অনেক দিনের একটি স্বপ্ন ছিল টয় ট্রেনে চেপে, ধীর লয়ে, হেলে-দুলে, গড়িয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের পর পাহাড় ডিঙিয়ে অনন্ত সময় ধরে পাহাড়ে পাহাড়ে জড়িয়ে থাকা রঙিন প্রজাপতির মতো ঘরবাড়ির বর্ণিলতা, ঝকঝকে নীল আকাশ দেখতে দেখতে কালকা থেকে শিমলা যাব। অতি সম্প্রতি আমাদের শিমলা-মানালি হয়ে লাদাখ ভ্রমণের সময়ে লালিত সেই স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে। তাও মাত্র ২৫ রুপীর বিনিময়ে! হ্যাঁ, এটা আমার সেই প্রথমবার শিমলা গিয়েও ঘুরে দেখতে না পারার আক্ষেপের অন্যতম কারণ।
শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও আসলে এটাই সত্যি, কালকা থেকে শিমলা যেতে টয় ট্রেনে খরচ পড়ে মাত্র ২৫ রুপী জন প্রতি! অবশ্য সবগুলো টয় ট্রেনেই নয়। ট্রেনের সময়, মান আর আপ্যায়ন ভেদে এই দাম ২৫ রুপী থেকে ৬০০ পর্যন্ত ওঠানামা করে। ৯০ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে শিমলা যেতে সময় লাগে ৬/৭ ঘণ্টা। মনে হতে পারে অনেক দীর্ঘ, বিরক্তিকর কোনো জার্নি হবে হয়তো। কিন্তু না, মোটেই তেমন নয়, অনুভূতি হবে এক অনন্য ভ্রমণ অভিজ্ঞতার যদি ভালোবাসেন পাহাড়, প্রকৃতি, সবুজ অরণ্য, নীল আকাশ, বর্ণিল চারপাশ।

পাহাড় বেয়ে ছুটে চলা। ছবিঃ লেখক
কালকা থেকে শিমলা যেতে বেশ কয়েকটি টয় ট্রেন আছে ভোর থেকে। সময়, আরাম, আপ্যায়ন আর শ্রেণীভেদে নির্ভর করে সেগুলোর ভাড়া। কোনোটা আছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, ভাড়া পড়বে ৫৮০ রুপী খাবার সহ। আছে ৫০ বা ২৫ রুপী ভাড়ার হিমালয়ান কুইনসহ আরও দুই তিনটি টয় ট্রেন, যা প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত কালকা থেকে ছেড়ে যায় সিমলার উদ্দেশ্যে। আর সম্প্রতি যোগ হয়েছে গ্লাস ট্রেন! মানে পুরো ট্রেনটাই প্রায় কাঁচের, এমনকি ছাদ পর্যন্ত! পুরো পথে যেতে যেতে এতটুকু ভিউ বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন কেউ মিস করে না যায়, সেই আয়োজন। এটার ভাড়াও বোধহয় কিছুটা বেশী হবে।
এরমধ্যে সবচেয়ে সাশ্রয়ী হলো জন প্রতি ২৫ রুপীর টয় ট্রেনটি। কালকা মেইল থেকে নেমেই আপনি পাশের স্টেশনের বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কালকা মেইলের টিকেট কেটে নিতে পারেন ২৫ রুপী দিয়ে। এই ট্রেনের কোনো সিট নাম্বার থাকে না। যে যত আগে টিকেট কেটে, ট্রেনে উঠে নিজের পছন্দমতো সিট নিতে পারবেন সেটাই সেই মুহূর্ত থেকে শিমলা পৌঁছানো পর্যন্ত তার সিট।

এক ঝুলন্ত স্টেশনে! ছবিঃ রকি
সবচেয়ে ভালো হয় ট্রেনের ডান পাশের সিট যদি পেয়ে যান। তবে সেক্ষেত্রে একটু রোদের উত্তাপ সহ্য করতে হতে পারে। তবে ট্রেন চলতে শুরু করলে, নরম শীতের মিহি বাতাসের স্পর্শ আপনার রোদের আকুলতা বাড়াবে বৈ কমাতে পারবে না। অবশ্য মনের মতো সিট না পেলেও খুব একটা সমস্যা হবার কথা নয়। কারণ পাহাড়, সবুজ অরণ্য, নির্মল প্রকৃতি, বর্ণিল ঘরবাড়ি, পাবেন আপনি চলতি পথের ডান আর বাম দুই পাশেই। ডানে একটু বেশী আর বামে একটু কম এইটুকুই যা পার্থক্য।
কালকা থেকে শিমলা যেতে ৯০ কিলোমিটার পথের ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময়ের মাঝে ট্রেন আপনাকে থামাবে, নামাবে, ঘুরে দেখাবে, ছবি তোলার সুযোগ দেবে অনেক অনেক নান্দনিক ছোট ছোট পাহাড়ি স্টেশনে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঝুলে থাকা অপূর্ব এক একটা স্টেশন! কোনোটা লাল, কোনোটা নীল আবার কোনোটা হলুদ রঙে সেজে হেসে স্বাগতম জানাবে আপনাকে। আপনি নামবেন, হাঁটবেন, একটু গা এলিয়ে দেবেন রঙিন বেঞ্চিতে, বাতাসে গা ভাসাবেন সেসব বৈচিত্রে ভরপুর এক একটা স্টেশনে। কেমন লাগবে বলুন তো! এই সুখ ওখানে গিয়েই একমাত্র নিতে পারবেন।

পাহাড়ের পিঠে ঝুলে থাকা স্টেশন! ছবিঃ লেখক
কখনো দেখবেন আপনাদের টয় ট্রেন অন্য আর একটা টয় ট্রেনকে সিগনাল দিয়ে যেতে সাহায্য করবে কোনো পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে! কী যে অদ্ভুত আর ঘোর লাগা, মায়াময় সেই দৃশ্য যা আপনি হাজার টাকার বিনিময়েও কখনো কোথাও পাবেন না। যা পাবেন এই ২৫ রুপীর টয় ট্রেনে ৬ ঘণ্টার কালকা থেকে সিমলা যেতে।
মাঝে কোনো এক ঝকঝকে স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে আপনাকে চা বা কফি উপভোগের সুযোগ করে দিতে। কখনো ট্রেন দাঁড়াবে অন্য কোনো এক পাহাড়ের কাঁধে আপনাকে হালকা কোনো নাস্তা, ভাজিভুজি বা মুখরোচক কোনো খাবারের সুযোগ করে দিয়ে। কোথাও দাঁড়াবে আপনাকে একটু ঝর্ণার শীতল পানির সুখের পরশ বুলিয়ে দিতে। বোতলে পানি ভরে নিয়ে বাকি সময়ের তৃষ্ণা মেটাতে।
কখনো কোথাও দাঁড়িয়ে থাকবে ওর আলসেমিতে, হয়তো তখনই ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে না তাই! দাঁড়িয়ে গেছে আনমনে! তবে সেটা নিশ্চিতভাবেই কোনো না কোনো পাহাড়ের সারির মাঝে। যেখান থেকে আপনি উপভোগ করতে পারবেন পাহাড়ের পর পাহাড়ের দাঁড়িয়ে থাকা, পাহাড়ের গায়ে গায়ে লেপটে থাকা সাদা মেঘের ভেলা, কোথাও ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা নীল-সবুজ পাহাড়ের চূড়া, দূরে কোথাও হয়তো ঝরে পড়া দেখতে পাবেন এক পশলা বৃষ্টির আর অন্য কোনো পাহাড়ে ঝলমলে রোদের রঙিন খেলা!

চলছে ছুটে পাহাড় থেকে পাহাড়ে। ছবিঃ লেখক
একই সাথে পাহাড়ের এত এত বৈচিত্র আর বর্ণিলতা পেতে, গায়ের আর পায়ের পরিশ্রম না করেই ভেসে ভেসে, সিমলা যেতে যেতে, এমনভাবে পাহাড়, প্রকৃতি, অরণ্য উপভোগ একমাত্র টয় ট্রেনেই সম্ভব। কালকা থেকে সিমলা যেতে, তাও মাত্র ২৫ রুপীর বিনিময়ে!
সময় করে, এমন করে এসব উপভোগ করতে চাইলে চলে যেতে পারেন প্রথমে ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে কালকা। আর কালকা থেকে মাত্র ২৫ রুপীর টিকেট কেটে ৬ ঘণ্টার টয় ট্রেনের জার্নি শিমলা পর্যন্ত। যেটা নিশ্চিতভাবেই জীবনের এক অন্য আনন্দ হয়ে রয়ে যাবে স্মৃতির ঝলমলে আকাশে।