ক’দিন ধরেই ভাবছি কক্সবাজার যাবো। মনের ভেতরে কেমন যেন একটা আনচান আনচান অবস্থা। কক্সবাজার, উচ্ছ্বসিত সমুদ্র, ঘন কালো মেঘ, মাতাল বাতাস, ঝড়ো হাওয়া আর পাগল পারা বৃষ্টি উপভোগ করবো কোনো হোটেলর লবি বা বীচে ভিজে ভিজে। কিন্তু আমার এই পাগুলে ভাবনা শুনে বাসার সবাই বলছে শীতকাল বা শুকনো মৌসুম নাকি কক্সবাজার ভ্রমণের আদর্শ সময়। গরমে নাকি বীচে যাওয়া যায় না, বালুর উত্তাপে দাঁড়িয়ে থাকা দায়, সমুদ্র উপভোগ তো দূরের কথা। আর বৃষ্টিতে নাকি কক্সবাজারের অফ সিজন।
কিন্তু তারা তো আর জানে না যে আমি সব মৌসুমেই কক্সবাজারে গিয়েছি। আমার কাছে শীতে কক্সবাজারকে মনে হয়েছে মাছের বাজার। মানুষের ভিড়ে হাঁটা যায় না, একদণ্ড কোথাও চুপচাপ বসা যায় না, মন খুলে ঘুরে-বেড়ানো যায় না, চারদিকে মানুষের গিজগিজ আর গিজগিজ। শীতকাল তাই কক্সবাজার উপভোগের জন্য কিছুতেই আদর্শ হতে পারে বলে আমার মনে হয়নি কখনোই। আমি সব সময় এই বর্ষায়, শ্রাবণ ধারার মাঝে কক্সবাজার যেতে চাই, হ্যাঁ সব সময়। জীবনে যতবার কক্সবাজার যাওয়ার সুযোগ আসবে, পারলে আমি এই সময়কেই বেছে নেব নির্দ্বিধায়।
আর গরমে কক্সবাজার? সে অন্তত শীতের চেয়ে ভালো। লোকজন কম থাকে, হোটেল-মোটেল আর খাওয়ার খরচও কমে যায় অনেক, নির্দ্বিধায় আর নির্জনে সমুদ্রকে দেখা যায়, যায় দূর থেকে তার গর্জন শুনে তাকে অনুভব করা, তাই গরমে কক্সবাজার যাওয়া কিছুতেই নিরুৎসাহিত করার বা হবার মতো কোনো কারণ হতে পারে বলে মনে হয় না। আর বীচের তপ্ত বালুর কথা ভাবছেন? উত্তপ্ত রোদে কমনীয় ত্বকের পুড়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত? তাহলে আপনি যেটা করতে পারেন, সেটা হলো-
খুব ভোরে বীচে যান, স্নিগ্ধ সকালের নির্মল বাতাস গায়ে মেখে উপভোগ করুন উচ্ছ্বসিত সমুদ্র, তার অবিরাম আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মাতলামি-পাগলামি দেখে দেখে পা ছোঁয়ান নরম আর ভেজা বালুতে, অনুভব করে দেখুন তার শীতলতা। দেখবেন শিহরণ জাগবে মনে আর প্রাণে। মাতাল হবেন, হবেন আকুল সমুদ্রের এমন আহ্বানে। এরপর আবাসে ফিরে যদি থাকে সুইমিং পুল আপনার হোটেল বা মোটেলে, নিজেকে সঁপে দিন পুলের মায়াবী নীল নীল জলে। আর কান পেতে শুনুন, উপভোগ করুন অদূরে অবিরাম গর্জন তোলা সমুদ্রের সাতকাহন।
তারপর খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে, হেলে-দুলে পার করে দিন গনগনে আর উত্তপ্ত দুপুরটাকে যদি তেমন গরম আবহাওয়া থাকে। তপ্ত দুপুরের অস্থির গরমের সময়টা রুমের ঠাণ্ডা এসি বা সুমিং পুলের কোমল জলে কাটিয়ে আবারও বেরিয়ে পড়ুন সমুদ্রের আশেপাশে ছায়া ঘেরা নির্জনতায়, অপেক্ষা করুন হেলে পড়া সূর্যের। রোদ কমে নরম হলে, আবারো চলে যাওয়া যাবে সমুদ্রের একদম কাছে, ঢেউয়ের জল আছড়ে পড়ে পা ভিজিয়ে দেয়া দূরত্বে। উজাড় করে দিন নিজেকে গোধূলির মায়াবী টানে। উপভোগ করুন উত্তাপহীন বীচের কোমলতা আর বর্ণিল সন্ধ্যার কমনীয় অপার্থিবতা। যতক্ষণ খুশি ততক্ষণ, হেঁটে-বসে বা ভিজে ভিজে।
এসবের চেয়েও আমার কাছে সমুদ্র দেখা, উপভোগ করা আর মনের মতো করে সমুদ্রকে পাওয়া মনে হয় বৃষ্টিতে, মেঘলা দুপুরে, ঝড় ওঠা বিকেলে, দমকা হাওয়ায় উড়িয়ে নেয়া সন্ধ্যায়, আকাশ ভেঙে নামা বৃষ্টিতে অথবা অঝোর ধারায় ঝরতে থাকা নিকষ কালো রাতে। সমুদ্রের এইসব সময়ের রূপ আসলেই অপরূপ। রোমাঞ্চকর, গা ছমছমে আর ভয়ংকর সুন্দরের অবিরাম আশীর্বাদ।
কালো হয়ে আসা মেঘের সাথে হালকা বৃষ্টি আর একটু ঝড়ো হাওয়ায় সমুদ্রের যে উত্তাল রূপ। যা শিহরণ জাগায় সমস্ত সত্বায়, শেষ বিকেলের ঝড়ো হাওয়ায় ওর ভয়াল গর্জন মনে ভয় জাগাবে ঠিকই কিন্তু আপনাকে আটকে রাখবে চুম্বকের মতো নিজের কাছে। ভয়ে ভয়ে পিছিয়ে যাবেন কিন্তু মন যেতে চাইবে না কিছুতেই ওকে ছেড়ে। ওর অদ্ভুত বীভৎস সুন্দর রূপ দেখে। আর ঠিক তখনই যদি সমুদ্র জুড়ে নামে ঝিরঝিরে বৃষ্টি, কেমন হবে ভেবে দেখুন তো? পা ভেজাবে ঢেউ, গা ভেজাবে বৃষ্টি, সাথে প্রিয়জন থাকার অপার তৃপ্তি।
এরপর রুমে ফিরে আসার পরে, যখন প্রস্তুতি নেবেন ফিরে আসার ধীরে ধীরে, ঠিক তক্ষুনি, যখন আকাশ ভেঙে অঝোর ধারায় ঝরতে থাকবে বৃষ্টি যা দেবে আপনাকে অন্য আনন্দ। গোছগাছের ফাঁকেই আপনমনে হোটেলের বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াবেন, বসে-বসে, গা এলিয়ে দিয়ে, চেয়ে থাকবেন উত্তাল ঢেউয়ের আছড়ে পড়া সমুদ্রের দিকে, কান ফাটানো গর্জনের সাথে দরাজ গলায় গেয়ে ওঠা খুব খুব খুব প্রিয় কোনো গান, নিজের অজান্তেই।
নিজ হাতে বানিয়ে প্রিয়জনের ডান হাতে তুলে দেবেন ধোঁয়া ওঠা গরম কফির মগ। বাম হাতে প্রিয়জনের নিশ্চিত আর নিখাদ ভালোবাসার হাত। সে হতে পারে ছেলে-মেয়ে-বন্ধু, প্রিয় কেউ বা প্রেয়সীর সাথে কাটানো অপার্থিব মুহূর্তগুলো।
যা সারাজীবন আপনার মনের কোণে জ্বলজ্বল করবে সুখের শুকতারা হয়ে। শত দুঃখ-কষ্ট আর বেদনাতেও হবে না মলিন বা বিলীন এতটুকু।
আর হ্যাঁ মনে রাখবেন, এই সময়ে কক্সবাজার যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়া আর অন্যান্য সকল খরচ কিন্তু অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক কম। তাই অনেক বেশী উপভোগ্য হবে। সুতরাং আর দেরি কেন?
চলুন শীত বা অসহ্য গরমে নয়, এবার আমরা সমুদ্র উপভোগ করবো ঢেকে যাওয়া কালো মেঘে, দমকা হাওয়াতে, ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আর রাতভর ঝরতে থাকা অঝোর ধারায় সমুদ্রের অবিরাম গর্জনের কান ফাটানো সৈকতে। আমার কাছে এই সময়ের ঘন কালো মেঘ, রিমঝিম বৃষ্টি ঝরা আর মাতাল বাতাসের কক্সবাজারের পাগল করা ঢেউ ভীষণ, ভীষণ আর ভীষণই প্রিয়।
ফিচার ইমেজ- লেখক
এই শ্রাবণে কক্সবাজারে

Loading...