সেই ২০১৩ সাল থেকে শিমলা আমার কাছে এক আক্ষেপের নাম। আমার সুখ-দুঃখের ভ্রমণের কাছে অনেক বড় আর দগদগে একটা ক্ষতের নাম শিমলা। যে ক্ষতে কোনোভাবেই কোনো প্রলেপ লাগাতে পারছিলাম না আরও একবার শিমলা না যাওয়া পর্যন্ত। কারণ প্রথম ২০১৩ সালের শেষে যখন শিমলা গিয়েছিলাম, সেটা ছিল এক গভীর শীতের রাত। আর পরদিন সকালে উঠে যখন শিমলা ঘুরে দেখার প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তখনই টিম লিডার বলে বসলেন, চল সোজা মানালি যাই?
জিজ্ঞাসা করলাম কেন ভাই, শিমলা দেখব না?

মল রোডের শুরুতে। ছবিঃ লেখক
তিনি বললেন, শিমলায় দেখার কিছু নেই!
এরপর কয়েক বছর কেটে গেলেও, নানা জায়গায় যাওয়া হলেও, শিমলায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই সেই ভ্রমণ ক্ষতে প্রলেপও আর লাগেনি। যে কারণে এবার যখন কলকাতা থেকে কালকা হয়ে শিমলা থেকে মানালি যাবার পরিকল্পনা করছিলাম, তখন শিমলায় একদিন আর এক রাতের জন্য থাকার ব্যবস্থা রেখেই প্ল্যান করেছি। ক্ষতে এবার প্রলেপ লাগাতেই হবে যে।
তবুও নানা জায়গায়, নানা কারণে ট্রেন লেট আর টয় ট্রেনের ৭ ঘণ্টা মিলিয়ে শিমলা পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল ৩টা। তড়িঘড়ি রুম নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে চললাম শিমলা দেখতে। বিশেষত শিমলার মল রোড ধরে হেঁটে হেঁটে যতটুকু পারা যায় পুরনো ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে। বেশ একটু সাজুগুজু করে বের হলাম, হেলে-দুলে আর প্রাণ খুলে শিমলার মল রোড ধরে হেঁটে বেড়াতে।

সন্ধ্যার শিমলা। ছবিঃ লেখক
হোটেল থেকে বেরিয়ে নিচ থেকে পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠতে উঠতেই অনেক দিনের পুরনো ক্ষততে প্রলেপ লাগতে শুরু করলো, সাজানো, গোছানো, ঝকঝকে, তকতকে আর ঝলমলে শিমলা দেখতে দেখতে। ইশ, কি যে সুন্দর করে সাজানো মল রোডের শুরু থেকে সব কিছু! যেভাবে ব্রিটিশরা তৈরি করে রেখে গিয়েছিল, ঠিক যেন সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা ব্রিটিশ বনেদী কোনো বাড়ির ড্রইং রুম যেন! একটা শহরের বিশেষ একটা টুরিস্ট স্পটকে যে এভাবে বাসার আদুরে আর আহ্লাদী ড্রইং রুমের মতো সাজানো যায়, সেটা শিমলার মল রোড না দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই। এতটাই পরিপাটি করে সাজানো সবকিছু।
স্কুল, কলেজ, গির্জা, দোকান-পাট, হোটেল-মোটেল, এমনকি ফুটপাথের দোকান পর্যন্ত সাজানো, গোছানো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, যেভাবে ইংরেজরা তৈরি করে গিয়েছে, ঠিক সেই আদলে! কোথাও এতটুকু ময়লা আবর্জনা নেই। হাঁটছি আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছি শিমলার প্রতিটি মুহূর্ত, প্রাণভরে। পাহাড়ে পাহাড়ে রঙিন প্রজাপতির মতো বর্ণীল সব ঘরবাড়ি লেপ্টে আছে সবুজ পাহাড়গুলোর শরীরে। কোথাও কোথাও মেঘেদের দল লুকোচুরি করছে পাহাড় আর ঘরবাড়িগুলোর সাথে। কোথায় কালো মেঘ জমেছে এক টুকরো, বৃষ্টি ঝরবে বলে। আবার দূরে কোথাও ঝলমলে রোদ কোনো এক পাহাড়কে করে আলোকিত।

ঝলমলে শিমলা। ছবিঃ লেখক
কত রকমের খাবারের সমারোহ যে আছে রাস্তার দুপাশের মনকাড়া দোকানগুলোতে, চোখ ফেরান দায় সেদিক থেকে আর জিভের জল, সেও শুকোবার সময় পায় না এতটুকু। একটার পর একটা মজাদার খাবার দেখে কত সময়ই বা চুপ করে থাকা যায়, পকেটে হাত চাপা দিয়ে? বাঁধ যখন ভাঙল তখন আর তাকে বাঁধা দিয়ে কী হবে? তাই তো প্রথমে পিৎজা, তারপর পেস্ট্রি এরপর আইসক্রিম খেয়েও সাধ না মেটায়, শেষমেশ আপেল আর স্ট্রবেরির জুস নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
ততক্ষণে সূর্য পাহাড়ের কোলে হেলে পড়তে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। আর চারপাশে যেন বিয়ের সাজে সেজে উঠে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে লাল-নীল-হলুদ-সবুজ আলোর রোশনাই। দিনের আলো শেষ হয়ে সন্ধ্যার শুরুতেই শিমলা যেন তার রূপ পরিবর্তন করে ফেলল মুহূর্তেই। দোকানগুলো আলো দিয়েই আপনাকে ডেকে নেবে ভেতরে। কী নেই? কোন ব্র্যান্ডের দোকান নেই সেখানে? একটি দুটি নাম বলে বোঝানো যাবে না। সব রকম প্রসাধনী থেকে শুরু করে, খাবার এমনকি পানীয়র সব ব্র্যান্ড সেখানে সব সময় প্রস্তুত আপনার জন্য।

একটু এটা সেটা খাওয়া। ছবিঃ লেখক
একটু এগিয়ে কয়েকটা দোকানে ঢুঁ মারতেই জিভের জল টপটপ করে পড়তে শুরু করলো আমার, পাশের দোকানে গরম গরম গোলাপ জামুন ফুটতে দেখে গরম কড়াইয়ে! স্বচ্ছ ওভেনে আর তার পরিবেশন দেখে। কোনো কথা নেই, ঝটপট খেয়ে নিলাম দুটা গরম গোলাপ জামুন! একটু কেটে মুখে দিতেই নিজের অজান্তেই চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল নিমেষেই! তার যে কী স্বাদ, ওহ সেই স্বাদে সব ভুলে গেলাম আশপাশের। যতক্ষণ মুখে গোলাপ জামুন ছিল, চারপাশ ততক্ষণ নীরব, স্তব্ধ আমার কাছে! খাওয়া শেষে আর নড়ার সাধ্য ছিল না, এতটাই ভরে গিয়েছিল পেট।
তবুও ধীরে ধীরে হেঁটে গিয়ে বসলাম মেঘে-কুয়াশায় মাখামাখি এক জায়গায়। নিয়ন আলোর মাঝে, ঝকঝকে পাথরের বেদীতে। ঠাণ্ডা হিম শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিয়ে যাবে আপনাকে ক্ষণে ক্ষণে। কী যে এক ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হবে মন, বলে বা লিখে বোঝানো মুশকিল। এটা শুধু নিজেকে অনুভব করতে হয় নিজের মতো করে।
সেখানে কিছুক্ষণ বসে থেকে, হালকা হয়ে ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম আরও দুই স্তর উপরের মল রোডের মূল আকর্ষণ আর একদম চূড়ায় সেখানে গির্জা আছে আর যেখানে তুমুল জনপ্রিয় থ্রি ইডিয়টস মুভির শুটিং হয়েছিল। সেখানের রাস্তার বিস্তার এতটাই যে কেউ ফুটবল, কেউ ক্রিকেট, কেউ ভলিবল, কেউ স্কেটিং করছে অনায়াসে। শত শত নারী-পুরুষ আর শিশুরা আয়েশ করে সময় কাটাচ্ছে নিজেদের মতো করে। দারুণ ঝলমলে রঙে সেজে আছে চারদিক। যার চারপাশে যেদিকেই তাকাই না কেন শুধু সুখ আর সুখ! শিমলা যেন এক সুখের শহর।

সুখের শহরে। ছবিঃ লেখক
বেশ অনেক সময় সেখানে নিজেদের মতো করে কাটিয়ে ধরেছিলাম ফেরার পথ, শীতের বাতাস বেড়ে যাওয়াতে। আর ফেরার পথে খুঁজতে শুরু করেছিলাম গরু বা খাসির মাংস দিয়ে ভাত খাবার জন্য কোনো মুসলিম হোটেল। যেখানে দেখা পেয়েছিলাম এক অন্য রূপের, দুঃখ, কষ্ট আর জীর্ণ শিমলার!
যার একহাতে সুখ আর অন্যহাতে দুঃখ!