১ম দিন
পুরুলিয়া রক ক্লাইম্বিং কোর্সের প্রথম দিনটি শুরু হয়েছিল বেশ নিয়মের মধ্য দিয়েই। প্রথমত আমরা ক্যাম্প সাইট থেকে কিছু খাবার দাবার খেলাম। খাবার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো রক সাইটে। রক সাইট বলতে যেখানে পাথরগুলো পাহাড় থেকে খসে খসে পড়েছে। সেখান থেকেই উৎপন্ন হয়েছে এই বিশাল রক সাইটের। ছোট বড় বিভিন্ন খাঁজকাটা খাঁজকাটা পাথরের মধ্যে দিয়ে আমাদের প্রথম দিন বোল্ডারিং করার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো।

ক্যাম্প থেকে রক সাইটে যাচ্ছে পুরো দল। ছবিঃ লেখক
শুরুর দিকটায় ৬০ থেকে ৭০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলের পাথরগুলো দেখলে বেশ ভয় ভয় লাগছিল মনের মধ্যে। কিন্তু এখানকার অভিজ্ঞ ইনস্ট্রাক্টররা যখন ভালোভাবে পাথরগুলোতে চড়া শিখিয়ে দিল, তার পর থেকেই আমাদের ভয় কমে আসছিল। আমরা যে কোনো ধরনের ছোটখাট বোল্ডার মানে যে কোনো ধরনের ছোটখাট পাথরে চড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাচ্ছিলাম।
প্রথম যে পাথরটি আমাদের চড়তে দেয়া হয়েছিল সেই পাথরটি ছিল মাটি থেকে ১০ ফিট উঁচু। পাথরের মাঝখানে ছিল খাঁজকাটা। কোল ঘেঁষেই আমাদের জন্য ছোট একটি পথ তৈরি করা হয়েছে উপরে উঠে যাওয়ার জন্য। পথ বলতে মূলত পাথরের কিছু হোল্ড আছে। পাথরের যেখানে ধরে ওঠা হয় সেই অংশগুলোকে হোল্ড বলা হয়।

টার্মিনোলজির প্রথম ক্লাস শুরু হয়েছে রক সাইটেই। ছবিঃ লেখক
প্রথমত আমাদের একটি ছোট টার্মিনোলজির ক্লাস হলো। যে ক্লাসে আমাদের শেখানো হলো কয়টি রুলস মেনে পাথরে উঠতে হয়। একটি গুরুত্বপূর্ণ রুলসের মধ্যে ছিল নাইন গোল্ডেন রুলস। এই রুলসে মূলত ৯টি টার্মিনোলজি থাকে। প্রথমেই শেখানো হয় একটি পাহরের সামনে দাঁড়িয়ে কীভাবে ওঠার প্লানিং করতে হবে।
এরপর কীভাবে প্রথমে একটি পা তুলে এবং হাতের হোল্ড খুঁজে সেটার উপর স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ানো যায়, সেরকম একটি পরিকল্পনা করে নিতে হবে। দ্বিতীয় রুলস, যখন আমরা পাথরে চড়বো তখন আমাদের হাত ও পায়ের তিনটি অঙ্গ সব সময় আমাদের ধরে রাখার কাজ করবে থাকবে এবং একটি অঙ্গ সব সময় মুক্ত অবস্থায় থাকবে যেটি দিক পরিবর্তন করতে সাহায্য করবে।

এভাবেই ছোট হোল্ড গুলো ধরে ওঠার সময় নিজেকে সাপোর্ট দিতে হয়। ছবিঃ লেখক
এবারের রুল হলো পাথর থেকে নিজের দেহকে দূরে সরিয়ে রাখা অর্থাৎ পাথরের কাছাকাছি যদি শরীর নিয়ে ক্লাইম্বিং করা হয় তাহলে শরীরের কোনো অংশে এই ধারালো পাথরে ঘষা লেগে ছিলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যদি বিপদজনক স্নোপ হয় তাহলে সামান্য কেটে যাওয়ার জন্য উপর থেকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এরপরে যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হয় সেটি হচ্ছে, যে হোল্ড আপনি ধরবেন সেটি বারবার পরীক্ষা করে নেবেন, সেটি ধরে ওঠার মতো কিনা ও ভর দেওয়ার পর সেটি আপনার ভরে ভেঙে পড়ে কিনা।
এরপর আরেকটি টার্মিনোলজি হলো হাতকে কাঁধের খুব বেশি উপরে নেওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে যখন হাত উপরে তুলে ক্লাইম্বিং করার জন্য চেষ্টা করা হয় তখন হাতের উপরের দিকে রক্ত চলাচল কমে যায়। এর ফলে হাতের শক্তি কমে যায়। এর জন্য হাতকে নিজের কাঁধের উপরে খুব বেশি না নেয়ার প্রচেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

আই বোল্ডারগুলোতেই চড়তে শেখানো হয়। ছবিঃ লেখক
এরপরের টার্মিনোলজিটা হলো নিজের হাত বা পা একটির সাথে আরেকটি কখনো ক্রস করা যাবে না। অর্থাৎ একটি হাতের উপর দিয়ে আর একটি হাত অথবা একটি পায়ের উপর বা নিচে দিয়ে আরেকটি পা কখনো নেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে ফল করার সম্ভাবনা বেশি থাকে সামান্য মুভমেন্টে। অষ্টম টার্মিনোলজি হলো, নিজের শক্তিকে সঞ্চয় করে রাখা। অর্থাৎ কীভাবে উঠলে আপনার শরীরের শক্তির সাথে সামঞ্জস্য রেখে আপনি ক্লাইম্ব করতে পারবেন সেটি অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে।
নবম অর্থাৎ গোল্ডেন রুলসের সর্বশেষ টার্মিনোলজি হলো নিজের স্টাইল ঠিক করে তালে তালে ওঠা। অর্থাৎ নিজের নিঃশ্বাস এবং শরীরের মুভমেন্টের সামঞ্জস্য রেখে দ্রুততার সাথে উপরে উঠে যেতে হবে এটি হচ্ছে সর্বশেষ টার্মিনোলজি, এর নাম ক্লাইম্ব রিদমলি।

পাথরের উপর হাঁটার প্র্যাকটিস এখানেই করানো হয়। ছবিঃ লেখক
টার্মিনোলজি ক্লাস শেষের পর আমাদের রক সাইটে নিয়ে গিয়ে বেশ কিছু বোল্ডারিং দেখানো হলো। আমরা সফলতার সাথে গোল্ডেন রুলসগুলো অনুসরণ করলাম। পাঁচ-ছয়টা বোল্ডার আলাদাভাবে করার পর আমাদের দুপুরে খাবারের জন্য ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হলো। সেদিনের মতো আমরা রক সাইটে আর তেমন কোনো একটিভিটি করিনি।
কিন্তু ক্যাম্পে ফেরার পর আমরা বেশ কিছু রোপ প্র্যাকটিসিং করলাম, ইকুইপমেন্টের সাথে পরিচিত হলাম, বেসিক ফটোগ্রাফি রুলস এবং বেশ কিছু মাউন্টেনিয়ারদের সাথে তাদের অভিযান সম্পর্কে গল্প শোনার পর সেদিনের মতো আমাদের ক্যাম্পের সকল কার্যক্রম শেষ হলো।

তিলাবনি পাহাড়ের পাশেই আমাদের ক্যাম্প। ছবিঃ লেখক
আগে যখন ক্লাইম্ব নিয়ে ভাবতাম এবং টিভিতে বা ইন্টারনেটে বিভিন্ন ধরনের ভিডিও দেখতাম, তখন মনে হতো ক্লাইম্বাররা মনে হয় শুধুমাত্র শরীরের শক্তি দিয়েই উপরে উঠে থাকেন। সাধারণত হাতের পেশির জোরে বা পায়ের পেশির জোরে তার উপর উঠে থাকেন। কিন্তু প্রথম দিন এখানে এসে আমার ধারণা সম্পূর্ণ রূপে পাল্টে যায়। প্রথমত ইনস্ট্রাক্টরদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আমরা শিখতে পারি আসলে কোন ধরনের টেকনিক ব্যবহার করে সহজে উপরের দিকে উঠা যায়, শরীরের উপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করে কীভাবে পাথরে বা পাহাড়ে ক্লাইম্ব করা যায়।

ইকুইপমেন্ট পরিচিতির ক্লাস চলছে। ছবিঃ লেখক
এছাড়া এখানকার ক্যাম্পের পরিবেশ মনে অনেক শান্তি যোগায়। চারদিকে এতগুলো মানুষের কোলাহল, পরিচিত-অপরিচিত সকল মানুষের সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে এই ক্যাম্পের পরিবেশটা আসলেই অনেক সুমধুর হয়ে উঠেছিল।
আর রাতের বেলা তিলাবনি পাহাড়ের পেছন দিয়ে যখন বিশাল আকারের চাঁদ উঁকি দেয়। আমাদের ক্যাম্প সাইটে তখনকার সেই স্মৃতি, সবাই মিলে গাওয়া গান, গল্প, আড্ডার স্মৃতি এগুলো সারাজীবন মনের মধ্যে গেঁথে রাখার মতো।

এই বাতিগুলো জ্বালিয়ে আলোকিত রাখা হয় ক্যাম্প সাইট। ছবিঃ লেখক
সবকিছুই রুলসে বাধা ছিল এখানকার। সকাল পাঁচটা থেকে শুরু করে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত, কখন কে কী করবে সবকিছুই কমবেশি রুটিনে বাঁধা ছিল। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। প্রথমদিন আমাদের ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করে সকলকে ঘুমাতে যেতে বলা হলো এবং ইনস্ট্রাক্টরের কড়া আদেশ ছিল, যদি রাত ৯টা ৩০ এর পর কাউকে টেন্টের বাইরে দেখা যায় অথবা কোনো টেন্টে আলো জ্বলতে দেখা যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তো আমরা রুলস মেনে সেই কাজই করলাম। খাবার খেয়ে যার যার টেন্টে চলে গেলাম। আর সারাদিনের খাটনিতে শরীর যে পরিমাণ ক্লান্ত ছিল, এর মাঝেই কখন ঘুমে চোখ ভেঙে এলো তা কেউই হয়তো বুঝতে পারেনি সেদিন।