আজ ২০১৯ সালের প্রথম দিন। বছরের প্রথম দিন। তাই বছর শুরুর লেখাটা একটু মিষ্টি মুখেরই হোক। হোক মুখে না দিয়ে, জিভে না লাগিয়ে স্বাদ নেয়া। পড়ে, ছবি দেখে আর গল্প শুনেই না হয় বছরের প্রথম দিন সবাইকে মিষ্টি মুখ করানো হোক। কারণ গল্পটা মিষ্টি নিয়ে, গল্পটা দিল্লী নিয়ে আর গল্পটা দিল্লীর প্রখ্যাত হলদিরাম ও হলদিরামের মিষ্টি নিয়ে।

দিল্লীর রাজপথে হলদিরামস। ছবিঃ লেখক
আমরা যে কোনো ভ্রমণে গেলেই সারাদিনের প্রধান খাবারটা সাধারণত কেএফসিতে করার চেষ্টা করি। এর তিনটি কারণ আছে আমাদের কাছে। এক, সাধ্যের মধ্যে এক জনের এক বেলার খাবার বেশ আরামেই হয়ে যায়। দুই, এর মান আর পরিমাণ নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট ছিলাম আর আছি এখন পর্যন্ত। আর তিন, এর স্বাদ আমাদের কাছে অতুলনীয় মনে হয়। এই তিনে মিলে দেশের বাইরে কেএফসির রাইস মিল হলো আমাদের কাছে সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখের একদম মিলেমিশে যাওয়া।
তাই এবারও, সারাদিনের নানা রকম ব্যঞ্জনা শেষে রাতের খাবারের জন্য আমরা দিল্লীর কেএফসির দ্বারস্থ হলাম সবাই মিলে। আমি নিজে, আমার ছেলে, ছেলের মা সবাই কেএফসিতে ঢুকে দারুণ আনন্দিত। এমনকি আমাদের সাথের অন্যান্য ভ্রমণ সঙ্গীরাও খুশি। তো কেএফসির প্রিয় মেন্যু দিয়ে ডিনার শেষ করে স্টেশনের কাছেই আমাদের হোটেলে ফিরছিলাম। কেএফসি থেকে আমাদের হোটেল বা স্টেশন মাত্র ২ কিলোমিটার। তাই গুগলের স্ট্রিট ভিউয়ের সাহায্য নিয়ে হেঁটে হেঁটেই ফিরবো বলে স্থির করলাম। এবং তাতে সবাই সম্মত হলো। বেশ ভালো, চল হেঁটে যাই?

বর্ণীল মিষ্টি। ছবিঃ লেখক
তো হাঁটছিলাম সবাই মিলে খুব ধীরে ধীরে, দিল্লীর রাতের রাজপথ উপভোগ করতে করতে। রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটছিলাম আর চারপাশ দেখছিলাম। হঠাৎ করেই রাস্তার অপরপাশে রাতের কালো গাছের পাতার ফাঁক ফোঁকর থেকে সবুজ, লাল আর হলুদ আলোর ঝলকানি মনোযোগ কেড়ে নিল। সেদিকে তাকিয়েই দেখি লেখা আছে হলদিরাম’স। আরে এই কি সেই হলদিরাম নাকি যার নাম অনেক অনেক শুনেছি? যে দোকানের মিষ্টির সুনাম অনেক অনেক শুনেছি? নিজেরাই নিজেদের কাছে জিজ্ঞাসা করছিলাম। কিন্তু কেউই নিশ্চিত হতে না পেরে অবশেষে প্রস্তাব দেয়া হলো, চল তাহলে না হয় একটু ঢুঁ মেরেই আসি ওখানে? সময় তো আমাদের পর্যাপ্ত আছে। সবাই যেতে সম্মত হলো।
অফিস ফেরা ব্যস্ত রাতের দিল্লীর রাজপথ পার হলাম সবাই মিলে হাত ধরাধরি করে। রাস্তার অপর পাশে গিয়ে সরাসরি হলদিরামস এ ঢুকে পড়লাম। আর ভিতরে ঢুকেই তো সবাই তাজ্জব বনে গেলাম। আরে এ যে মিষ্টি আর মিষ্টি! যেদিকে তাকাই শুধু মিষ্টির থালা, মিষ্টির গামলা, মিষ্টির কড়াই, মিষ্টির ঘ্রাণ, মিষ্টির মনপ্রাণ মাতাল করা আহ্বান। এসব তো ছিলই। এরচেয়েও বেশী করে যেটা আমাদের সবাইকে অভিভূত করেছে সেটা হলো মিষ্টির বাহার, মিষ্টির রঙ আর মিষ্টির নানা রকম ঢং! হ্যাঁ সত্যি সত্যি-ই তাই।

হলুদ রাজভোগ ও রসগোল্লা। ছবিঃ লেখক
জীবনে অনেক অনেক মিষ্টি দেখেছি, খেয়েছি। কিন্তু মিষ্টির যে এত এত রকম রঙ হতে পারে, আকার আকৃতি আর ধরন হতে পারে সে কোনোদিন চিন্তাই করিনি। পুরো হলদিরামসের দোকানের এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত মিষ্টি দেখতে চষে বেড়িয়েছি আর ক্যামেরা হাতে করেছি সেইসব অনন্য রঙ-বেরঙ আর ধরনের মিষ্টির ছবি ধারণ করে। যেন একটা মিষ্টির জগতে ঢুকে মিষ্টিময় রাত উপভোগ চলছিল আমাদের সবার। আর সেইসব মিষ্টির দামও ছিল বেশ নাগালের মধ্যেই।
দ্বিতীয় তলায় গেলাম, আরও কী কী আছে তা দেখার জন্য। কিন্তু না, উপরে শুধু আড্ডা বা খাওয়ার জায়গা। যে যার মতো পছন্দের খাবার কিনে নিয়ে উপরে চলে যায় আপন মনে খেতে খেতে প্রিয়জনের সাথে আড্ডা দিতে, গল্প করতে আর নিজেদের মতো করে সময় কাটাতে। তাই আবার নিচে নেমে এলাম। যেখানে মিষ্টির পাশাপাশি আছে নানা রকমের জুস, পানীয় আর অন্যন্য স্পাইসি খাবারের আয়োজন। মোট কথা মিষ্টি প্রধান আকর্ষণ হলেও, এখানে সাধারণত সকল খাবারের আয়োজনই রেখেছে হলদিরামস ব্যবস্থাপনা। আর সেসবের সবকিছুর দামই যথেষ্ট কম বা সকলের সাধ্যের মধ্যেই দেখে শুনে আর জিজ্ঞাসা করে জানলাম।

মিষ্টি ও কেক। ছবিঃ লেখক
ঘুরে ঘুরে হলদিরামস দেখা শেষ হলো। মিষ্টির জগতে হারিয়ে গিয়ে এবার তবে মিষ্টি চেখে দেখার পালা। কোনটা নেব আর কোনটা ছাড়বো? কোনটা খাবো আর কোনটা খাবো না সেই নিয়ে দারুণ বিড়ম্বনায় পড়ে গেলাম সবাই। হলুদ রাজভোগ না কমলা রসগোল্লা? কমলা লাড্ডু নাকি বেগুনী কদম্ব? গাজরের ঝুরো মিষ্টি না কি নানা রঙের মিষ্টির সমন্বয়ের মিষ্টি মহল? এসব নিয়ে দারুণ দুশ্চিন্তার মাঝেই আমি আমার চিরাচরিত পছন্দের হলুদ রাজভোগ বেছে নিলাম। ছেলে নিল তার প্রিয় কমলা লাড্ডু, ছেলের মা তার ভালো লাগার বেগুনী কদম্ব আর অন্যান্যরা তাদের পদন্দের মিষ্টি। কেউ গাজরের আর কেউ সন্দেশের স্বাদ নিতে ডুবে গেল মিষ্টির অথৈ সাগরে।
এভাবে প্রায় ঘণ্টাকাল হলদিরামসের বর্ণীল মিষ্টির সাগরে হাবুডুবু খেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলে চেতনা ফিরলো, আরে আমাদের তো যেতে হবে! অনেক রাত যে হয়ে গেছে। তাই মিষ্টির মধু স্বাদ আর হলদিরামসের দারুণ আভিজাত্যপূর্ণ ঝলমলে আতিথেয়তা উপভোগ করে দিল্লীর রাজপথে নেমে এলাম। কিন্তু কারো আর পা চলছে না এখন। কারণ একটু আগের ভরপেট কেএফসির রাইস মিল আর এখন নানা রঙের মিষ্টির সাগরে ডুবে থেকে কারো আর হেঁটে যাবার সাধ্য নেই। তাই বাধ্য হয়েই ৫০ রুপী দিয়ে একটি অটো নিতে হয়েছিল।

বর্ণীল আয়োজন। ছবিঃ লেখক
অটোতে উঠেছিলাম সবাই ফেরার পথে যেতে, কিন্তু চোখ, মন আর প্রাণ সবই বাঁধা পড়েছিল হলদিরামসের ঝলমলে আলোর রোশনাইয়ে, নানা রঙের মিষ্টির সাগরে, নাম না জানা নাম আর স্বাদের মিষ্টির অথৈ সমুদ্রে। সবকিছু মিলে দারুণ একটি রাতের, অসাধারণ কিছু সময় কাটিয়েছিলাম দিল্লীর প্রখ্যাত হলদিরামসের বর্ণীল মিষ্টির অথৈ সাগরে।

মিষ্টির অথৈ সাগরে! ছবিঃ লেখক
সবাইকে ২০১৯ নতুন বছরের মিষ্টি শুভেচ্ছা।