বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। ছোট্ট এ দ্বীপটি দেশের মানুষের অসম্ভব প্রিয় একটি জায়গা। হবে না কেন? দেশের কোথাও যে আর এরকম নীল সমুদ্র আর গাঢ় সবুজাভ নীল স্বচ্ছ পানির দেখা মিলবে না। প্রতিটি ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরই ইচ্ছা করে কোনো এক পূর্ণিমার রাতে এ দ্বীপে থাকার জন্য, নীল সমুদ্রের পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখার জন্য।

পত্রিকার প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে গত ২৩ সেপ্টেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় এ দ্বীপে পর্যটকদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। আগামী ১ মার্চ ২০১৯ থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। পর্যটকদের ভারে ন্যুয এ দ্বীপে এ ধরনের পদক্ষেপ আরও কয়েক বছর আগে থেকে কথা উঠলেও শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি।
কেন এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে সরকার? সেন্ট মার্টিন প্রতিবেশগত সংকাটাপন্ন এলাকা (ইকোলোজিক্যালি ক্রিটিকাল এরিয়া)। এ ধরনের এলাকায় ঢালাওভাবে পর্যটন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটে চলেছে। প্রতিবছর শীতের সময় পর্যটকদের ঢল নামছে এ ছোট্ট দ্বীপে।

অক্টোবর-নভেম্বর মাসে জাহাজ চালু হবার সাথে সাথেই পর্যটকরা যেতে শুরু করে। প্রতিদিন গড়ে ৫,০০০ এর বেশি পর্যটক বেড়াতে যায়, যাদের অধিকাংশ অন্তত এক রাত দ্বীপে থাকেন। পর্যটকদের আবাসনের জন্য গড়ে উঠেছে ১০০ এর বেশি হোটেল-রিসোর্ট। অথচ পরিবেশ আইন অনুসারে এ দ্বীপে কোনো হোটেল-রিসোর্টই থাকার কথা না।
আগামী বছর থেকে পর্যটক সংখ্যাও নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে সরকার। এখন মৌসুমে ৫-৬টি জাহাজ টেকনাফ-সেন্টমার্টিনের মধ্যে চলাচল করে। সরকার চাচ্ছে এ সংখ্যা ২টিতে নামিয়ে আনতে। সর্বোচ্চ ৫০০ পর্যটককে একদিনে যেতে দেয়া হবে। তাদেরকে আবার দিনে দিনেই ফিরে আসতে হবে।
কিছু স্পর্শকাতর এলাকায় পর্যটকদের যেতে দেয়া হবে না। এগুলো হচ্ছে ছেঁড়া দ্বীপ ও গলাচিপা এলাকা। এ ছাড়া সমস্ত অবৈধ হোটেল ও রিসোর্টও অপসারনের চিন্তা করা হচ্ছে। যেখানে কোনো ধরনের বিল্ডিং তৈরীরই অনুমতি নেই সেখানে তিন তলা উঁচু বিল্ডিংও অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে।
দ্বীপের অবস্থা কতটা খারাপ আসলে? আমি বিগত তিন বছরে সেন্টমার্টিনে পানিতে ডুব দিয়ে হাতে গোনা জীবিত প্রবাল পাথর দেখেছি। অথছ দশ বছর আগেও এ দ্বীপে অনেক জীবিত প্রবালের দেখা মিলতো। ডিসেম্বরের শেষের দিকে অথবা তিন দিনের ছুটিতে এ দ্বীপে পা ফেলার জায়গাও থাকে না।

যারা এ দ্বীপে বেড়াতে আসে তাদের বেশিরভাগই পরিবেশ সংরক্ষণের ধার ধারে না। জাহাজে উঠেই পাখিকে চিপস খাইয়ে সে চিপসের প্যাকেট নদীতে সমুদ্রে ফেলার মধ্য দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু হয়। দ্বীপে এসে যত্রতত্র প্লাস্টিকের বোতল, বিস্কিটের প্যাকেট ইত্যাদি ফেলে চরমভাবে দূষিত করে এর পরিবেশ।
কিছুদিন আগে ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশের প্রায় ৫০ সদস্যের দল পরিস্কার করতে যায় সেন্ট মার্টিন। তারা ২ দিনে ১০০ বস্তার বেশি ময়লা কুড়িয়ে আনে। তাদের বর্ণনা আর ছবিতে দ্বীপের অবস্থা কিছুটা হলেও বোঝা যায়। সেখানে এখন যে পরিমাণ ময়লা-আবর্জনা পড়ে আছে তার ২০ ভাগও অপসারণ করা সম্ভব হয়নি।

তার উপর আগামী বছর থেকে রাতে থাকা যাবে না এ খবর শুনে এ বছর পর্যটকরা জাহাজ চালু হবার আগেই যাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। সমুদ্র শান্ত থাকায় ট্রলারে করে যাচ্ছেন সেন্ট মার্টিন। ২৬ অক্টোবর থেকে জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ার পর এখনই সেন্ট মার্টিনে ভিড় দেখা যাচ্ছে।
বিগত বছরগুলোতে প্রবাল পাথর অহরহ পর্যটকদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। দ্বীপের কিছু স্থানীয় ছেলেরা সমু্দ্র তলদেশ থেকে প্রবাল তুলে নিয়ে এসে সে সমস্ত প্রবাল পর্যটকদের কাছে বিক্রি করেছে। কী দুর্ভাগ্য আমাদের, পর্যটকরা দেদারছে মহামূল্যবান এ প্রবাল স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কিনে নিয়ে এসে তাদের বাসার ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রেখেছে।
এ ধরনের পর্যটকদের মাথায় একবারও আসে না এ দ্বীপটি প্রবালের উপরে টিকে আছে। এ প্রবাল ধ্বংস হলে দ্বীপটা একদিন হারিয়ে যেতে পারে দেশের মানচিত্র থেকে। দ্বীপের জীব-বৈচিত্রের অবস্থাও করুণ। পর্যটকরা গর্ত খুড়ে কাঁকড়াদেরও খেলার ছলে পা ভেঙে দেয় বা মেরে ফেলে।
সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়তে যাতে সমস্যা না হয় সে জন্য সেন্টমার্টিনে রাত নটার পর জেনারেটর চালানোর জন্য নিষেধাজ্ঞা আছে। পর্যটকদের চাপে হোটেল রিসোর্ট মালিকরা অন্তত রাত ১২টা পর্যন্ত চালু রাখছে জেনারেটর। কেউ কেউ আবার এক কাঠি সরেস, তারা চায় সারা রাতই চলুক জেনারেটর।

তিনদিনের বন্ধ পড়লে সেন্টমার্টিনে কোনো মাছই পাওয়া যায় না। জেলেরা তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে আশে পাশের সমুদ্র মোটামুটি ছেঁকে ফেলে। তাতেও পেট ভরানো সম্ভব হয় না পর্যটকদের, তখন টেকনাফ থেকেও মাছ নিয়ে এসে দেয়া হয় পর্যটকদের। সেন্টমার্টিনের আশেপাশে মাছের মজুদ আশংকাজনকভাবে কমে গেছে।
অথচ এই সেন্টমর্টিন হতে পারতো দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ পর্যটন কেন্দ্র। এখানে তৈরী করা যেত পরিকল্পিত সীমিত পরিমাণ ইকো রিসোর্ট। প্রথম থেকেই বহন ক্ষমতা অনুসারে জাহাজের টিকেট নির্ধারিত করে অনেক আগেই নিয়ন্ত্রণ করা যেত পর্যটন সংখ্যা। সীমিত সংখ্যক পর্যটককে কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশ ধরে রাখা যেতো।

বেশ কয়েক বছর ধরেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছে এ দ্বীপটিকে অন্তত তিন বছরের জন্য বন্ধ করে প্রবালগুলো নতুন করে জন্ম নেয়ার সুযোগ দেবার জন্য। সেটাতে কর্ণপাত না করে উল্টো পর্যটকদের দিনে যাবার ব্যবস্থা রেখে পুরো পর্যটন মৌসুমকে পাশ কাটিয়ে এ ধরনের ঘোষণা কতটুকু উপকারে আসবে তা এখন দেখার বিষয়।
রাতে আর থাকা যাবে না শুনে এ মৌসুমে পর্যটকদের শেষবারের মতো সুযোগ করে দিয়ে বিগত বছরগুলোর চেয়ে বেশি এ মৌসুমে ক্ষতি করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। দ্বীপটিকে যদি রক্ষা করার উদ্দেশ্যই থাকতো তবে সে ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল পর্যটন মৌসুম শুরু হবার আগেই। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী ঘটে দুর্ভাগা দেশের মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ এ দুর্ভাগা দ্বীপটির ভাগ্যে।