ফিরছিলাম মানালি থেকে। মানডি পেরুবার আগেই ক্ষুধায় সবার চরম অবস্থা। খুঁজছিলাম মনোমুগ্ধকর কোনো ধাবা। ইচ্ছে ছিল বিলাসপুর যেহেতু থামতে পারছি না, সেহেতু বিলাসপুরের আশেপাশে কোথায় খাবো। যেন বিলাসপুর যেতে না পারার আক্ষেপ কিছুটা হলেও ঘুচে যায়। অন্তত এই ইচ্ছাটা পূরণ হয়েছিল সেদিন।
বিলাসপুরের বিস্তীর্ণ সবুজে বসে সকাল আর দুপুরের মধ্যখানে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চের সমন্বয়ের চেষ্টায়, তখন বেলা প্রায় ১১:৩০টা। সকালের নাস্তার সময় পেরিয়ে গেছে আর দুপুরের বেশ দেরি আছে। সুতরাং এমন কোনো খাবার খেতে হবে যেন সকালের ঘাটতি পূরণ করেও দুপুরে আর কোথাও থামতে না হয়! অথচ এমন নয় যে আমাদের হাতে সময় নেই। তবুও, সেই হতাশার কথা আর নাই বা বলি।

খাবারের মেন্যু সামনে এলো। একজন ছাড়া বাকি সবাই এক বাক্যে আলু পরাটা আর বুটের ডালের অর্ডার দিলাম। অন্য একজন এখনো মেন্যু দেখে চলেছেন। সবগুলো খাবারের ছবি দেখে ওনার মনে ধরলো মটর-পনিরের আইটেম। তিনি অর্ডার দিলেন। দামটাও বেশ, ১২০ রুপী! আমাদের একজনের নাস্তার প্রায় তিনগুণ!
দামের এত হেরফের দেখে আমাদের মনে হলো, আহারে না যেন কী অসাধারণ খাবার হবে! এত দাম। আমরা কী তবে ভুল করলাম আগে আগে অর্ডার দিয়ে? বঞ্চিত হলাম কি কোনো অসাধারণ খাবারের রোমাঞ্চ থেকে?

এই সময় আমাদেরও একটু ইচ্ছা হলো দেখতে, কেমন সেই মটর-পনিরের চিত্র? মেন্যু কার্ড নিয়ে সবাই মটর-পনিরের ছবি দেখতে লাগলাম। বেশ সুন্দর দেখতে। সবুজ মটরের মাঝে সাদা পনিরের কিউব আকারের বেশ ডুমো ডুমো সাইজ! সাথে বুটের ডালের মিশ্রণ আর দুই-একটা পালং শাকের ডাটাও দেখতে পেলাম বোধহয়! লাল-সাদা-হলুদ-সবুজের কম্বিনেশনের একটা লোভনীয় মেন্যু। তবে কেন জানি দেখে তেমন আগ্রহ জাগেনি। তাই অর্ডারও আর দেয়া হয়নি। ভিন্ন কিছু তো আর নেই, সেই কমন খাবার। তবে পনিরের টুকরোগুলো বেশ চোখে লেগেছিল।
যাই হোক, সবার আগে এলো মটর-পনির আর পরাটাই। আমাদের সঙ্গী খেতে শুরু করলো। আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম। কী আর করার, আমাদের খাবার তো এখনো দেয়নি। আমাদের সঙ্গী বেশ আয়েশ করে, চক্ষু বাঁকিয়ে আমাদেরকে কটাক্ষ করার ভঙ্গিমায় পরাটা ছিড়ে লোভনীয় মটর-পনিরের মাঝে ডোবাতে লাগলেন।
তা দেখে আমাদের সবারই জিভে জল টলটল করতে লাগলো! আর একটু হলে গড়িয়েই পড়তো হয়তো, যদি না! যদি না সে প্রথম বার মুখে দিয়েই, চরম বিরক্তি, বিতৃষ্ণা আর তিক্ততা ভরে আমাদের দিকে না তাকাতেন! তার সেই বিষণ্ণ অভিব্যক্তি দেখে আমরা সবাই জিজ্ঞাসা করলাম, সমস্যা কী? সে কিছুই বলল না। তবে এরপর শুধু পরাটা চিবাতে লাগলেন! মটর-পনির পাশেই পড়ে রইলো!

এরই মাঝে আমাদের আলু পরাটা আর বুটের ডালের গরম ধোঁয়া ওঠা সত্যিকারের মন আনচান করা তরকারি চলে এলো। আমরা সবাই অনতিবিলম্বে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। নিমেষেই শেষ একটা করে আলু পরাটা! আরও একটা করে অর্ডার দেয়া হলো। আর ওদিকে অন্যজনের মটর-পনির একা একাই গড়াগড়ি খেতে লাগলো। এবার তিনি আমাদের খ্যাপানোর আশঙ্কায় চোখ-মুখ বন্ধ করে রঙিন মটর-পনির না চিবিয়েই গিলে ফেলতে লাগলেন!
কোনো রকমে অর্ধেক শেষ হতে না হতেই, যিনি কখনো কোনো খাবার ভুল ক্রমেও অন্যকে সাধেন না, সেই তিনিই একে-একে আমাদের সবাইকেই সাধতে লাগলেন! “ভাই একটু নেবেন?” “তুই একটু খেয়ে দেখ” “তুমি একটু খাবা?” ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কেউই তার এই নিমন্ত্রণে সাড়া দিলাম না। কিন্তু এও ঠিক যে তিনি সেই খাবারের এক বিন্দুও রেখেও আসবেন না! তাকে তো আমরা অনেক অনেক দিন থেকে চিনি এবং জানি।
তাই নিশ্চিত ছিলাম যে তিনি প্রয়োজনে ডাক্তারকে পয়সা দিতে রাজি আছেন, বদ হজম এমনকি এর চেয়েও বড় সমস্যায় পড়তে রাজি আছেন, কিন্তু কোনোমতেই তার টাকায় কেনা খাবার অন্য কাউকে দিতে বা নষ্ট করতে কিছুতেই রাজি হবেন না! যদিও সেবার আমাদেরকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, সেটাই তার কাছ থেকে পাওয়া আমাদের একমাত্র নিমন্ত্রণ। যেটা আমরা কেউই সেদিন রক্ষা করতে পারিনি।

তবে সেই খাবারও তিনি নষ্ট করেননি বা হতে দেননি একটুও। ১২০ রুপী দামের সবটুকু মটর-পনিরের তরকারি তিনি চোখ-মুখ-নাক বন্ধ করে, না চিবিয়ে পানি দিয়ে ভেতরে চালান করে দিয়েছিলেন! আর আমরা সবাই বসে বসে রসিয়ে রসিয়ে তার নিদারুণ অভক্তি নিয়ে খাওয়া উপভোগ করেছিলাম। শুনেছিলাম কৃপণের ধন নাকি পিঁপড়ায় খায়, তবে এর ধন তো দেখি পিঁপড়া কেন, অন্য কেউই খেতে পারবেন না! তার প্রমাণ সেই মটর-পনিরের বিন্দুমাত্রও তিনি রেখে দেননি!
আর উষ্ণ পানীয়র বোতলের সবটুকু শেষ হয়ে যাবার পরেও যিনি কিনা প্রত্যুষে উঠে বোতল মুখের উপরে ধরে, বোতলের মুখ নিচের দিকে নামিয়ে জিভ বের করে রাখে, যদি একফোঁটা পড়ে! যদি একফোঁটা পড়ে! সেই আশায়। তার মটর-পনির কী আর নষ্ট হতে পারে? মটর-পনিরের সেই সাধ্যই যে নেই!

আসলে যেটা ঘটেছিল পরে জানতে পেরেছিলাম, সেটা হলো তিনি মটর পনিরকে মাটন পনির ভেবে ১২০ রুপী দাম হওয়া সত্ত্বেও অর্ডার করেছিলেন। কিন্তু মাটন যে টেবিলে আসতে আসতে মটর হয়ে যাবে সেটা তিনি কল্পনাও করেননি! যে কারণেই সেদিন তার সেই দুরবস্থা হয়েছিল।
তাই যারা যেখানেই যাবেন না কেন, নতুন কোনো জায়গায়, নতুন কোনো খাবার অর্ডার দেবার আগে ভালো করে দেখে, শুনে আর বুঝে নিন আসলে কী খাবেন, কী অর্ডার করছেন আর শেষ পর্যন্ত কী পাবেন।