আপনি যদি একজন অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ হয়ে থাকেন এবং এই পৃথিবী বা মহাবিশ্বকে এক্সপ্লোর করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে, তবে আপনার জন্যই আমার এই আর্টিকেল।
বৈচিত্র্যপূর্ণ এই পৃথিবীতে এমন অনেক স্থান রয়েছে, যা এখনো আমাদের অজানা। কিন্তু আমি যে জায়গাটি নিয়ে আজ লিখতে চলেছি তা হয়তো অজানা নয়, কিন্তু অচেনা। বুঝতে একটু কঠিন হয়ে গেলো বুঝি! সেটাই হওয়ার কথা।
আচ্ছা ভাবুন তো, বিজ্ঞানের এই যুগে এলিয়েনের কথা শোনেনি এমন লোক কি পাওয়া যায়? এমন কিছু মানুষ রয়েছে বটে, কিন্তু তারা সংখ্যায় খুব কম। আজকে আলোচনা করব এমন এক এলিয়েন সৌন্দর্যের লীলাভূমি নিয়ে, যা আপনি হয়তো ভাবতে পারেন বা জানতে পারেন, কিন্তু নিশ্চয় চিনতে পারবেন না। কারণ এখানে রয়েছে এমন সব প্রাণী ও উদ্ভিদ, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। অদ্ভুত এই পরিবেশে ঘুরতে গিয়ে কিছু সময়ের জন্য হলেও আপনার মনে হবে- পৃথিবীর বাইরের কোনো গ্রহে চলে এসেছি।
সকোত্রা দ্বীপ মূলত আরব সাগরের একটি দ্বীপ। এই দ্বীপের মূল আকর্ষণের একটি হলো, ‘ড্রাগনস ব্লাড ট্রি’। পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসের প্রতীক রূপে এখনো টিকে আছে অদ্ভুত এই গাছটি। বিজ্ঞানীদের ধারণা, একসময় এটা সারা বিশ্বের কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার নিকটবর্তী অঞ্চলের বনভূমিগুলোতে পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে তা হারিয়ে, সকোত্রা ও কেনারী আইল্যান্ডে সামান্য কিছু গাছের অস্তিত্ব রয়েছে।
‘ড্রাগন্স ব্লাড ট্রি’ দেখতে খানিকটা উল্টানো ছাতার মতো। হঠাৎ দেখে বৃহৎ আকৃতির ব্যাঙের ছাতা ভেবে ভুল করাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই গাছটির রয়েছে আরো একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য, যা আপনাকে চমকে দিতে পারে।
একটু ছোটবেলার কথা মনে করুন তো, আপনি কখনো দাদা-দাদী বা নানা-নানীর কাছে এমন কোনো গল্প শুনেছেন, যে গল্পে গাছ কাটলে রক্ত বের হতো? হয়তো শুনে থাকবেন, সত্যি বলতে আমিও শুনেছি। তখন গল্পগুলোর কথা শুনতে ভৌতিক মনে হতো, কিন্তু বিশ্বাস করুন এখন আর তা মনে হচ্ছে না। কারণ, আমি এখন এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সহ বাস্তব অস্তিত্ব সম্পর্কে জানি।
‘ড্রাগন্স ব্লাড ট্রি’ কাটলে রক্ত বের হয়। রক্তের মতো দেখতে হলেও, আসলে একে রক্ত বলা ঠিক হবে না। ‘ড্রাগন্স ব্লাড ট্রি’ কাটলে যে রেজিন বের হয় তাতে অধিক মাত্রায় আয়রন অক্সাইড রয়েছে। অবশ্য আমাদের রক্তও এই একই কারণে লাল হয়ে থাকে। মানুষের রক্তের হিমোগ্লোবিনে প্রচুর পরিমাণে আয়রন অক্সাইড থাকায় সেটা লাল হয়।
‘ড্রাগন্স ব্লাড ট্রি’ থেকে নিঃসৃত লাল রেজিন অনেকে রঙ করার কাজে ব্যবহার করেন। আবার একসময় নাকি ক্ষত নিরাময়েও ব্যবহার করা হতো এই রেজিন। কারণ এতে রয়েছে শক্তিশালী জীবাণুনাশক গুণ।
গ্রিক পুরাণে ‘ড্রাগন্স ব্লাড ট্রি’-এর উৎপত্তি সম্পর্কে একটি উপকথা পাওয়া যায়। বলা হয়, হারকিউলিস যখন ভয়ঙ্কর ড্রাগন লাডনকে হত্যা করেন তখন ঐ ড্রাগনের রক্ত থেকেই এই গাছের উৎপত্তি হয়। এছাড়াও ‘ড্রাগনস ব্লাড ট্রি’ এর উৎপত্তি নিয়ে বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে নানা মত রয়েছে। তবে নিশ্চিত করে কেউই বলতে পারে না অদ্ভুত এই গাছের উৎপত্তির ইতিহাস।
‘ড্রাগন্স ব্লাড ট্রি’ ছাড়াও এই দ্বীপে রয়েছে বোতল গাছ সহ অদ্ভুত সব উদ্ভিদ এবং প্রাণী। এখানে বিরল প্রজাতির অনেক পশুপাখির দেখা মেলে, এদের মধ্যে বেশিরভাগ প্রাণীই কেবল সকোত্রাতেই বসবাস করে। দ্বীপটিতে মোট প্রায় ১৪০ প্রজাতির পাখি রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১০ প্রজাতি শুধু সকোত্রাতেই দেখা যায়; এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সকোত্রা স্টার্লিং, সকোত্রা চড়ুই, সানবার্ড, বান্টিং, সোনালি ডানার গ্রসবেক ইত্যাদি।
সকোত্রা দ্বীপের অদ্ভুত আরেকটি ব্যপার হলো, এখানে কোনো উভচর প্রাণী নেই এবং স্তন্যপায়ীও প্রায় নেই বললেই চলে। মানুষ ছাড়া এই দ্বীপটিতে স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে বাদুড়। তবে সরীসৃপের সংখ্যা অনেক। এই দ্বীপের সরীসৃপগুলোর ৯০ শতাংশকেই পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
সকোত্রা দ্বীপকে ঘিরে প্রচলিত আছে নানা গল্প-কথা। বলা হয়, একসময় এই দ্বীপ ছিল নাবিকদের মৃত্যুকূপ। সবার ধারণা ছিল, সকোত্রার আদিবাসীরা তাঁদের জাদু বলে সমুদ্রের ঝড়-জ্বল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সেখানে জাহাজ ডুবানো তো তাদের বাঁ হাতকা খেল। অবশ্য কালের বিবর্তনে এখন আর এই ধারণা নেই। এখন ইয়েমেনের ছেলেরা যেখানে ছুরি-আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরে ও প্রতিনিয়ত গণ্ডগোল করে, সেখানে সকোত্রার নাগরিকরা খুব শান্ত।
সকোত্রায় ৪০ হাজার লোকের বসবাস রয়েছে এবং গ্রাম রয়েছে ৬০০টি। এখানকার গ্রামগুলো খুবই ছোট; অধিকাংশ গ্রামই একটি মাত্র বড় পরিবার নিয়ে গঠিত। অথচ তাদের মধ্যেও কোনো গণ্ডগোল হয় না। এদের মধ্যে কোনো রকম ঝামেলা হলে, মুরব্বিদের নেতৃত্বে পাড়া-পড়শিদের নিয়ে তার সমাধান করা হয়।
মূলত সকোত্রার ভৌগলিক কারণে এবং এখানে বসবাসরত নিরীহ স্বভাবের মানুষগুলোর কারণে, এখানকার প্রকৃতি ধরে রেখেছে তাঁর প্রাচীন রূপ। সকোত্রায় একটি মাত্র পাকা রাস্তা রয়েছে, যা বানানো হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। ইয়েমেন সরকারের উদ্যোগে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল মূলত পর্যটকদের উদ্দেশ্যে।
গত কয়েক দশকে এখানকার প্রকৃতি নিয়ে গবেষণার ফলে, পুরো বিশ্বের কাছে পরিচিতি পায় সকোত্রা দ্বীপ। প্রাচীন গন্ধি গাছ-পালা এবং পৃথিবীর অন্য স্থানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা আবহাওয়ার কারণে ২০০৮ সালে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ঠাঁই করে নেয়। তবে বর্তমানে অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকদের আনাগোনার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এই দ্বীপের প্রাচীনত্ব। আস্তে হারিয়ে যেতে বসেছে বিরল প্রজাতির উদ্ভিদরাজি ও প্রাণীকুল।
একটি বিশেষ বার্তা: বর্তমানে সকোত্রা দ্বীপকে কেন্দ্র করে ইয়েমেন ও আরব আমিরাতের মধ্যে সামরিক দ্বন্দ্ব চলছে, তাই এখন সকত্রা দ্বীপ পর্যটকদের জন্য নিরাপদ স্থান নয়। আশা করি, এক সময় এই দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটবে এবং আমরা পাবো পৃথিবীতে থেকে ভিনগ্রহ ভ্রমণের স্বাদ।
Feature image: dcpexpeditions.com
সকোত্রা দ্বীপ: যাকে বলা হয় পৃথিবীতেই এলিয়েনদের আবাস

Loading...
চমৎকার লেখা!