কালকা মেইলে কলকাতা থেকে কালকা যাবো। হেলে-দুলে, থেমে থেমে, রসিয়ে রসিয়ে, নন এসিতে, গরমে ঘেমে, স্টেশনে থেমে থেমে, রেল লাইনে বসে থেকে, হেঁটে হেঁটে, আইসক্রিম খেয়ে, গাছের তলায় শুয়ে-বসে থেকে, একবারে সাধ মিটিয়ে, মনের মতো করে। এটা আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল। সব সময়ই যে রাজধানী এক্সপ্রেসে করে রাজসিকভাবে যেতে হবে, এটা আমি মানতে পারি না। তাই কলকাতা থেকে কালকা যাবার এই পাগুলে স্বপ্ন দেখেছিলাম এই পার্পেল ড্রিম স্বপ্নের শুরু থেকেই।
এবং সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার, ঠিক যেমনটা চেয়েছিলাম, ঠিক ঠিক তেমন-তেমনভাবেই কলকাতা থেকে কালকা মেইলে করে কালকা পৌঁছে ছিলাম প্রায় ৩৮ ঘণ্টার জার্নি শেষ করে। আজকে কালকা মেইলের সেই দিন-রাত্রির গল্পটাই বলবো।

চলছে ট্রেন থেমে থেমে! ছবিঃ লেখক
শুরুর দিকে পড়ে অনেকে ভাবতে পারেন, কি রে বাবা কেউ কি নিজ থেকে অমন করে ট্রেনে লেট, থেমে থাকা, দেরি করে যাওয়া উপভোগ করতে চাইতে পারে নাকি?
আমি বলি কি, হ্যাঁ পারে। যদি ট্রেন ভ্রমণের প্যাশন থাকে, যদি ভ্রমণটা হয় একটা বিলাসিতা, সে যেমনই হোক, যদি সবকিছুতেই থাকে উপভোগের মানসিকতা তবে, সামান্য ট্রেন লেট কোনো ব্যাপারই নয়। আমার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটিই হয়েছিল।
কলকাতা থেকে কালকা মেইল কালকার উদ্দেশ্যে ছেড়েছিল ঠিক ৭:৪০ মিনিটে। একদম সঠিক সময়ে। কিন্তু সকাল হতে হতে প্রায় চার ঘণ্টা লেট হয়ে গেছে নানা জায়গায় থেমে থেমে। সারারাত দারুণ ঘুমে থাকার কারণে রাতে ট্রেনের থেমে থাকা আর উপভোগ করা হয়নি কিছুতেই। সেই আক্ষেপ ঘোচাতেই অবিরত থেমে থাকা ট্রেনের সবটুকু উপভোগ করতে লাগলাম তারিয়ে তারিয়ে।

এখানে সেখানে অযথা আনন্দে! ছবিঃ লেখক
গেঞ্জি গায়ে, গলায় গামছা পেচিয়ে, হাতে ব্রাশ আর ব্রাশে টুথ পেস্ট লাগিয়ে হেঁটে চললাম, দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের ফাঁকা প্লাটফর্মে এমাথা থেকে ওমাথা। ব্রাশ করতে করতে প্লাটফর্মের শেষ মাথায় গিয়ে দেখা পেলাম একটি টলটলে পানির পুকুরের। সেখানে মুখ ধুতে ধুতে মনে পড়লো- আরে এখানেই তো একটু গোসল করে নেয়া যায়, সারা রাতের গরমের ক্লান্তি দূর করতে। মনে পড়তে দেরি হলেও, গোসল করতে আর দেরি করলাম না কিছুতেই। দারুণ একটা গোসল সেরে ফেললাম সকাল সকাল। ফ্রেশ হয়ে, সিটে ফিরে এসে বসলাম সকালের চা নিয়ে। সাথে পাউরুটি আর বিস্কিট। ব্যাস হয়ে গেল সকালের নাস্তা।
সবার সাথে রাতের মিল না খাওয়ার কারনে ফেরত পেলাম নগদ ১০০ রুপী! সেই সাথে বাঁচিয়ে ফেললাম সকালের ৫০ রুপীর নাস্তার টাকা।
একটু পরে ট্রেন ছাড়লো। কিন্তু খুব বেশী দূর না গিয়ে আরও একটি স্টেশনে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। সাথে সাথে নেমে পড়লাম আমি আর একজনকে সাথে নিয়ে। পুরো প্লাটফর্ম হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে, নতুন একটা জায়গা দেখে, এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে বসলাম একটি গাছের ছায়ায়। সেখানে একটু পরে চলে এলো গ্রামীণ আইসক্রিম! আহা এটাই তো চাইছিলাম মনে মনে। একটু দুটি করে ৩০ মিনিটে তিনটি আইসক্রিম খেয়ে নিলাম, টপাটপ। রাতের খাবারের টাকা আর সকালের নাস্তার বাচানো টাকা দিয়ে।

চলার পথে… ছবিঃ লেখক
আবার ট্রেন ছাড়লে, আবারও চড়ে বসলাম। থামল বেশ বড়সড় একটা স্টেশনে। সেখান থেকে কেনা হলো দারুণ মিষ্টি আপেল, কলা, জুস আর চিপস। সাথে ছবি তোলা আর নতুন নতুন স্টেশন ঘুরে ঘুরে দেখা তো আছেই। এরই মাঝে খবর পাওয়া গেল, কোন এক উঠতি বাবার কেরামতির জন্য ভারতের নানা জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামার খবর। সেটা ছিল একটা বাড়তি রোমাঞ্চ। ট্রেন দিল্লী যাবে কি যাবে না সেই নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা। এক সময় দুপুরের দিকে খবর পাওয়া গেল যে এই ট্রেন কেন, কোনো ট্রেনই দিল্লী পর্যন্ত যাচ্ছে না।
তখন সবাই মিলে নতুন করে প্ল্যান করতে বসলাম। যদি ট্রেন দিল্লী পর্যন্ত না-ই যায়, তবে আমরা উত্তরাখণ্ড যাবো বলে ঠিক করে রাখলাম। যে পর্যন্ত ট্রেন যাবে সেখান থেকে প্ল্যান বি শুরু হবে। তাতে করে সময়, দিন, খরচ আর এনার্জি সবই বেচে যাবে। সেভাবেই প্ল্যান করেই বসে থাকলাম ট্রেনে। ট্রেন কখনো চলে, কখনো থেমে থাকে, কখনো নতুন নতুন উড়ো খবর আসে। সেসব গায়ে না মেখে আমরা সবাই মিলেই দারুণ উপভোগ করছিলাম কালকা মেইলের দিন-রাত্রি।

যখন অনন্ত লেট ট্রেনও উপভোগ্য হয়ে ওঠে! ছবিঃ রকি ভাই
সন্ধ্যা নাগাদ ট্রেন বেশ ভালোভাবেই চলতে শুরু করলো। তখন নতুন খবর এলো যে ট্রেন দিল্লীর আগের স্টেশন পর্যন্ত যাবে, এরপর আর নয়। সেখান থেকে দিল্লী যেতে হবে বাসে, মেট্রোতে বা ট্যাক্সিতে। ট্রেন চলছিল কখনো ধীরে, কখনো দ্রুত। এভাবে চলতে চলতে এক সময় ট্রেন দিল্লী পৌঁছে গেল ভোর চারটায়, সকল অনিশ্চয়তা কাটিয়েই। দিল্লীতে কালকা মেইলের স্টপেজ এক ঘণ্টা। দ্রুত দিল্লী নেমে স্টেশন মাস্টারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, ট্রেন একটু পরেই ছাড়বে এবং কালকা যাবে! জাস্ট ওয়াও।
আবারও উঠে পড়লাম ট্রেনে এবং ট্রেন মাত্র ২৫ মিনিট পরেই ছেড়ে দিল চণ্ডীগড়ের উদ্দেশ্যে। সবাই মিলে আর একটু ঘুম দিলাম আরাম করে। সকাল ৭টা নাগাদ চলে এলাম চণ্ডীগড়ে। সবাই দারুণ খুশি, কারণ আর মাত্র এক থেকে দেড় ঘণ্টা চললেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য কালকা পৌঁছে যাবো। চণ্ডীগড় থেকে আমাদের ট্রেন দুই ভাগ হয়ে সামনের অংশ অন্য কোনো দিকে চলে গেল। আর আমাদের পিছনের অংশে নতুন ইঞ্জিন লেগে চলতে শুরু করলো কালকার দিকে। উল্লেখ্য কালকা, চণ্ডীগড়েরই একটি শহর।

চণ্ডীগড় স্টেশনে। ছবিঃ লেখক
ঠিক ৯টায় আমাদের ট্রেন এসে পৌছালো অনেক আকাঙ্ক্ষার কালকা স্টেশনে। আর সেই আনন্দে তিনদিনের অম্ল-মধুর ট্রেন জার্নির ক্লান্তি নিমেষেই উধাও সকলেরই। ঝটপট খোঁজ নিয়ে ট্রয় ট্রেনের টিকেট কেটে উঠে পড়লাম স্বপ্নের মতো সেই ট্রয় ট্রেনে, কালকা থেকে সিমলার ৭ ঘণ্টার পাহাড়ি পথে।