আজকে আমি আপনাদেরকে বলব সুচিত্রা সেনের স্মৃতি সংগ্রহশালায় বেড়াতে যাওয়ার গল্প। তার আগে চলুন একটু সুচিত্রা সেন সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিই।
সুচিত্রা সেনের আসল নাম রমা দাশগুপ্ত। ১৯৫২ সালে বাংলা সিনেমায় এসেই তিনি সুচিত্রা সেন নামটি ধারণ করেন। রূপালী পর্দায় তাঁর অভিষেক ঘটে ‘শেষ কোথায়’ নামক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এক বছর পরে এসে উত্তম কুমারের বিপরীতে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ নামক ছবিতে অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। তারপর আর তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
১৯৫৫ সালে ‘দেবদাস’ ছবিতে অভিনয় করে পুরস্কৃত হন, ১৯৫৯ সালে ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে নার্সের ভূমিকায় অভিনয় করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেন, ১৯৬৩ সালে ‘উত্তর ফাল্গুনী’ ছবিতে (মা এবং মেয়ে) দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেন যার বিপরীতে ছিলেন বিকাশ রায়। সুচিত্রা সেন এভাবে সারা জীবনে মোট ৫৮টি বাংলা ছবিতে অভিনয় করে ‘প্রণয়পাশা’ (১৯৭৮) ছবির মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের ইতি টানেন।

সুচিত্রা সেনের বাড়িতে তার একটি ছবি; Source: অচিন্ত্য আসিফ
হিন্দি ভাষায় সুচিত্রা সেনের সর্বজন প্রশংসিত ছবি হলো ‘আঁধি’ (১৯৭৪)। উক্ত চলচ্চিত্রে তিনি সঞ্জীব কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেন। তাঁর অভিনীত আরও কয়েকটি হিন্দি সিনেমার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মুসাফির’, ‘মমতা’, ‘বোম্বাই কা বাবু’ ইত্যাদি।
জীবনে কম পুরস্কার পাননি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। তিনি বেস্ট অ্যাকট্রেস অ্যাওয়ার্ড ছাড়াও পেয়েছেন ‘পদ্মশ্রী’ ও ‘বঙ্গবিভূষণ’ পুরস্কার।
বাঙালির রোমান্স, নস্টালজিয়া এই মহানায়িকা ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল তৎকালীন পূর্ববঙ্গের পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তাঁর পড়াশুনো ও বেড়ে ওঠা।

সুচিত্রা সেনের স্মৃতি সংগ্রহশালা; Source: অচিন্ত্য আসিফ
বর্তমান পাবনা শহরে এখনো টিকে আছে সুচিত্রা সেনের বসত বাড়ি। সেদিন আমি পাবনা শহর থেকে ইজিবাইকে উঠে রওনা হলাম সেই বসত ভিটার উদ্দেশ্যে। পাবনা শহরে সেবারই আমার প্রথম আসা, তাই ১৫-২০ মিনিটের পুরো রাস্তা জুড়েই আমার চোখটা কপালে উঠে ছিল। একের পর এক লাল রঙা বিল্ডিংগুলোর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলাম বৃটিশ শাসন আমলে।
শহর থেকে একটু এগিয়ে গিয়ে রাস্তার ডান পাশে চোখে পড়ে তাড়াশ ভবন। তারপর সাদা সাদা স্থাপনার মাঝে কিছু দূর পর পর একে একে অনেকগুলো লাল ভবনের দেখা মেলে। দেখা মেলে একটি শাহী মসজিদের আদলে নির্মিত মসজিদেরও, আসলে সেটা কোন আমলের মসজিদ সেটা ঘেঁটে দেখার সময় পাইনি। শুধু ইজি বাইক থেকে এক লাফে নেমে একটা ছবি তুলেই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাঁটতে শুরু করলাম।
মসজিদ থেকে একটু সামনে এগিয়েই একটা নব নির্মিত শিশুপার্ক রয়েছে। পার্কটির নাম ‘শেখ রাসেল শিশু পার্ক’। রাস্তা থেকে দেখে ভেতরে প্রবেশ করার লোভ সামলাতে পারলাম না। ভেতরে ঢুকে দেখি, নামে শিশু পার্ক হলেও পার্কের ভেতরে শিশুদের থেকে বড়রাই বেশি, কী জানি একেকজন শিশুর সাথে দুই-তিনজন করে অভিভাবক/গাইড এসেছে নাকি!
আমি ওদিকে আর বেশি কৌতূহল না বাড়িয়ে নজর দিলাম শিশুপার্কের কেন্দ্রে অবস্থিত জাতীয় পতাকা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্তম্ভের দিকে। স্তম্ভটি যে সাধারণ কোনো স্তম্ভ নয় তা এর আকৃতি দেখেই অনুমান করতে পারছিলাম, তাই এর পাশে থাকা একটি ফলক থেকে জেনে নিলাম এই প্রতীকী মিনারের অন্তর্নিহিত ভাষ্য।

শেখ রাসেল পার্কের অভ্যন্তরের মিনার; Source: অচিন্ত্য আসিফ
মিনারটির নিচের বেদিটি সাত ভাগে বিভক্ত, যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের প্রতীক। এছাড়া এটি ২৫ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট, যা ২৫শে মার্চ কালো রাত স্মরণে। মূল বেদির উপরে রয়েছে ১৬ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট দ্বিতীয় বেদি, যা ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর গৌরবোজ্জ্বল বিজয় দিবসের প্রতীক। এর উপরে রয়েছে ৯ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ৪টি মানব প্রতিকৃতি, যা ৯ মাসের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ ও চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির প্রতীক। তাঁর উপরে রয়েছে ২৬ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট স্তম্ভ। এটি ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের প্রতীক। একেবারে চূড়ায় রয়েছে লাল সবুজে শোভিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
স্মৃতিসৌধ ছাড়াও পার্কটির ভেতরে রয়েছে নানা রঙের ফুল গাছ, শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে নাগরদোলা, এছাড়া রয়েছে শেখ রাসেলের একটি ম্যুরাল ও পাবনা জেলার মানচিত্র।
পার্ক থেকে বেরিয়ে আবার হাঁটতে থাকলাম। কিছুদূর যেতেই রাস্তার ডান পাশে একটি টেকনিক্যাল কলেজ। কলেজটি যে ব্রিটিশ আমলের সেটা এর গাঢ় লাল রঙ দেখেই অনুমান করতে পারছিলাম। কলেজটির নাম, পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। এই কলেজটি পাবনার প্রখ্যাত জমিদার বনমালী রায় কর্তৃক ১৯২৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। তখন এর নাম ছিল ‘বিএল ইলিয়ট টেকনিক্যাল স্কুল’।
পলিটেকনিকের বিপরীত পাশে মূল রাস্তা থেকে একটি সরু রাস্তা চলে গেছে। রাস্তাটিতে গোড়ালি সমান পানি দেখে আমি একটু নাক সিটকে হাঁটতে শুরু করলাম। একটু সামনে এগিয়ে একজন পথচারীর কাছে সুচিত্রা সেনের স্মৃতি সংগ্রহশালার অবস্থান জানতে চাইলাম। লোকটি আঙ্গুল দিয়ে পেছনে ফেলে আসা পানি জমে থাকা রাস্তাটির দিকে দেখালেন। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গুটিয়ে নেমে পড়লাম পানিতে। পানিতে ২০ পা ফেলতেই চোখের সামনে একটা সাইনবোর্ড পেলাম যেখানে লেখা, “কিংবদন্তি মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা”।

স্মৃতি সংগ্রহশালার সামনের দৃশ্য; Source: অচিন্ত্য আসিফ
বাড়ির ভেতরটা রাস্তা থেকে তুলনামূলকভাবে উঁচু হওয়ায় সেখানে আর প্যান্ট গুটিয়ে রাখা লাগলো না। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে ১০ টাকায় টিকিট কিনে সংগ্রহশালার ভেতরে প্রবেশ করতেই একটি হারানো দিনের গানের সুরে মন নেচে উঠলো। গানটি সম্ভবত সুচিত্রা সেনেরই অভিনীত কোনো সিনেমার গান। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে জানতে পারলাম, এভাবেই নাকি সারা দিন সুচিত্রা সেনের সিনেমার গান বাজতে থাকে। এখানে আসা দর্শনার্থীরা নাকি এটা বেশ পছন্দও করে।
ঘরের ভেতরে সুচিত্রা সেনের নানা বয়সের ছবি ও ছোট ছোট ফেস্টুনে লেখা আছে তার নানা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এগুলোর ভেতরে একটি ফেস্টুনে লেখা দেখলাম, সুচিত্রা সেন ঘর গোছাতে পছন্দ করতেন।

স্মৃতি সংগ্রহশালার পেছন দিকের দৃশ্য; Source: অচিন্ত্য আসিফ
ঘরের ভেতরে সুচিত্রা সেনের ব্যবহৃত কোনো আসবাবপত্র চোখে পড়েনি। পেছনের দিকের কয়েকটি ঘর খালি থাকতে দেখে একটু হতাশ হয়েছিলাম বটে, কিন্তু গানের তালে সুচিত্রা সেনের নৃত্যের কল্পনায় তা নিমেষেই পুষিয়ে গেলো। সুচিত্রা সেনের নৃত্যের হাতে খড়ি হয়েছিলো এই ঘরেই আর এই উঠানেই তিনি তার ভাই-বোনদের সাথে ছুটোছুটি করেছেন এসব কল্পনা করতে করতে বেরিয়ে পড়লাম পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
কীভাবে যাবেন:
পাবনা মূল শহর থেকে ইজিবাইকে উঠে টেকনিক্যালের মোড় বললেই নামিয়ে দেবে সুচিত্রা সেনের স্মৃতি সংগ্রহশালার সামনে। শহর থেকে এখানে যেতে ১৫-২০ মিনিট সময় লাগে।
Feature Image: অচিন্ত্য আসিফ