সলো ট্র্যাভেলারদের নির্দিষ্ট কোনো প্ল্যান থাকে না। পিঠে ব্যাগ, উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যে হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে যে একটা আনন্দ আছে সেটা বুঝতে হলে একা দেশের পথে বের হতে হবে। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে মাথাটা যখন হ্যাং মেরে রয়েছিল তখনই ব্যাং করে সিদ্ধান্ত নিলাম বের হবো এই ইট পাথরের শহর থেকে। রুট ছিল সিরাজগঞ্জ-বগুড়া-নাটোর-রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
প্রয়াত মাহমুদ হাসান খান ভাইকে ফেসবুকে নক দিলাম। মাহমুদ ভাই মানে জীবন্ত উইকিপিডিয়া। তার কাছ থেকে সব তথ্য নেবার পর বের হয়ে গেলাম অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে। বাংলা বইয়ের পাতায় বনলতা সেনের কবিতা, নাটোরের কাচাগোল্লা, চলন বিলের গল্প পড়ে ছোট বেলা থেকেই নাটোর নিয়ে একটা ফ্যাসিনেসন ছিল।
নাটোর জেলার কথা মনে পড়লে চোখের সামনে ভেসে উঠতো জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন। চলন বিলের চলমান পানি, রানী ভবানীর দেশ যেন নিয়ে যায় সেই বাংলা বইয়ের পাতায়। স্কুল জীবনের পাওয়া শিক্ষা কখনও ভোলার নয়। আমার নাটোর ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাঠ্য বইয়ের পাতায় পড়া নাটোর শহরটি নিজের চোখে দেখা।

জলে চলে যান। ছবি – আশিক সারওয়ার
সময়টা ছিল দূর্গা পূজার। পুরো নাটোর শহর পূজার আমেজে ডুবে আছে। ঢাকার বাইরে যে এত সুন্দর দূর্গা পূজার আয়োজন হয় আমার জানা ছিল না। বগুড়া থেকে বাসে করে নাটোর শহরে পা রাখা মাত্রই পেয়ে গেলাম পূজার আমেজ। নাটোর যেহেতু আসলাম, কাঁচা গোল্লা না খেলে কী চলে? পুলিশ সার্জেন্ট দাঁড়িয়ে ছিল আমার পাশে, তাকে জিজ্ঞেস করা মাত্রই বলে দিল কালী মন্দির যেতে। ভীড় ঠেলে রওনা দিলাম কালী মন্দিরের দিকে।
পিছে ব্যাকপ্যাকটা দেখে মানুষ কৌতুহলী চোখে বার বার তাকাচ্ছিল। সেটা থোড়াই কেয়ার করে হাঁটা দিলাম। কালী মন্দির আসার পর খুঁজে পেলাম কাঙ্ক্ষিত কাঁচা গোল্লা। পেট পুরে খেয়ে নিলাম। এরপর খুঁজতে হবে হোটেল। হোটেল খুঁজতে গিয়ে জীবনের সেরা মারা খেলাম। নাটোরের সবচেয়ে ভাল হোটেল ভি আই পি রেখে চলে গেলাম হোটেল রুখসানাতে। দু’টি পয়সা বাচানোর জন্য সারারাত মশার কামড় খেয়ে চরম শিক্ষা হলো। তাই কাক ডাকা ভোরেই পিঠে ব্যাগ চড়িয়ে রুমের বিল মিটিয়ে বের হয়ে পড়লাম নাটোর শহর ঘুরতে।
স্মৃতিচারণের একটা বিশাল সমস্যা অনেক জায়গার নাম মনে থাকে না। হয়তো দ্বিতীয় বার গেলে মনে পড়বে। হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে উঠে পড়লাম পাটুলের মহেন্দ্রায়। আগে হালতি বিলটা দেখে নেই। এইটা চলন বিলের সাথে কানেক্টেড একটা বিল। বাংলাদেশের বৃহত্তম বিলগুলোর মধ্যে অন্যতম বিলের নাম হালতি বিল। নাটোর, নওগাঁ ও রাজশাহী জেলার বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে এই বিলের অবস্থান। একাধারে এটি দেশের গভীরতম বিলও বটে। ১২ মিটার গভীর এই বিলে সারা বছরই পানি থাকে। ভোর তখন ৭টা বাজে। মৃদু কুয়াশা আর অথৈ বিলের পানি মনটা চনমনে করার জন্য যথেষ্ট ছিল।
এই অথৈ জলরাশির মাঝখান দিয়ে তৈরি হয়েছে কংক্রিটের রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে অথৈ জলরাশি আর ডুবো সড়ক। শীতকালে এসে যে ডুবো সড়ক পাব সেটা আশা করিনি। যখনই কোনো ভ্যান, টেম্পু এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে মনে হয় অথৈ জলরাশির মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। সাত সকালে বিলের পানিতে শুধু মানুষ গোসল করে না, সাথে গোসল করে যান্ত্রিক দানব (মহেন্দ্রা, টেম্পু) গুলোও।

হালতি বিলের হাঁস। ছবি – আশিক সারওয়ার
সাত সকালে রসিক হাঁসের পাল নেমেছে বিলের পানিতে। মহেন্দ্রা যেখানে নামলো সেখানেই বিলের ঘাট। আর ঘাটে বাঁধা ছিল ইঞ্জিন চালিত নৌকাগুলো। সাত সকালে খাজুরা খাজুরা করে ডাক দিচ্ছে। এ যেন সোনায় সোহাগা। লোকাল মানুষের সাথে উঠে পড়লাম নৌকায়। সলো ট্র্যাভেলিংয়ের একটা বিরাট সুবিধা আপনি প্রচুর লোকাল মানুষদের সাথে কথা বলার সুযোগ পাবেন। বোটে উঠেই সবার সাথে আলাপ জমিয়ে দিলাম। বোটের মাঝি ভাই তো অবাক একা একা এত দূর এসে পড়েছি। বোটে আমি রীতিমতো সেলিব্রেটি টাইপ কিছু হয়ে গেলাম।
সেন্টার অফ অ্যাট্রাকশন হতে কার না ভালো লাগে? বোটের মাঝি মামা আমাকে খাজুরা গ্রামে নামিয়ে দেবার পর বললো, মামা আপনি ঘুরেন, বোট আবার আধা ঘণ্টা পর ছাড়বো আর আপনারে না নিয়া যাব না। বিলের পাশে সাজানো গুছানো ছিমছাম একটা সুন্দর গ্রাম খাজুরা। আশেপাশে ঘুরে গ্রামীণ জীবন দেখতে দেখতে কোথায় যে সময় কেটে গেল টেরই পেলাম না। শীতের সকালের লিকার চা দেহ উত্তাপ বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। চা খেয়ে রওনা দিলাম আবার বোটের দিকে। মামা আমার পানেই যেন চেয়ে ছিল। যাওয়া মাত্রই বোট ছেড়ে দিল। মামার সাথে গল্প করতে করতে চলে এলাম আবার পাটুল। যাবার সময় মামার নাম্বার নিয়ে নিলাম।
পাটুল থেকেই আবার অটোতে উঠলাম। নামলাম উত্তরা গণভবন। যাকে বলে উত্তর বঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বাস ভবন। উত্তরবঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বাস ভবন নামে পরিচিত এই ভবনটি নির্মাণ করেন দীঘাপাতিয়ার রাজা প্রমদা নাথ রায়। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হবার আগে এটি সবার কাছে দীঘাপাতিয়া রাজবাড়ী নামেই পরিচিত ছিল। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিল্পুতি ঘোষণা করলে বাড়ীটি রক্ষণাবেক্ষণে বেশ সমস্যা দেখা যায়।
এর সমাধানে পাকিস্তান সরকার বাড়ীটি সংস্কার করে ১৯৬৭ সালের ২৪শে জুলাই পূর্ব পাকিস্তানের দীঘাপাতিয়ার গর্ভনর হাউস হিসাবে ঘোষণা করে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে ৯ ফ্রেবুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুষ্ঠানিকভাবে একে উত্তরবঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বাস ভবন হিসেবে ঘোষণা করেন।

উত্তরা গণভবনের প্রবেশদ্বার। ছবি – রোহান উদ্দিন ফরহাদ, সোর্স – উইকি।
এই রাজবাড়ীটির আদি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জমিদার দয়ারাম রায়। নাটোরের রাজা মহারাজা রাম জীবনের উত্থানে উনার একান্ত ভূমিকা ছিল। উনি ছিলেন রাজা রাম জীবনের দেওয়ান ও একান্ত অনুচর। রাজা রাম জীবন দয়ারামের অসামান্য অবদানের জন্য ১৭০৬ সালে উপহার হিসেবে বাসস্থানের জন্য তাকে দিঘাপতিয়ায় কিছু জমি দান করেন।
পরবর্তীতে জমিদার ও রাজা হওয়ার পর ১৭৩৪ সালে দয়ারাম দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৭ সালে প্রলয়কারী ভূমিকম্পের পর বাড়ীর বেশির ভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। তার বংশধর রাজা প্রমাদা নাথ রায় ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছর সময় নিয়ে ভবনটি পুনঃনির্মাণ করেন। দয়ারাম রায়ের আমলের প্রাসাদের মূল অংশ, তোরণ এবং কিছু ভবন এখনও টিকে আছে। জেলা শহর থেকে প্রায় ৩ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত এই দীঘাপতিয়া রাজবাড়ীটি নাটোরের অন্যতম আর্কষণ।
প্রায় ৪৩ একর জায়গা জুড়ে চারদিকে লেক ও প্রাচীর বেষ্টিত এই কমপ্লেক্সের আশেপাশে রয়েছে ছোট বড় প্রায় ১২টি সুরম্য ভবন। ভেতর দিকে রয়েছে ইতালি থেকে সংগৃহিত ভাস্কর্য ও সুসজ্জিত বাগান। উত্তরা গণভবনের প্রবেশ তোরণটি অনেকটা পিরামিড আকৃতির। এর চূড়ায় রয়েছে তৎকালীন বিলেতের কোক অ্যান্ড টেলভী কোম্পানির শতবর্ষী প্রাচীন ঘণ্টা ঘড়ি। জনশ্রুতি আছে এক কালে এই ঘড়ির ঘণ্টার শব্দ দূর-দূরান্ত থেকে শোনা যেত।
উত্তরা গণভবনে ঢোকার বিশাল তোরণটাই আমাকে বিশেষভাবে আর্কষণ করলো। ভেতরে গিয়েও হতাশ হলাম। ২০ টাকা টিকেট কেটে প্রধানমন্ত্রীর বাসায় ঢুকেছি একটু ছবি তুলে পয়সা উসুল তো করতে হবে। এর পিছনের অংশে একটা সুন্দর বাগান আছে। সেটা দেখতে দেয় না সবাইকে। অনেক অনুরোধের পর ঢুকতে পারলাম। আমি যে কী লেভেল ছাড়া পাগল গার্ডরা বুঝে গেছে এতক্ষণে। প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ না পেয়ে ভগ্ন হৃদয়ে বের হয়ে গেলাম। এবার গন্তব্য রানী ভবানীর রাজবাড়ী।
এতক্ষণে পেট বিদ্রোহ করা শুরু করলো। মাদ্রাসা মোড়ে এসে আশেপাশে খুঁজে পেয়ে গেলাম রেস্টুরেন্ট। পেটের জ্বালা মিটিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে রাজবাড়ী যাবার জন্য রাজকীয় হালে রিক্সা ঠিক করলাম। রানী ভবানীর রাজবাড়ী নেমে সিকিউরিটি দেখে আমি অবাক হয়ে নির্বাক। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ীতেও এত সিকিউরিটি দেয়নি যতটা রানীর বাড়ীতে দেওয়া হয়েছে। নাটোরের রানী বলে কথা। পূজো উপলক্ষে বিনা টিকেটে প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে সবার জন্য। রাজবাড়ীর পাশেই আছে একটা সুন্দর গোছানো পার্ক। জেলার প্রধান আর্কষণ সপ্তদশ শতাব্দির তৈরি এই রাজবাড়ী।

উত্তরা গণভবন। ছবি – আশিক সারওয়ার
রানী ভবানী ছাড়া নাটোরের ইতিহাস যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আজও কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এই রাজবাড়ীটি। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সরকার পুরো কমপ্লেক্সটিকে রানী ভবানী কেন্দ্রীয় পার্ক ঘোষণা করে। পুরো কমপ্লেক্সে ৬টি দীঘি ছাড়াও রয়েছে উল্লেখ্যযোগ্য মন্দির। শ্যামসুন্দর মন্দির, আনন্দময়ী কালিবাড়ি মন্দির, তারকেশ্বর শিব মন্দিরগুলোতে এককালে রাজকীয়ভাবে পূজা অর্চনা হতো। পুরো রাজবাড়ীটি ছোট তরফ ও বড় তোরফ নামে দুই ভাগে বিভক্ত।
১২০ একরের এই কমপ্লেক্সে আরও রয়েছে ছোট বড় ৮টি ভবন। রাজপ্রাসাদের তোরণ পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলে প্রথমে চোখে পড়বে রাজবাড়ীর কামান। ১৭০৬-১৭১০ সালে নাটোর রাজবাড়ি নির্মিত হয়েছিল। তৎকালীন পুঠিয়ার রাজা দর্প নারায়ণের কাছ থেকে ১৮০ বিঘার একটি বিল দান হিসেবে গ্রহণ করেন রাজা রাম জীবন। পরবর্তীতে পুরো এলাকাটি সংস্কার করে গড়ে তোলেন এই রাজবাড়ী এবং আশেপাশের স্থাপনাগুলো। বর্তমানে বড় তরফ হিসেবে পরিচিত কমপ্লেক্সটিই ছিল রানী ভবানীর রাজপ্রাসাদ। রাজা রাম জীবনের একমাত্র ছেলে কলিকা প্রসাদ মারা গেলে তার দত্তক ছেলের সঙ্গে রানী ভবানীর বিয়ে দেন। শহরের বঙ্গজ্জল এলাকায় অবস্থিত এই রাজপ্রাসাদটি দেখতে প্রতিদিনই মানুষ ভিড় করে।

হালতি বিল। ছবি – আশিক সারওয়ার
একে ঘুরে ঘুরে দেখলাম সব স্থাপনা, এবার ঘরে ফেরার পালা। আজকের দিনের মতো ভ্রমণ শেষ, আমার স্মৃতিচারণও শেষ। যেহেতু কোনো হোটেল ঠিক করা নেই তাই রাজশাহীর বাসে উঠে যাব। মনে এক বুক ব্যথা নিয়ে উঠলাম চলন বিলটা দেখা হলো না। তবু জীবনানন্দের কবিতার শেষ চরণগুলো মনে মনে আওড়াতে লাগলাম-
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।