এবারের ভ্রমণটা সবদিক থেকেই আমাদের যন্ত্রণা দিয়ে যাচ্ছিল সেই শুরু থেকেই। অফিস, ছুটি, নির্বাচন এই সবকিছু মিলে। কলকাতা থেকে দিল্লি পৌঁছাতে পৌঁছাতেও আমরা জানতাম না যে, আসলেই দিল্লি নেমে আমরা কোথায় যাবো? অলি, নৈনিতাল, শিমলা-মানালি নাকি অন্য কোথাও? এইসব নানা কারণে অনিশ্চয়তার কারণে আর গাড়ি ঠিক করতে গিয়ে বিভিন্ন রকম ঝামেলায় একটি দিন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
অলি বাদ দেয়া হলো যেহেতু স্নোফল পাওয়া যাবে না। শিমলা আর মানালি বাদ দিয়েছিলাম কমন স্পট বলে। তাই শেষ পর্যন্ত নৈনিতালকে বেজ ধরে নিয়ে, কৌশানী যাবো আর সেই সাথে শেষ দুই দিনে রাজস্থানের জয়পুর দিয়ে শেষ করবো বলে তাৎক্ষনিক পরিকল্পনা করা হলো।

ধাবার প্রবেশ মুখ। ছবিঃ লেখক
একটা দিন নষ্ট হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুটা কষ্ট ছিল সবার মধ্যে। পরদিন খুব ভোরে আমাদের গাড়ি আমাদের নিয়ে যাত্রা শুরু করল একদম নতুন একটি পাহাড়ি শহরে। নতুন একটি শহরের স্বাদ নিতে চলেছি এটাই ছিল পথ চলার প্রথম আনন্দ। শীতের হালকা কুয়াশা ঘিরে রাখা রাজপথ দিয়ে হু হু করে ছুটে চলেছে আমাদের ছোট্ট গাড়ি।
৩০ মিনিট চলার পরে উত্তর প্রদেশের বিস্তৃত হাইওয়ে ধরে ছুটে চলার মাঝেই প্রথম সূর্যের ছোঁয়া পাওয়া গেল। আগের রাতের অল্প ঘুম, সারাদিনের মন মেজাজ খারাপ করা, হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া, সব মিলিয়েই সেই সকালেও সবার একটা ঝিমুনি ভাব। আর সেই ঝিমুনি ভাবের সাথে সকালের মিষ্টি রোদের পরশ পেয়ে এক যোগে সবার ঘুমের কোলে ঢলে পড়া।

ঘন কুয়াশায়। ছবিঃ লেখক
আধো ঘুমে আর আধো জাগরণের মধ্য দিয়ে ছুটে চলছিলাম। মোটামুটি এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই সবার বেশ ক্ষুধা অনুভূত হলো। ড্রাইভারকে জানিয়ে রাখা হলো ভালোভাবে খাওয়া দাওয়া করা যাবে এমন কোনো খাবার জায়গা পেলে যেন অবশ্যই দাঁড়িয়ে যায়। তবে তাকে আর একটা শর্ত দেয়া হয়েছিল। আর সেটা হলো খাবার জায়গাটা যেন শুধু খাবার জায়গাই না হয়।
যেন সেখানে নান্দনিকতা থাকে, যেন সেখানে প্রকৃতির ছোঁয়া থাকে, যেন সেখানে শুধু খেয়ে সময় না কাটিয়ে চারদিকটা উপভোগ করে সকাল বেলাটা মন ভরে উপভোগ করা যায়। এমন হতে হবে আমাদের খাবার জায়গা। কারণ এটি যে কোনো ভ্রমণে আমাদের সব সময়ের অলিখিত নিয়ম বা ভ্রমণ সূত্র।

সুরের উচ্ছ্বাসে। ছবিঃ লেখক
গাড়ি চলছে তো চলছে। কখনো ভোরের ঘিরে ধরা কুয়াশা ভেদ করে, কখনো কুয়াশা আর সূর্যের মাঝ দিয়ে, কখনো দুইপাশে সবুজ ক্ষেতের বুক চিরে, কখনো পুরোপুরি গ্রামীণ জনপদের ভেতর দিয়ে আর কখনো ধুসর কোনো প্রান্তর পেরিয়ে। সময়ের সাথে সাথে আমাদের ক্ষুধা বেড়ে যাচ্ছিল। ড্রাইভারকে আর একবার বলব, ঠিক এমন সময় হুট করেই গাড়ির গতি কমে গিয়ে, বামের সবুজ প্রকৃতি, সূর্যের হলুদ আলো আর চারপাশের বর্ণীল সাজে সজ্জিত একটি জায়গায় থেমে গেল।
ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি এটা একটা ধাবা। মানে আমরা যাকে হোটেল বলি আরকি। গাড়ির ভেতর থেকে দেখেই বেশ বনেদী আর অভিজাত ধাবা মনে হচ্ছিল। তাই নামবো, কি নামবো না সেই শঙ্কা কিছুটা মনে এসেই গিয়েছিল।

সুরের সাথে নান্দনিক আয়োজন। ছবিঃ লেখক
অবশেষে নেমেই পড়লাম সবাই মিলে। খাওয়া না হোক, আগে তো ফ্রেশ হয়ে নেই। তারপর না হয় দাম দেখে বুঝে অল্প কিছু খাবার আর চা খেয়ে উঠে পড়বো। অন্য কোথাও, একটু সাধারণ হোটেল বা ধাবা দেখে খেয়ে নিলেই হবে। তাই ঠিক হলো। কিন্তু গাড়ি থেকে নেমে সবাই চারপাশের পরিবেশ, আয়োজন, ভিন্ন রকম আতিথেয়তা, বাইরের লনেই সবার জন্য উন্মুক্ত জায়গায় দারুণ নান্দনিকভাবে সবকিছুর উপস্থাপন দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আর ঠিক করলাম, নাহ, নাহয় অল্প আর কমদামী দেখেই কিছু খাবো। কিন্তু এমন চমৎকার একটা জায়গায় কিছু সময় না কাটিয়ে, এমন দারুণ পরিবেশ একটু উপভোগ না করে, এমন আতিথেয়তা উপেক্ষা করলে পরে পস্তাতে হবে নিশ্চিতভাবেই। তাই সবাই যে যার মতো ফ্রেশ হয়ে উন্মুক্ত সবুজের গালিচায় পাতা টেবিলে বসে পড়লাম আয়েশ করে।
বসে পড়লাম যে বসেই রইলাম একদম সবাই একে একে ফ্রেশ হয়ে না আসা পর্যন্ত। কারণ সেই সময়টুকু মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিলাম পাশের সবুজ লনে কিছু স্থানীয় শিল্পী তাদের বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছনা ছড়িয়ে দিচ্ছিল পুরো ধাবার সবটুকু জুড়ে। কণ্ঠে মাঝে মাঝেই সুর তুলে সুরেলা করে তুলছিল পুরো পরিবেশ। নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের মাদকতায় কেউ কেউ বসে থাকতে না পেরে সম্মোহিত হয়ে উঠে গিয়ে নাচতে শুরু করেছিল অবলীলায়। আর একই সাথে সবার সঙ্গীত সুর তুলেছিল অতিথি মহলেও। সবকিছু মিলে মিষ্টি সকালের দারুণ রোমান্টিক একটা আয়োজন ছিল পুরো ধাবা জুড়ে, এর আনাচে কানাচে।

সুর ও সঙ্গীতের আয়োজন। ছবিঃ লেখক
এসব দেখতে দেখতে আমার মনে হলো যে এই ধাবা কি এই বাইরের সবুজ গালিচার এতটুকুই নাকি ভেতরেও বসার ব্যবস্থা আছে? ভাবতেই উঠে পড়লাম। ভেতরে গিয়ে দেখলাম আরও রাজকীয় পরিবেশ। বিশাল বিশাল সোফায় শরীর ডুবিয়ে দিয়ে অনেকেই আয়েশ করে খাবার উপভোগ করছে, সাথে আছে গল্প, আড্ডা আর গান।
বেশ দারুণ আয়োজন সব রকম মানুষের জন্যই। যাদের যেখানে ভালো লাগছে তারা সেখানেই বসে, শুয়ে আর আয়েশ করে নিজেদের সময় কাটাচ্ছে। আবারো ফিরে এলাম সবুজ গালিচার মুগ্ধতা ছড়ানো আঙিনায়।

আলু পরাটা ও মাখনের অপূর্ব স্বাদ। ছবিঃ সংগ্রহ
চারদিকের চেয়ার টেবিল আর অন্যান্য আসবাবে যে রঙ লেগেছে সেটা খেয়াল করিনি আগে। সবুজের মাঝে যেন সবকিছু মিলে একটা ঝলমলে আর বর্ণীল পরিবেশে সবাই বসে আছি। ততক্ষণে আমাদের খাবার অর্ডার দেয়া হয়ে গেছে। আলু পরাটা আর চা। আর সাথে তো নানা রকম আচার আছেই। এবং অবশ্যই এটাই সবচেয়ে কম দামী খাবার!
কিন্তু শুধু আলু পরাটাই যে এত স্বাদের হতে পারে ভাবতেই পারিনি। একটা প্লেট জুড়ে বিশাল এক আলু পরাটা। তার ঠিক মাঝখানে এক খণ্ড মাখনের টুকরো আমাদের সবার মুখেই হাসি ফুটিয়েছিল, দিয়েছিল দারুণ আনন্দ। আর সেই সাথে চা-টাও ছিল অসাধারণ। পেট পুরে খেলাম সবাই যতটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে খাওয়া যায় ততটা সময় নিয়ে।

বর্ণীল আয়োজন। ছবিঃ লেখক
কারণ খাবারের স্বাদের চেয়েও আমাদের কাছে বেশী স্বাদের, উপভোগের আর আনন্দের ছিল এই ধাবার পরিবেশ, প্রকৃতি, সাজ, আতিথেয়তা, আপ্যায়ন, সুর, সঙ্গীত আর সবকিছু মিলে এক জাদুকরী ব্যাপার। সবকিছু মিলে শিবা ধাবার সেই সকালটা ছিল, দারুণ মিষ্টি, রোমান্টিক আর মন ভালো হয়ে যাওয়ার মতো একটা মুগ্ধ সকাল।