ছোট্ট একটি দেশ আমাদের বাংলাদেশ। কিন্তু রূপে সে অনন্য। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ একটি বদ্বীপ হলেও অল্প কিছু পাহাড় পর্বতের ভাগীদার সে। এমনই একটি পাহাড়ি জেলা খাগড়াছড়ি। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সীমান্তবর্তী এই জেলাটি তার মোহনীয় সৌন্দর্যের জন্য অনবদ্য। এই এলাকাটি আগে কার্পাস মহল নামে পরিচিত ছিল। পরে নদীর নামে এর নাম হয় খাগড়াছড়ি।
পাহাড়ি নদী খাগড়ার দুপাশে ছিল নলখাগড়ার বন। আর জলধারাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ছড়া বা ছড়ি। এই ছড়ার নিকটবর্তী নলখাগড়ার বন পরিষ্কার করে গড়ে উঠেছিল প্রথম জনপদ। তাই এই এলাকার নাম খাগড়াছড়ি।

খাগড়াছড়ির একটি উপজেলা রামগড়। অপরূপ খাগড়াছড়ির পার্বত্য সৌন্দর্য যেন তার পূর্ণরূপ পেয়েছে এই রামগড়ে এসে। আছে দুর্গম পাহাড়, বুনো অরণ্য, সাজানো চা বাগান, গতিশীল ঝর্ণাধারা আর বৈচিত্র্যময় নৃতাত্ত্বিক সৌন্দর্যের হাতছানি।
আজ আমরা ঘুরে আসব রামগড় চা বাগান থেকে।এই সীমান্ত শহরে ঢুকতেই পাবেন ১,৪০০ একরের বিশাল রামগড় চা বাগান। পঞ্চাশের দশকে স্থাপিত এই চা বাগান থেকে প্রতিদিন ১৬ হাজার কেজি সবুজ পাতা উত্তোলন করা হয়। বাগানের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে প্রকাণ্ড লেক।
পুনঃসংস্কারকৃত এই লেক শীতকালে ভরে যায় পাখির কলকাকলিতে। হাজার হাজার অতিথি পাখি আশ্রয় নেয় এই লেকে। দেশের অনেক পাখিপ্রেমী এই সময় ভিড় জমায় এখানে। আপনার পাখিপ্রেমী হওয়ার প্রয়োজন নেই, যদি ন্যূনতম প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে থাকেন তাহলে বিমোহিত হয়ে যাবেন এই সৌন্দর্যে। রামগড় বাগানের মধ্য দিয়ে চলে গেছে ফেনী-খাগড়াছড়ি সড়ক। এই পথে ছুটে চলা হাজারো যাত্রীর দেহ মন প্রাণ জুড়িয়ে দেয় রামগড় চা বাগান।
আপনি যদি ঘুরতে ঘুরতে একটু এদিক-ওদিক চলে যাওয়ার অভ্যাস থাকে, তাহলে কিন্তু সাবধান থাকবেন। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে চা বাগানের ছায়াদায়ী যে গাছের তলায় বিশ্রাম নেবেন, সেটিকে ভালো করে পরখ করে নেবেন কিন্তু। কে জানে, হয়তো সেই গাছের উপরে পাতার ফাঁকে লুকিয়ে আছে প্রকাণ্ড অজগর সাপ! অত্যুক্তি মনে মনে হলেও এটাই সত্যি। কারণ এইসব বাগান থেকে মাঝে মাঝে উদ্ধার করা হয় অজগর সাপ।

আর আদিবাসী মানুষদের জীবনযাত্রা- তাদের সরল অনাড়ম্বর জীবন, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক আপনাকে দান করবে অনাবিল মুগ্ধতা। সমস্ত খাগড়াছড়ি জুড়ে বসবাস করে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাসহ আর কয়েকটি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী। তাদের সম্মিলিত জীবনযাত্রার এক মহা মিলন ক্ষেত্র যেন এই খাগড়াছড়ি।
রামগড় চা বাগানের কাছাকাছি ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের স্মৃতিসৌধ। টেরাকোটার ফলকে সেখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানান কাহিনী আর দৃশ্যাবলী। এর কাছেই রয়েছে আরেকটি দারুণ দর্শনীয় জায়গা- নাম কলসীমুখ। এটি পার্বত্য নদী ফেনীর অবদান। পাহাড়ি অঞ্চলে নদীগুলো এগিয়ে যায় এঁকেবেঁকে। সেই বাঁক এখানে রূপ নিয়েছে কলসীর মতো। তাই জায়গাটির নাম কলসীমুখ।

রামগড়ে ঘোরাঘুরি শেষ হলে এবার চলুন আরেকটি জায়গায় নিয়ে যাই আপনাদের। নাম শুনলে নিশ্চয়ই লাফিয়ে উঠবেন! আমরা কথা বলছি খাগড়াছড়ির সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন ক্ষেত্র নিয়ে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন- আলুটিলা গুহার কথাই বলছি আমরা।
বাংলাদেশ হিমালয় থেকে বয়ে আসা পলি দিয়ে গঠিত হওয়ায় পাহাড়ের যেমন অভাব, তার চেয়ে বেশি অভাব গুহার। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় পর্যটকেরা প্রায়ই আফসোস করে থাকেন এটা নিয়ে। আলুটিলা গুহা সম্ভবত সে হতাশাকে কিছুটা প্রশমিত করেছে।
এটি অবশ্য পড়েছে মাটিরাঙা উপজেলার আলুটিলা পাহাড়ে। অনেক সময় একে আরবারী পাহাড়ও বলা হয়। উপজাতীয়দের ভাষায় এই গুহার একটি নাম আছে- মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহা। এমন নাম কেন কে জানে? গুহার এক মুখ দিয়ে ঢুকে অন্য মুখ দিয়ে বেরোতে ১০-১৫ মিনিট সময় লাগে। এর ভেতরে সূর্যালোক ঢোকে না, তার ভেতরটা অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে।
ভেতরে মশাল নিয়ে ঢুকতে হয়। আলুটিলা পাহাড়ে রয়েছে আরেক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু রিছাং ঝর্ণা। সেটাও কিন্তু ঢুঁ মেরে আসতে ভুলবেন না। আর পাহাড়ের চূড়ার বৌদ্ধ মন্দির? সেখানে না গেলে বড্ড মিস করবেন আপনি।

কীভাবে যাবেন?
ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম থেকে আপনি যাত্রীবাহী কোচ কিংবা বাসে করে চলে যেতে পারবেন খাগড়াছড়িতে। আপনি যদি ঢাকা থেকে যেতে চান, তবে আপনার জন্য ঢাকার কমলাপুর, ফকিরাপুল, সায়দাবাদ প্রভৃতি স্থানে রয়েছে ঢাকা থেকে খাগড়াছড়িগামী পরিবহনগুলোর বাস কাউন্টার। যেসব পরিবহন এই রুটে যাতায়াত করে তাদের মধ্যে রয়েছে সৌদিয়া, শ্যামলী, এস আলম, শান্তি পরিবহন প্রভৃতি। এদের নৈশ ও দিবা উভয় সার্ভিস রয়েছে।
আপনাকে রওনা হতে হবে রাত ১১টা হতে ১২টা এবং সকাল ৭টার মধ্যে। ফেনীর মহীপাল এবং চট্টগ্রামের অক্সিজেন বাস টার্মিনাল থেকেও আপনি রামগড় ও খাগড়াছড়ি যেতে পারবেন বাসে করে। ঢাকা থেকে আপনি চাইলে সরাসরি খাগড়াছড়ি যেতে পারবেন কিংবা পথে রামগড়ে নেমে যেতে পারবেন।

খাগড়াছড়ি থেকে রামগড় আসার জন্য পাবেন বাস, সিএনজি কিংবা জীপসহ অন্যান্য যানবাহন। এজন্য আপনার খরচ হবে ঘণ্টা দেড়েকের মতো সময়। রামগড় ভ্রমণ শেষে এখান থেকে বাস ছাড়াও সিএনজি চালিত অটোরিক্সা কিংবা চাঁদের গাড়ি রিজার্ভ করে আলুটিলায় যাওয়া যায়।
সিএনজি, অটোরিকশা কিংবা চাঁদের গাড়ির ক্ষেত্রে সাবধান! আপনার গলা কাটতে তারা সদাই প্রস্তুত। ঠিকঠাক দরদাম করে নেবেন। যাত্রাপথে আপনার পকেট থেকে খসবে-
ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি- ৬০০ টাকা (নন এসি) ও ১,২০০ টাকা (এসি)
চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি- ১৯০ টাকা (নন এসি), ৩৫০ টাকা (এসি)
থাকবেন কোথায়?
খাগড়াছড়ি, রামগড় কিংবা আলুটিলা সব জায়গায় থাকার সুবিধা পাবেন। খাগড়াছড়ি চেঙ্গি ব্রিজের পাশে রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন হোটেল গ্রিন স্টার। রামগড়ে রয়েছে একটি সরকারি রেস্ট হাউস। অবশ্য এখানে থাকতে চাইলে লাগবে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুমতি। এছাড়া আরো কয়েকটি হোটেল রয়েছে রামগড় বাজারে। আলুটিলায় আছে হোটেল জিরান, শৈল, সুবর্ণা প্রভৃতি।
সবশেষে মনে রাখবেন আমাদের দেশ, আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। প্লাস্টিক দ্রব্য যেখানে সেখানে ফেলে পরিবেশ নষ্ট না করে ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন। আর আদিবাসীরা শান্তিপ্রিয়। তাদের অহেতুক বিরক্ত করবেন না।
Feature Image: Pixabay