ১০০ হেক্টর জায়গা জুড়ে এ জলাভূমির অবস্থান। শীতকালে এখানে যেন অতিথি পাখির মেলা বসে। হাজার মাইল দূর থেকে আসা পাখিদের কলতানে মুখরিত থাকে এই বাইক্কা বিল। বছরের প্রায় সবসময়ই শাপলা ও পদ্মসহ নানা জাতের নাম না জানা জলজ উদ্ভিদে ছেয়ে থাকে বিলটি।
বর্ষায় এর সৌন্দর্য বেড়ে যায় বহুগুণে। বিলে প্রবেশ মূল্য মাত্র ৫ টাকা। এখানে একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার রয়েছে। যেখানে উঠে সম্পূর্ণ বিলের অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন। পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে ওঠার ফি ২০ টাকা। বিলটিতে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থাও রয়েছে।

মাধবপুর লেক ও চা-বাগান
কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক। পাহাড়ে ঘেরা ছোট এই কৃত্রিম লেকটি সিলেটের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। প্রবেশ ফি ১০০ টাকা (প্রথম চেকপোস্টে ৫০ টাকা, পরের চেকপোস্টে ৫০ টাকা)। চা-বাগানের জন্য পানি জমিয়ে রাখার জন্য তৈরিকৃত এই কৃত্রিম লেকটির সৌন্দর্য বর্ণনাতীত।
পাহাড়ি উঁচুনিচু টিলায় অবস্থিত বিস্তীর্ণ চা-বাগানে ঘেরা লেকটির পানি খুব স্বচ্ছ। এখানে দেখা পাবেন বিলুপ্তপ্রায় নীল পদ্ম ও বেগুনী শাপলা। এছাড়াও উঁচু উঁচু গাছের ডালে ডালে চষে বেড়াতে দেখা যায় বানর ও হনুমানকে। লেকটিতে নৌকা ভ্রমণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে লেকের পানিতে গোসল করা যায়।

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান
বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকটি রেইন ফরেস্ট কিংবা চিরহরিৎ বনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য লাউয়াছড়া বন। সংরক্ষিত এ বনভূমিতে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক ছাড়াও দুর্লভ জীবজন্তু ও কীটপতঙ্গের দেখা পাওয়া যায়। বনের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। চারদিক সবুজে ঘেরা এই রেললাইনে ছবি তোলা যেন আবশ্যক হয়ে উঠেছে পর্যটকদের কাছে। বনটিতে প্রবেশ মূল্য মাত্র ২০ টাকা।

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউট (BTRI)
১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে চা গবেষণা ইন্সটিটিউটের প্রধান কার্যালয় অবস্থিত শ্রীমঙ্গলে। বর্তমানে এটি শ্রীমঙ্গলের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে রূপ নিয়েছে। ভেতরের মনোরম পরিবেশ ও সুন্দর প্রকৃতি আকর্ষণ করে ভ্রমণপিপাসুদের।
নীলকণ্ঠ টি কেবিন
বিখ্যাত ৮ কালারের চা-এর উৎপত্তি এই শ্রীমঙ্গলেই। রমেশ রাম গৌড় নামক এক ব্যক্তি এই আট রং চা উদ্ভাবন করেন। এই চা পাওয়া যায় নীলকণ্ঠ টি কেবিনে। ৮ স্তরের বিভিন্ন রঙের চায়ের মধ্যে রয়েছে আলাদা আলাদা স্বাদ। তবে স্বাদে যতটা না ভালো, তার চেয়ে এই চা দেখতেই বেশি সুন্দর। দাম ৮০ টাকা। ঐতিহ্যবাহী এই টি কেবিনে এক কাপ চা না খেলে যেন শ্রীমঙ্গল ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না।

বধ্যভূমি ৭১
শ্রীমঙ্গলের ভানুগাছ সড়কে বিজিবি হেড কোয়ার্টারের পাশেই অবস্থিত বদ্ধভূমি ৭১। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসধারী এই বদ্ধভূমিতে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী ৭১’ নামক ভাস্কর্য স্থাপন করা হয় ২০১০ সালে। এরপর থেকেই এখানে পর্যটকদের আনাগোণা বেড়ে যায় বহুগুণে। পর্যটকদের সুবিধার্থে এখানে নির্মিত হয়েছে ‘সীমান্ত ৭১ ফ্রেশ কর্নার’।
যেখানে খাবেন
পানসী ও কুটুম্ববাড়ি রেস্তোরাঁ এখানে বেশ জনপ্রিয়।

যেখানে থাকবেন
শ্রীমঙ্গল বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর ভালো ও মাঝারি মানের হোটেল রয়েছে। সেখান ৫০০-১,০০০ টাকা খরচায় অনায়াসেই থাকতে পারবেন। হোটেল গ্রান্ড সুলতান নামে একটি পাঁচ তারকা হোটেলও রয়েছে এখানে।
বিঃদ্রঃ শ্রীমঙ্গল উপজেলাটি খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও গোছানো। এই ধারা অব্যাহত রেখে কোনো প্রকার ময়লা আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলবেন না।
Feature Image: vromonguide.com