পৃথিবীর এমন এক জায়গা আছে যেখানে সকালটা শুরু হতো কার্ফিউ দিয়ে আর দিনের সূর্য নামত ঝিলাম নদীতে লাশ ফেলার মাধ্যমে। শীতকালে চারদিকে যখন তুষারপাতের শুভ্রতা মায়া ছড়াতো, তখন সেই সাদা বরফে লাল রক্তের বন্যা বইতো। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত যে এলাকাটি হয়েছে তার নাম কাশ্মীর। কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের যে বিশাল বিবাদ তা কারোরই অজানা নয়। প্রচুর মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এ বিবাদে, হারিয়েছে সবচেয়ে কাছের মানুষদের।
দেশ ভাগের পর কাশ্মীরের সাথে কেবল বাইরের দুনিয়ার সম্পর্কই ছিন্ন হয়নি, বরং কাশ্মীরের ভেতরেও বন্ধ হয়েছিল অনেক সাধারণ মানুষের চলাচল। যখন ইউরোপিয়ানরা নিজেদের মধ্যে সকল যুদ্ধের অবসান ঘটাচ্ছিল, তখন দুটি দেশ ব্যস্ত ছিল নিজেদের ঘাটি শক্ত করতে, তারকাঁটার বেড়া বানাতে আর দূর্ভেদ্য দেয়াল গড়ে তুলতে।

কাশ্মীরে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মনে সর্বপ্রথম যে প্রশ্নটি জাগে বা জাগতো তা হলো “নিরাপত্তা কোনো সমস্যা হবে না তো?” গত পাঁচ দশক ধরে কাশ্মীর মালিকানা নিয়ে চলা এই বিবাদে কাশ্মীরের পর্যটন শিল্প নিয়ে মাথা পর্যন্ত কেউ ঘামায়নি। কিন্তু গত দশ থেকে পনেরো বছরে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে, সবচেয়ে অভূতপূর্বভাবে পরিবর্তিত হয়েছে পর্যটন শিল্প।
বিশ্বের মানুষ বিশেষ করে এই উপমহাদেশের নাগরিকরা হয়েছে ভ্রমণমুখী। নিজ দেশে ভ্রমণ শেষে উপমহাদেশের নাগরিকরা এখন বের হচ্ছে আশেপাশের দেশ ঘুরতে। কাশ্মীরেও বাড়ছে পর্যটকদের পদচিহ্ন। আর এরই সাথে কমছে মৃতের সংখ্যা, নিভছে অন্তর্দ্বন্দ্বের আগুন।

ভারতের দিক থেকে কাশ্মীর নিয়ে বারংবার জ্বলে ওঠা আগুনের আঁচ কমানোর চেষ্টা করা হয়েছে গত কয়েক বছর ধরে। গত দুই দশকে যে পরিমাণ মানুষ কাশ্মীর দ্বন্দ্বে মারা গেছেন তাতে ভারত সরকার বেশ নড়েচড়ে বসেছিল। দুই দেশের সব সিদ্ধান্তেই যখন অসামঞ্জস্যের দামামা বেজে চলেছিল, একটা জায়গায় এসে কেমন যেন সবাই একটু একমত হওয়া শুরু করল। ক্ষেত্রটির নাম পর্যটন খাত।
কাশ্মীরের মানুষ বুঝতে শুরু করলো তাদের মুক্তির একমাত্র পথ এই পর্যটন খাত। বুঝতে শুরু করলো আশেপাশের এমনকি উন্নত বিশ্বের প্রচুর পর্যটক কাশ্মীরে আসতে আগ্রহী, নিশ্চিন্তে কাশ্মীরের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে আগ্রহী। শুধু সাধারণ নাগরিকরাই নন, ভারতীয় ট্যুরিজম বোর্ডের কাশ্মীর জোনের কিছু মানুষ দিনরাত পরিশ্রম করে গেছেন যাতে কাশ্মীরের পরিস্থিতি পর্যটক সুলভ হয়।

১৯৯৫ সালে যেখানে ভয়ে ভয়ে প্রতি বছর কাশ্মীর ঘুরতে যেত মাত্র ৪.২ মিলিয়ন পর্যটক সেখানে এই সংখ্যা ২০১৩ সালে বেড়ে কত দাঁড়িয়েছে জানেন? ১৪০ মিলিয়নে! কাশ্মীরে এখন আর মানুষ জিম্মি হয়ে থাকে না। আকাশ-পাহাড়-হ্রদের অপরিমেয় সৌন্দর্যে পর্যটকদের সাথে স্থানীয় মানুষও বুক ভরে স্বাধীনতার বাতাস নেয় ফুসফুস ভরে। এখন আর নিয়ম করে কার্ফিউ হয় না, হলেও পুরো কাশ্মীরের কিছু কিছু অংশে হয়, সব অংশে নয়।
স্থানীয় মানুষজন এখন পর্যটন গাইড হিসেবে, ট্যুরিস্ট গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে অথবা পর্যটকদের কাছে কাশ্মীরের ঐতিহ্যবাহী শাল বিক্রিতে জীবনানন্দ খুঁজে নেয়। বছরের একটা সময় বাদে কাশ্মীরের শ্রীনগর, গুলমার্গ, সোনমার্গ ইত্যাদি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে প্রায় সবসময়ই। তবে পর্যটকদের পরিচয় গ্রহণ আর নিরাপত্তার প্রদান ক্ষেত্রে কোনোরকম ছাড় দেয়া হয় না কাশ্মীরে।

দ্বন্দ্ব, বিবাদ, রাহাজানি, লড়াই আর মতবিরোধের অবসান হয় একমাত্র যখন মনের সৌন্দর্যটা অক্ষত থাকে। আর মনের সৌন্দর্য অক্ষত থাকে তখনই যখন মানুষ প্রাণ দেয়া-নেয়া থেকে মনোযোগ সরিয়ে মনোযোগ দেয় প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার। আর এই ব্যাপারটাই কাশ্মীরের মানুষদের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিয়েছে। কাশ্মীরের তিনটি খুব জনপ্রিয় অঞ্চল হলো চায়না বর্ডার আগলে রাখা লাদাখ, পাহাড় আর সমতলের জাম্মু যা পাঞ্জাবের সাথে সংযুক্ত এবং অনিন্দ্যসুন্দর কাশ্মীর ভ্যালি। এই তিনটি অঞ্চলই ভারত পর্যটন শিল্পের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ ধরে আছে।
যে পরিমাণ সৌন্দর্য ধরে আছে এই তিনটি অঞ্চল তার ২৫ শতাংশও এখনো নষ্ট হয়নি। এখন ভারতের কাছে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের ঠিক পরেই গুরুত্ব পায় পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের ব্যাপারটি। আর গত কয়েক বছরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে কাশ্মীরকে, কাশ্মীরের পর্যটন শিল্প নিয়ে। কারণ এতে যেমন বাড়বে সরকারের রাজস্ব আয় তেমনি কমবে সহিংসতা, বাড়বে সৌহার্দ্য আর প্রীতি।

প্রায় পাঁচ দশক ধরে চলা যে দ্বন্দ্ব কোনো আলোচনা বা সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে শেষ করা যায়নি তা খুব সূক্ষ্ম একটা কারণে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, পর্যটক আর পর্যটন শিল্প। এর পেছনে দুই দেশেরই গুরুত্বপূর্ণ অনেক মানুষ কাজ করছেন যারা জানেন, বোঝেন একটা দেশের অর্থনীতিতে পর্যটনশিল্প কতটুকু অবদান রাখতে পারে। অর্থনৈতিক লাভের কথা চিন্তা করে হলেও কমে যাচ্ছে কাশ্মীর দ্বন্দ্বে মৃতের সংখ্যা। কমে যাচ্ছে দুই দেশের প্রতিটি জেলে আটকে থাকা কয়েদির সংখ্যা, কমে যাচ্ছে ঝিলাম নদীতে ভেসে থাকা লাশের সংখ্যা।
এই কৃতিত্ব এর অনেকটা অংশ পুরো বিশ্বের সকল পর্যটকদের প্রাপ্য যারা অজান্তেই খুব বড় একটা বিবর্তন, খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা শান্ত বিপ্লব ঘটিয়েছেন। এতে করে কাশ্মীরের স্থানীয়রা পেয়েছেন অর্থনৈতিক এবং মানসিক স্থিতি আর পর্যটকরা পেয়েছেন অপরূপা কাশ্মীরে নিশ্চিন্তে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ।

ধন্যবাদ জানাই বিশ্বের সকল পর্যটকদের আর পর্দার পেছনে দিন-রাত পরিশ্রম করে যাওয়া সেসব কর্মকর্তাদের যারা দুই দেশের বিবাদের মধ্যে পর্যটনশিল্পের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন সহিংসতারও ঊর্ধ্বে। বেশি বেশি ভ্রমণ করুন, দেশ ঘুরুন, বাইরের দেশে যান, চষে বেড়ান পুরো দুনিয়া। হয়তো কোনো একদিন আপনিও হয়ে যেতে পারেন শান্ত কোনো নিরব বিপ্লবের সাহসী অকুতোভয় বিশ্বমানের বিপ্লবী।
ফিচার ইমেজ- trtworld.com
It’ seems like to me a jannat… Kashmir is a place with a difference ….
It’ seems like to me a jannat… Kashmir is a place with a difference ….