নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কলকাতা থেকে ব্যাংককের বিমান ভাড়া মাত্র ৪৫ ডলার! সেবার বোর্ডিং স্কুলের বন্ধুদের রিইউনিয়নে গিয়েছিলাম কলকাতায়। ছোটবেলাতেই আমাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। তাই বলে ভাববেন না, খুব দুষ্টু ছিলাম। আদতে বাবা-মায়ের বন্ধুমহলে অনেকের ছেলে-মেয়েই ভারতে বোর্ডিং স্কুলে পড়তো। অগত্যা দেখাদেখি আমাকেও যেতে হলো। কার্শিয়ংয়ের স্কুলের পথে সঙ্গী হলো দুই মামাতো ভাই। স্কুলের নাম লিটল ফ্লাওয়ার। সে অন্য গল্প, বোর্ডিং স্কুলের দিনগুলো নিয়ে আরেকদিন বলবো।

তো সেই রিইউনিয়ন, সেখানে স্কুলের অনেকেই এসেছিল। তবে অরিজিত গেট টুগেদারে আসতে পারেনি। অরিজিত সরকার। স্কুলের সব থেকে গেছো স্টুডেন্ট। ডরমেটরির ল এন্ড অর্ডার ভাঙতে ওর জুড়ি ছিল না। সে বাঁদরামিকে এক রকম শিল্পের পর্যায়েই নিয়ে গিয়েছিল। তাই বন্ধু মহলেও বেশ সম্মান ছিল অরিজিতের। নিজেকে নিয়েই ছড়া গেঁথেছিল-
‘অরিজিত সরকার, গাছে ওঠা দরকার
গাছ থেকে পড়ে গেলে, ওষুধের দরকার
ওষুধ নাই ঘরে, টাকা চুরি করে
দশ দিন পরে, জেল খেটে মরে।’

বুঝতেই পারছেন ছেলেবেলা থেকেই মহাশয়ের হিউমার অতি উচ্চ লেভেলের। এত বছর পরও সবাই ওর অনুপস্থিতি অনুভব করছিলাম। গেট টুগেদার শেষে হোটেলে ফিরতে বেশ রাত হলো। সবার সঙ্গে এত বছর পর দেখা হয়ে স্বভাবতই স্মৃতিগুলো তাজা হয়ে উঠেছিল। স্কুলের দিনগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়লাম। তাছাড়া সারা দিনের দৌড় ঝাপ আর জার্নির ক্লান্তিতে অবসন্ন ছিলাম। পরদিন ভোরে বাইরের হট্টগোলে ঘুম ভাঙল।

আধো ঘুমের ঘোরে দরজা খুলতেই দেখি, অরিজিত! সে হোটেল বয়কে বেশ করে বকছে। ঘোর কাটতেই হট্টগোলের কারণ স্পষ্ট হলো। অরিজিত রুমের ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছে। কিন্তু হোটেল বয় নিজ কর্তব্যে চুল পরিমাণ ছাড় দিতে রাজি নয়। তার কথা সে নক করে আগে আমাকে ঘুম থেকে তুলবে, তারপর অরিজিতকে রুমে ঢুকতে দেবে। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি চলছিল। এতক্ষণে অরিজিতের চোখ আমার উপর পড়লো। মুহূর্তের মধ্যে এক রকম লাফিয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরলো ও।
জড়িয়ে ধরলো বললে ভুল হবে, সে আমার উপর তখন চড়েই বসেছিল। বয় বেচারা অবস্থা দেখে বুঝতে পারলো এতক্ষণ কোন পাগলের সঙ্গে সে বাক্য ব্যয় করেছে। আসলে অরিজিতের উদ্দেশ্য ছিল ঘুমন্ত অবস্থায় আমাকে ফেলে দেবে। তারপর বেডে উঠে দাঁত দেখিয়ে হাসবে। স্পষ্ট মনে পড়ে ডরমেটরিতে সে এরকম প্রায়ই করতো। এত বছর পরেও এই লোভটা ছাড়তে চায়নি। ভাবলাম এই কারণেই বুঝি সকাল সকাল মহোদয়ের আগমন।

রুমে ঢুকেই অরিজিতের প্রথম কথা ‘ব্যাংকক যাবি’? সবে তো ঘুম থেকে উঠেছি, তার উপরে এই হট্টগোল। আর এতদিন পর অরিজিতকে দেখার রেশ তখনো কাটেনি। ভুলেই গিয়েছিলাম, ব্যাংকক যে থাইল্যান্ডে, বলে ফেললাম চল যাই! ব্যাংকক যাওয়া যেন নিউমার্কেটে গিয়েছি, সঙ্গে নীলক্ষেত থেকে বইও কিনে নিয়ে যাই। অরিজিত আমার দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর ল্যাপটপ বের করে মডেম কানেক্ট করতে করতে বলল ফ্রেশ হয়ে নে, এখনই বের হব।
মুখ হাত ধুচ্ছি তখন মনে পড়লো কী ভুলটাই না করলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, অরিজিত বুদ্ধিমান ছেলে, ভুলটা সে বুঝেছে বলেই আমার ধারণা। হঠাৎ রুম থেকে অরিজিতের চিৎকার শুনতে পেলাম। দ্রুত বের হলাম, দেখলাম ও উদভ্রান্তের মতো লাফাচ্ছে আর ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলছে। তবে ওকে বেশ খুশি দেখাচ্ছে। বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতে ল্যাপটপের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলো। এবারে ওর কাজ কারবার একটু বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিল। ভাবলাম মাথায় কোনো গণ্ডগোল হয়েছে কিনা, কে জানে। ল্যাপটপের মনিটরের দিকে তাকিয়ে আমার চোখও ছানাবড়া। কলকাতা-ব্যাংককের এয়ার টিকিট মাত্র ৪৫ ডলার! আর আশেপাশে যে ডিলগুলো দেখলাম তার একটাও ১৫০ ডলারের নিচে না।

জিজ্ঞেস করলাম, তুই এই ডিল কীভাবে পেলি? সে জানালো এটা তার ভ্রমণ সাধনা। কত সাধনার কথাই শুনেছি, তার সঙ্গে নতুন একটা সাধনাও যুক্ত হলো। গত ৩ দিন ধরেই সে নাকি বিভিন্ন সস্তা ফ্লাইটের সাইটগুলোতে এরকম ডিল খুঁজছে। আমি নাকি তার জন্য লাকি, তাই এখানে এসে ডিলটা পেল।
জিজ্ঞেস করলাম কিউরিয়াস মাইন্ড ওয়ান্টস টু নো, তুই হঠাৎ ব্যাংকক যাবি কেন? ও বলল ‘হঠাৎ কই, আইএম ইনটু ট্রাভেলিং, ইউ নো।’ ওই বছরই নাকি সে ৬টা দেশে দুই মাস ধরে ঘুরেছে। এতে নাকি তার খরচ হয়েছে মাত্র নয়শ ডলার! এরপর আমাকেও ঘোরার জন্য উৎসাহ দিতে শুরু করলো। বুঝলাম বন্ধুটি বেশ ট্রাভেলার হয়ে উঠেছে। নয়তো ঢপ মারছে। তবে তার কথাবার্তায় অভিজ্ঞতার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

ব্যাপারটা কনফার্ম করতে জিজ্ঞেস করলাম বাসার সবাই কেমন আছে। অরিনদি মানে ওর বড় বোন কী করছে? এই সব সাধারণ খোঁজখবর। ওর গল্পে ব্যাঘাত পড়লো। তবে সে পিছু হটার পাত্র নয়। শুধু বলল, ভাল, সবাই ভালো আছে। আবার পুরো দমে নিজের গল্পে ফিরে গেল। কীভাবে সে মালয়েশিয়াতে তানদেম স্কাই ডাইভিং করেছে। মনে মনে ভাবলাম, ৬ তলা দালানের ছাদ থেকে তাকাতেই ভয় লাগে, আর তিনি আমাকে শোনাচ্ছেন স্কাই ডাইভিং এর গপ্পো! বেরসিকের মতোই বললাম, তোর মনে আছে, অরিনদি আমাদের জন্য টিফিন ব্রেকে খাবার নিয়ে আসতো। ফেসবুকে দিদির বেবির ছবি দেখলাম।
এবারে সে কোনো কথা বলল না। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর মোবাইল বের করে কাকে যেন কল করলো। ফোনে শুধু বলল ‘এই নে কথা বল’ তারপর ফোন সোজা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। ওপাশ থেকে হ্যালো শুনতেই বুঝতে পারলাম অরিনদি! ওর এমন কাজে আমি এতটাই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। এর কারণও যৌক্তিক, দিদির সঙ্গে কম করে হলেও ১০ বছর কোনো কথা হয়নি। নাম বলতেই দিদি চিনতে পারলো। বলল অরিজিত বলেছে আমি কলকাতা আসছি, তাই তাকে যেতেই হবে। পরশুই নাকি দিদিদের ওখানে গিয়েছে সে।
শুনেছিলাম দিদিরা কলকাতার সল্ট লেকেই থাকে। ওনার কাছে জানতে পারলাম তারা আবার কার্শিয়ং শিফট করেছে। আর অরিজিত দিদির বাসা থেকেই এসেছে। এছাড়া এতক্ষণ যা বলেছে তার সবটাই সত্যি। বলে রাখি কলকাতা থেকে কার্শিয়ংয়ের দূরত্ব ৫৮৭ কিলোমিটার! আর অরিজিত ছোটবেলার এই অধম বন্ধুটির সঙ্গে শুধু দেখা করতে দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টা জার্নি করে কলকাতা এসেছে।

ফোন রাখতে রাখতে ভাবলাম, আমার মনে যা চলছে, ওকে বুঝতে দেব না। বললাম সকালের নাস্তা করতে করতে তোর বকবক শোনা যাক। এমনিতেও কথা শেষ হবে না। ফোনটা ফেরত দেওয়ার সময় খেয়াল করলাম ও মুচকি হাসলো। অরিজিত বিকেলের দিকে বলল চল কার্শিয়ং যাই, স্কুলটা দেখে আসি। ইচ্ছে আমারও ছিল। তাই না করতে পারলাম না। ভুলের সেই শুরু। কার্শিয়ং পৌঁছলে শহরটা ঘুরে দেখলাম। স্কুলেও গিয়েছিলাম। এর পর সরল মনে কার্শিয়ং আসার খেসারত দিতে হলো। প্রথমে দার্জিলিং তারপর কাঞ্চনজঙ্ঘা যাওয়ার বায়না ধরলো অরিজিত। বুঝলাম পরেছি বাঁদরের হাতে পাহাড় বাইতে হবে সাথে।
ফিচার ইমেজ- ytimg.com
আচ্ছা ভাইয়া সল্ট লেকটা কোন যায়গাতে অবস্থিত? বেনাপোল দিয়ে ভারতে প্রবেশ করলে কিভাবে সল্ট লেক যেতে পারবো জানাবেন আশাকরি। এছাড়া হাওরা স্টেশন রেল স্টেশন বা হাওরা ব্রিজ কিভাবে যাওয়া যাবে? আশাকরি জানাবেন। ধন্যবাদ।
বাংলাদেশীরা কি কলকাতা অথবা ভারত এর যে কোন বিমানবন্দর ট্রানজিট করে থাইল্যান্ড অথবা ইন্দোনেশিয়া যেতে পারবে!?