ঢাকার আশেপাশের মোটামুটি সব জায়গায় ঘোরা হয়ে গেছে। গাজিপুর তো গিয়েছি বেশ কয়েকবারই। এমনকি গাজিপুরের কালিয়াকৈর উপজেলাতেও গিয়েছি বন্ধুর বাড়িতে। কিন্তু তখনো জানতাম না, কালিয়াকৈরে চমৎকার কিছু জমিদার বাড়ি আছে। অন্তত দুটো জমিদার বাড়ির খোঁজ তো পেলামই। একটা হলো বলিয়াদি জমিদার বাড়ি, অন্যটা শ্রীফলতলী গ্রামের শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ি।

শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ি; Source: তাসমিয়া
ঢাকার কাছেই একটা জমিদার বাড়ির সন্ধান পেয়েছি, আর সেখানে যাবো না, তাই কি কখনো হয়? দিনক্ষণ দেখে চট করে গাজিপুরের বাসে চড়ে বসলাম। কালিয়াকৈর নেমে রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করছি, ‘জমিদার বাড়ি যাবেন?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘ছিবলতলী যাইবেন? ওঠেন।’ বুঝতে পারলাম, কঠিন বাংলা শব্দ শ্রীফলতলী লোকমুখে চলতে চলতে হয়ে গেছে ছিবলতলী।
রিকশা থেকে নেমেই প্রথমে চোখ গেলো, রংচঙা প্রবেশদ্বারটির দিকে। প্রধান ফটকটিকে নীল লাল রঙ করা হয়েছে। কী বেখাপ্পা যে দেখাচ্ছে! অতীতের একটা নিজস্ব রঙ আছে। সেই রঙের উপর এই ধরনের প্রলেপ খুবই বেখাপ্পা লাগে। মুড়াপাড়া জমিদার বাড়িতে গিয়েও দেখেছি, সংস্কার করতে গিয়ে সার্কাসখানা বানিয়ে ফেলেছে লাল হলুদ রঙ করে। যাই হোক, শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ির এই অংশের নাম খোরশেদ মঞ্জিল।

সোনালীরঙা বাড়ি; Source: তাসমিয়া
একটা বিশাল এলাকা নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল জমিদারবাড়ি। বিখ্যাত তালিবাবাদ পরগণার শ্রীফলতলীয নয় আনা অংশের মালিকানা নিয়ে গঠিত হয় এটি। কিন্তু বর্তমানে সেই বিশালত্বের অনেকখানিই কমে গেছে বর্তমান স্থানীয় বাসিন্দাদের দৌরাত্ম্যে। দোকানপাট বসিয়ে অনেকটাই দখল করে নেওয়া হয়েছে এখন। যেটুকু বাকি আছে, তার জন্য বর্তমানকালে একটা প্রবেশদ্বার স্থাপন করা আছে। শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ির কাছেই আছে তার নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি। সেসব বাড়িও দেখতে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল বাইরে থেকে। তবে সেখানে ঢোকার পথ বন্ধ।
জমিদার বাড়ির দুটি তরফ। বড় তরফ ও ছোট তরফ। দুই তরফের মাঝখানে মসজিদ। বড় দরজায় ভেতরে প্রবেশ করে বাম পাশে তাকালেই পাওয়া যাবে এই জমিদারদের বিস্তারিত বংশলতিকা। দাদা দাদী আর নানীর দিকের উভয় বংশলতিকাই বিস্তারিত দেওয়া আছে এখানে। ডান পাশে রহিম নেওয়াজ খান চেীধুরী এবং সৈয়দ মোফাজ্জল হোসেন চেীধুরীর কর্মযজ্ঞের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেয়া আছে ছবিসহ। সবই টাইলসের উপর আঁকা।

বারান্দা; Source: তাসমিয়া
প্রায় দুইশ বছর আগে মোঘল বাংলার বিখ্যাত ভূঁইয়াদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভাওয়াল গাজী। ভাওয়াল গাজীরা চার ভাই। ফজল গাজী, কাশেম গাজী, সেলিম গাজী ও তালেব গাজী। ভাওয়াল গড়ে এদের মূল রাজবাড়ি থাকলেও তালেব গাজী তাঁর বসবাসের জন্য গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার শ্রীফলতলী নামক স্থানে তাঁর জমিদার বাড়ী নির্মাণ করেন।
খোরশেদ মঞ্জিলের দেয়ালে যে ইতিহাস লেখা আছে, সেই হিসেব মতে, এই জমিদারদের প্রধান কর্ণধার খোদা নেওয়াজ খান। তিনি ভাওয়াল গাজীর উত্তরসূরী। খোদা নেওয়াজ খান বিয়ে করেন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মেয়ে আকরামুননেছাকে। এই দম্পত্তির ঘরে জন্ম নেয় ছয় কন্যা ও দুই পুত্র সন্তান। স্বভাবগতভাবে নরম মনের অধিকারী ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন জমিদার রহিম নেওয়াজ খান চৌধুরী তাঁরই কনিষ্ঠ পুত্র। তিনি টাঙ্গাইলের পাকুল্লার জমিদার বাড়ির কন্যা ফাতেমা খাতুন চৌধুরানীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। রহিম নেওয়াজ চৌধুরীর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তিনি ছিলেন তিন কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর বংশধারা টিকে আছে কন্যা সন্তান কৈশার বানু চৌধুরানীর মাধ্যমে।

কাঠগোলাপ গাছ; Source: তাসমিয়া
রহিম নেওয়াজ খান চৌধুরী জমিদারী পরিচালনায় তার নিজের কাচারি বাড়ির পাশাপাশি আধারিয়া বাড়ির বাগানবাড়িকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করতেন। তার জমিদারীর পরিসীমা গাজিপুর ছাড়িয়ে এই তিন পাশের তিন জেলা ময়মনসিংহ, নরসিংদি ও মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রায় ১০০ বছর আগে এই এলাকা তালিবাবাদ পরগনা নামে সাভার উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই জমিদারই এটিকে সাভার থেকে আলাদা করে ‘কালিয়াকৈর’ নামে নতুন থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

নতুন রেলিং; Source: তাসমিয়া
জমিদার বাড়ির দুই তরফের মধ্যে ছোট তরফের অবস্থা এখন বেশ ভালো। এখানকার যারা বসবাস করছেন, তারা ছোট তরফকে পশ্চিম তরফ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মূল জমিদার বাড়ির পুরোটাই উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আমার দেখা বেশিরভাগ জমিদার বাড়িরই বেহাল দশা হলেও এটি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিছু জায়গায় নতুন রেলিং লাগানো হয়েছে। তবে পুরনো বাড়িটির মরে যাওয়া সোনালী রঙ চমৎকার লাগছিল। দেড়তলা বাড়ির একধারে একতলা ছাদ দেওয়া। ছাদের রেলিংগুলোও খুব ভালো দেখাচ্ছিলো আমার চোখে।

সিঁড়ি; Source: তাসমিয়া
জমিদারদের মামার বাড়ি, নানার বাড়ির মাঝখানে রয়েছে মোঘলদের রীতিতে নির্মিত একটি মসজিদ। বাইরে থেকে নানাবাড়ি, দাদাবাড়িতে যাওয়ার পথ বন্ধ থাকলে ভেতর দিয়ে যাওয়ার উপায় আছে। তবে সময়ের অভাবে আর সেদিকে যাওয়া হয়নি। জমিদার বাড়িটির পুকুরটি অনেক বড়। এছাড়াও আছে বেশ পুরনো এক কাঠগোলাপ গাছ।

পুকুর; Source: তাসমিয়া
কীভাবে যাবেন
ঢাকা মহাখালি থেকে টাঙ্গাইলের যে কোনো বাসে কালিয়াকৈর বাজারে নামা যায়। গাবতলি সাভার রোড ধরে আসলেও অনেক বাস আছে। গুলিস্থান থেকে প্রভাতী-বনশ্রী পরিবহন কালিয়াকৈর আসে। সদরঘাট/গুলিস্থান থেকে আজমেরী পরিবহন চন্দ্রা পর্যন্ত আসা যাবে। পরে বাস বা টেম্পুতে কালিয়াকৈর। মিরপুর থেকে তিতাস পরিবহনে গাবতলি হয়ে চন্দ্রা। সাইনবোর্ড থেকে ঠিকানা বাসে চড়েও চন্দ্রা যাওয়া যাবে। তারপর অন্য বাস বা টেম্পুতে কালিয়াকৈর। কিন্তু এগুলা লোকাল বাস।
সবচেয়ে ভালো হয় উত্তরবঙ্গের কোনো বাসে কালিয়াকৈর নেমে পড়লে। সেক্ষেত্রে আগে থেকে ভাড়া মিটিয়ে নেয়া উচিৎ। ভাড়া ৬০/৭০ টাকার বেশি হবে না। সবচেয়ে ভালো রুট হলো মহাখালি থেকে টাঙ্গাইলের বাসে কালিয়াকৈর। কালিয়াকৈর বাজার এসে তারপর রিকশায় ২০/২৫ টাকা ভাড়া।
Feature Image: তাসমিয়া