মানুষ মূলত বসবাস কিংবা প্রয়োজনীয় কাজের জন্য নির্মাণ করে থাকেন দালানগুলো। একেক দালানের একেক রকম উচ্চতা, আকৃতি, ডিজাইন। সকলেরই ইচ্ছে থাকে নিজেদের তৈরি দালানটি অন্যদের তুলনায় আলাদা ও সুন্দর হোক। এই ইচ্ছে থেকেই আমরা নানা ধরনের দালান দেখতে চাই চারপাশে।
তবে পৃথিবীর সকল দালানই বসবাস ও শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কাজের জন্যই নির্মাণ করা হয় না, সকল দালান নির্মাণের ক্ষেত্রে শুধু আলাদা সৌন্দর্যের কথাই বিবেচনা করা হয় না। কিছু দালান নির্মাণ করা হয় মানুষকে মুগ্ধ, অবাক ও বিস্মিত করার উদ্দেশ্যেও। চলুন বিশ্বের এমনই কয়েকটি অদ্ভুত দালান সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক।
১. ডান্সিং হাউজ, প্রাগ:
ডাকনাম ‘দ্য ডান্সিং হাউজ’, এটি প্রাগের ন্যাশনালি-নেডেরলানডেন বিল্ডিং। ক্রোয়েশীয়-চেক স্থপতি ভ্লাডো মিলিনিক এবং কানাডিয়ান-আমেরিকান স্থপতি ফ্রাঙ্ক গেরি দ্বারা ডিজাইন করা হয়েছিল এই দালানটির। দালানটির অসাধারণ আকৃতি ও ডিজাইন আপনাকে সত্যিই অবাক করবে। এটি একেবারেই ভিন্ন একটি নির্মাণ। পর্যটকরা অদ্ভুত সুন্দর এই বাড়িটিকে দেখতে ছুটে যান বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে। প্রাগে অবস্থিত এই বাড়িটি অনেক বেশিই জনপ্রিয়।
২. কমল মন্দির বা লোটাস টেম্পল, দিল্লী, ভারত:
দিল্লীর লোটাস মন্দির হলো বাহাই ধর্মে বিশ্বাসী একাত্ম মানুষদের জন্য ধর্মাচরণের একটি জায়গা। এটি বিশ্বের অন্যতম সর্বাধিক পরিদর্শনীয় স্থাপত্য বিস্ময়। মন্দিরের প্রধান স্থাপত্যশিল্পী ছিলেন ফেরীবোর্জ সাহবা। পরিকাঠামোটি, তিনটি স্তরের প্রত্যেকটিতে ৯টি করে মোট ২৭টি পদ্মফুলের পাপড়ির ন্যায় সমন্বয়ে গঠিত।
এটি ১৯৮৬ সালে উন্মুক্ত করা হয়। এ স্থানে প্রবেশের জন্য কোনো প্রবেশমূল্য লাগে না। এর প্রাঙ্গণটি নির্মল, পরিচ্ছন্ন ও বিশাল। লোটাস মন্দিরটি ভারতের রাজধানীতে মানুষদের সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা স্থানগুলোর মধ্যে উচ্চ স্থানে রয়েছে।
৩. কলোগনী ক্যাথেড্রাল:
কলোগনী ক্যাথেড্রাল একটি উচ্চ গথিক বেসিলিকা। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১২৪৮ সালে এবং ১৪৭৩ সালে আবার বন্ধও হয়ে গিয়েছিল বিল্ডিংয়ের কাজ শেষ হওয়ার আগেই। ১৮০০ সাল পর্যন্ত বিল্ডিংটির কাজ আর পুনরায় চালু হয়নি। নানা ঝামেলা ও দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ১৮৮০ সালে এই সম্পূর্ণ ক্যাথেড্রালটির কাজ শেষ হয়। পরের কাজটি মূল মধ্যযুগীয় পরিকল্পনা অনুসরণ করেই করা হয়েছিল।
এই ক্যাথেড্রালটি একটি গোথিক মাস্টারপিস হিসাবে বিখ্যাত এবং শিল্পের অনেক কাজের পাশাপাশি এটিতে রয়েছে ১২টি আর্চবিশপের সমাধিসৌধ।
৪. ডোম অফ দ্য রক, জেরুজালেম:
৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ববাহী বিবিধ কারণে পুরনো জেরুজালেমের পবিত্র টেম্পল মাউন্ট চত্বরের কেন্দ্রস্থলে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করেন। মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত অষ্টভুজাকৃতির এই স্থাপনাটির নকশা ও অলংকরণে সমসাময়িক বাইজেন্টাইন স্থাপত্যশৈলী লক্ষণীয়। অটোমান সম্রাট সুলেমানের শাসনামলে ডোম অফ দ্য রকের বাইরের দেয়াল সুদৃশ্য টাইল দিয়ে আচ্ছাদিত হয়।
১৯৫৫ সালে জর্ডানের সরকার অন্যান্য আরব রাষ্ট্র ও তুরস্কের সহায়তায় প্রবল বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনাটির মেরামত কাজ করান। এই পুনরুদ্ধার কাজের অংশ হিসেবে ১৯৬৫ সালে এর সীসা আচ্ছাদিত গম্বুজটি ইটালিতে তৈরি অ্যালুমিনাম-ব্রোঞ্জ সংকর ধাতু দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালে জর্ডানের কিং হুসেইন প্রদত্ত ৮.২ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৮০ কিলোগ্রাম স্বর্ণ দিয়ে গম্বুজটি পুরোপুরি আচ্ছাদন করা হয়। জেরুজালেমের যে কোনো প্রান্ত থেকে ডোম অফ দ্য রকের উজ্জ্বল সোনালী গম্বুজটি চোখে পড়ে।
৫. লা পেড্রেরা, বার্সেলোনা:
স্পেনের বার্সেলোনায় অবস্থিত বিস্ময়কর এই দালান লা পেড্রেরা। এটি দেখতে একেবারেই অদ্ভুত। অদ্ভুত সুন্দর এই বাড়িটি ভিন্ন এক সৃজনশীলতার চিত্র তুলে ধরে। এটি বিশ্বের সেরা যেসব সুন্দর ও সৃজনশীল স্থাপত্যের প্রমাণ রাখা নির্মাণ রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম। স্থাপত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে কল্পনাপ্রবণ বাড়িগুলোর মধ্যে এটি একটি। তবে এটিকে ভবন বলার চেয়ে বেশি মানাবে ভাস্কর্য বললেই। এই দালানটিতে ছড়িয়ে আছে পাথর, বারান্দা জুড়ে ছড়িয়ে আছে কৃত্রিম জাল ও চারপাশ জুড়ে প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়া। জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন (ইউনেস্কো) ১৯৪৮ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে এই ভবনটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
৬. পেট্রোনাস টাওয়ার, কুয়ালালামপুর, মালয়েশিয়া:
মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে অবস্থিত একটি বহুতল ভবন, যা ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভবন বলে সমাদৃত হতো। উচ্চতার দিক থেকে বর্তমানে বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস টাওয়ারটি। এটি নির্মাণ করতে লেগেছে একটানা সাত বছর। মালয়েশিয়ার মোবাইল কোম্পানি মাক্সিস ও তেল কোম্পানি পেট্রোনাসের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে এই টাওয়ারটি। এই টাওয়ারই হচ্ছে পেট্রোনাসের প্রধান কার্যালয়। এটি নির্মাণ করতে খরচ হয়েছে ১.৬ বিলিয়ন ডলার।
টাওয়ারটি নির্মাণে আর্জেন্টিনা, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার দক্ষ ইঞ্জিনিয়াররা কাজ করেছেন। এই টাওয়ারটি নির্মাণে মূল কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে স্টিল ও পাথর। যদিও টাওয়াটিকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় শুধু স্টিল দ্বারা নির্মিত হয়েছে। টাওয়ারের ৪১ এবং ৪২ তম তলাকে সংযুক্ত করেছে একটি ব্রিজ। ব্রিজটির নাম হচ্ছে স্কাই ব্রিজ। এই ব্রিজের সাহায্যেই এক ভবন থেকে অন্য ভবনে যেতে হয়।
৭. লিনিং টাওয়ার অব পিসা, পিসা, ইতালি:
পিসা শহরের ক্যাথেড্রাল স্কয়ারের তৃতীয় প্রাচীনতম স্থাপনার একটি পিসার হেলানো টাওয়ার বা লিনিং টাওয়ার অব পিসা। এটি পৃথিবীর অদ্ভুত দালানগুলোর একটি। ১৪ আগস্ট ১১৭৩ সালে এই টাওয়ারটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। প্রথম থেকেই কিন্তু এই টাওয়ারটিকে হেলানোভাবে তৈরি করা হয়নি। তিন তলা পর্যন্ত সম্পন্ন হওয়ার পর হঠাৎই অদ্ভুতভাবে হেলতে শুরু করে টাওয়ারটি।
বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারেন, টাওয়ারটির নির্মাণ কৌশলে ভুল ছিল। টাওয়ারের নিচের নরম মাটি ও অগভীর ভিত এই অস্বাভাবিক হেলে পড়ার জন্যে দায়ী বলে ধারণা করা হয়। অদ্ভুতভাবে সেই হেলানো অবস্থাতেই দাঁড়িয়ে রইল টাওয়ারটি। তা দেখে অবাক হলেও, স্থপতিরা হাল ছেড়ে না দিয়ে হেলে যাওয়ার মধ্যেই গড়তে থাকেন একের পর এক তলা। অদ্ভুত এই টাওয়ারটি পর্যটকদের বেশ প্রিয় একটি জায়গা।
ফিচার ইমেজ- YouTube