প্রকৃতির অপার রূপলীলায় বিমোহিত মানুষদের কাছে সবসময়ের জন্যই আকর্ষণীয় স্থান হলো ঝর্ণা বা জলপ্রপাত। প্রকৃতির অনবদ্য এই সৃষ্টি দেখতে প্রতিদিন হাজারো রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটক দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত রাঙ্গামাটি জেলায় পাড়ি জমায়।
রাঙ্গামাটি জেলা আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় জেলা এবং সম্পূর্ণ জেলাটিই উঁচুনিচু পাহাড় আর কাপ্তাই লেকের অকৃত্রিম সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। আজ থাকছে এই জেলার অন্তর্গত সুন্দর দুটি সুন্দর ঝর্ণা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা।

মুপ্পোছড়া ও ন’কাটা ঝর্ণা
রাঙামাটির জেলার বিলাইছড়ি উপজেলার বাঙ্গালকাটা নামক জায়গায় অবস্থিত মুপ্পোছড়া ও ন’কাটা ঝর্ণা ভ্রমণপিপাসুদের কাছে বেশ জনপ্রিয় দুটি ঝর্ণা। দুটোই তাদের সৌন্দর্যের স্বমহিমায় যে কোনো প্রকৃতি প্রেমিককে মুগ্ধ করবে।
ঝর্ণা দুটি একই ঝিরিপথে পাহাড়ের ভিন্ন জায়গায় অবস্থিত বলে ভ্রমণকারীরা সাধারণত একই দিনে দুটি ঝর্ণা ভ্রমণ করতে পারেন। তুলনামূলকভাবে প্রস্থের দিক থেকে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ঝর্ণা হলো মুপ্পোছড়া ঝর্ণা। ন’কাটা ঝর্ণা এতটা বড় না হলেও এর পানির তীব্রতা মুপ্পোছড়াকেও ছাড়িয়ে যায়।

যেভাবে যাবেন
কাপ্তাই লেকের প্রান্তে অবস্থিত বিলাইছড়ি উপজেলার সাথে সদর উপজেলার সরাসরি কোনো স্থলপথ না থাকায় ঝর্ণাগুলোয় যাওয়ার একমাত্র উপায় জলপথ। কাপ্তাই ঘাট হতে রিজার্ভ কিংবা লোকাল ট্রলারে করে বিলাইছড়ি যেতে হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে প্রতিদিন সকাল সাড়ে আটটায় বিলাইছড়ির উদ্দেশ্যে কাপ্তাই হতে লোকাল ট্রলার ছেড়ে যায়। একদিনের জন্য রিজার্ভ ট্রলারের ভাড়া নেবে ১,৫০০-২,০০০ টাকা। লোকাল ট্রলার ভাড়া জনপ্রতি ৬০ টাকা।

বিলাইছড়ি-মুপ্পোছড়া
দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় বিশাল কাপ্তাই লেকের বুক চিরে পৌঁছে যাবেন বিলাইছড়িতে। বিলাইছড়ি বাজারে হালকা নাস্তা সেরে ঘাট থেকে গাইড ঠিক করতে হবে। গাইড খরচ ৫০০ টাকা। অতঃপর আবার ট্রলারে চড়ে যেতে হবে মুপ্পোছড়া ঝর্ণায় যাওয়ার মূল হাঁটার রাস্তায়।

দুই পাশে ফসলের মাঠ, তার মাঝখানের ছোট আইল ধরে কিছুদূর যাওয়ার পরেই শুরু হয় পাহাড়ি বন্ধুর রাস্তা। বেশ কয়েকটি পাথুরে ঝিরিপথ পাড়ি দিয়ে অনেকবার পাহাড়ে উঠতে ও নামতে হবে। কোনো কোনো পাহাড় প্রায় ৮০ ডিগ্রী খাড়া। দুর্গম এই পথের কথা চিন্তা করলে গায়ে এখনো শিহরণ জাগে।
যাই হোক, প্রায় দুই ঘণ্টার ট্রেকিং করে পৌঁছে যাবেন অসীম সৌন্দর্যের অধিকারী মুপ্পোছড়া ঝর্ণায়। বেশ কয়েকটি স্টেপে সাজানো এই ঝর্ণার বিশেষত্ব হলো পাহাড়ি লতার সাহায্য নিয়ে ঝর্ণার ঠিক মাঝখানে পৌঁছে যেতে পারবেন। একটু ঝুঁকিপূর্ণ হলেও এর উপরে ওঠার রোমাঞ্চকর অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ।

মুপ্পোছড়া-ন’কাটা
মুপ্পোছড়ায় ঘণ্টা খানেক সময় কাটিয়ে ফিরতি একই পথ ধরে বেশ কিছুটা পথ আসার পর হাতের ডানে একটি সরু ও পিচ্ছিল রাস্তা ধরে নিচে নামলেই ন’কাটা ঝর্ণা। তবে এই সরু পাহাড়ি রাস্তাটি এতটাই খাড়া ও কর্দমাক্ত যে আমরা প্রায় সবাই কাদায় মাখামাখি হয়ে যাই।
কোনোমতে সেই কঠিন পথ পেরিয়ে যখন ন’কাটার দেখা পাই স্তব্ধ হয়ে যাই এক মুহূর্তের জন্য। এতটা বিশাল না হলেও সৌন্দর্যের দিক থেকে ঝর্ণাটি মুপ্পোছড়াকেও ছাড়িয়ে গেছে। পানির তীব্রতা এখানে এতটাই বেশি, যে পানির নিচে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে মাথা ব্যথা ধরে যায়। পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়।

এখানে বলে রাখি, ন’কাটা ঝর্ণার নিচের দিকটা পাথুরে সমতল বলে পানির তীব্র প্রবাহ থাকা সত্ত্বেও এখানে কোনো খাদের সৃষ্টি হয়নি। তাই খুব সহজেই এই ঝর্ণার একদম নিচে চলে যাওয়া যায়। পানির তীব্র ধারায় নিজেকে ভিজিয়ে প্রকৃতির হিংস্রতাকে অনুভব করা যায় একদম কাছ থেকে।
তবে সৃষ্টিকর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ দিতে ভুলবেন না, কারণ যে পথে ন’কাটা ঝর্ণা এসেছেন সেই পথ ধরে উঠতে হবে না। গাইড এবার আপনাকে পাহাড়ি ঝিরি ধরে নিয়ে আসবে। তবে আগের পথ থেকে তুলনামূলক সহজতর হলেও পিচ্ছিল পাথরে উপর পথ চলতে বেশ বেগ পেতে হয়। এখানে সাবধানতার বিকল্প আর কিছুই নেই। একটু উনিশ থেকে বিশ হলেই ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা।

সব বাধা পেরিয়ে গাইডের দক্ষ নেতৃত্বে আবারও সেই গ্রামের মেঠোপথে এসে আমরা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। শরীরের উপর এতটা অমানুষিক পরিশ্রম আর কখনো হয়েছে বলে মনে পড়ে না। যাই হোক, ট্রলারে উঠে আবারও বিলাইছড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। সেখান থেকে কাপ্তাই।
সবশেষে একটি দুঃখজনক ঘটনা বলে শেষ করব। আমরা মুপ্পোছড়ায় ঝর্ণায় যাওয়ার পর সেখানে আরেকটি গ্রুপ এসে পৌঁছে। আমাদের সামনেই গ্রুপটি কলার খোসা, ডিমের খোসা সহ ময়লা আবর্জনা ঝর্ণায় ফেলছিল।

দেখে স্থানীয় মনে হওয়ায় ইচ্ছা থাকলেও আমরা প্রতিবাদ করতে পারিনি। প্রতিনিয়ত আমাদের নিষ্ঠুরতার বলী হচ্ছে আমাদের সুন্দর প্রকৃতি। নষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য।
কবে শুধরোবো আমরা, কবে সচেতন হবো আমরা? জানা নেই।
বিঃদ্রঃ পাহাড়ে ওঠা ও নামার জন্য বাঁশের লাঠি ব্যবহার করুন। পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ, তাই ট্রেকিং শ্যু পরা আবশ্যক। যথাসম্ভব হালকা জামাকাপড় পরিধান করুন। যেকোনো পচনশীন ও অপচনশীল আবর্জনা ব্যাগে সংরক্ষণ করুন। সর্বোপরি প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করুন। হ্যাপি ট্রাভেলিং।