হেঁটে যাচ্ছে শেকড় সন্ধানীর দল। পুরো এলাকাটাই যেন ভবনে ঠাসা। এটাই তো পুরান ঢাকা। এই সব ঠাসা ভবন কবে কলাপস করে বড় দুর্ঘটনা হবে সেটি দেখার জন্যই মনে হয় প্রশাসন অপেক্ষা করছে। আমাদের পুরান ঢাকাবাসীর মাথার উপর যেন সৃষ্টিকর্তা এক রক্ষাকারীর ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়ান। এই ঠাসা ভবনের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া সরু গলি দিয়ে একটু শান্তি মতো হাটার জো নেই। ফুটপাতের বালাই নেই, এর মধ্যে দিয়ে চলছে রিক্সা গাড়ি ভ্যান থেকে শুরু করে মানুষ।
পুরান ঢাকা যে শুধু ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত তা বললে ভুল হবে। সে বিখ্যাত তার মসজিদের জন্যও। আর আমরা প্রবেশ করলাম আদি ঢাকার মসজিদের ঐতিহ্যে। আমাদের শেকড় সন্ধানীর দলের সবাইকে নিয়ে যখন খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদে প্রবেশ করলাম ঘড়ির কাটায় বারোটা পেরিয়ে জুম্মার ডাক দিচ্ছে। শুক্রবার বিধায় অনেক মুসল্লি আগে এসে জায়গা দখলের পাঁয়তারা করছে। তার মাঝেই যে দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভূত সুন্দর স্থাপনা।

মহম্মদ মৃধার মসজিদ (১৮৮৫)। ছবিঃ উইকিপিডিয়া।
মাটি থেকে প্রায় ১৭ ফুট উঁচু প্লাটফর্মের ওপরে অবস্থিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটিই আমাদের খান মৃধা মসজিদ। চারপাশে গাছাগাছালির আচ্ছাদানে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া আদি ঐতিহ্যের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল শেকড় সন্ধানীর দল। শরীফ আর ঈসমাইল ভাই অতিথিদের ব্রিফিং আর ভিউ দেখাতে ব্যস্ত। আর আমি ডুবে গেলাম এর ইতিহাসে।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন এর বই থেকে পাওয়া যায়, ১৭০৪-৫ সালে ঢাকার প্রধান কাজী, কাজী খান মোহাম্মদ এবাদউল্লাহের নির্দেশে খান মোহাম্মাদ মৃধা মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর অবস্থিত এই তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির নামাজ ঘরের উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে মাদ্রাসা। মসজিদ আর মাদ্রাসার মাঝে রয়েছে উন্মুক্ত অংশ। আর প্ল্যাটফর্মের উপর অবস্থিত মসজিদের নিচের ঘরগুলো ছিল মানুষ থাকার জন্য। দূরদূরান্ত থেকে আসা ক্লান্ত পথিকদের ঠাঁই মনে হয় নিচের ঘরেই হতো।

অতীত থেকে বর্তমান। ছবিঃ উইকিপিডিয়া।
ইতিহাস থেকে ফিরে এলাম বাস্তবে হান্নান ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে। এটা কি পোড়ামাটির তৈরি মসজিদ? দূর থেকে দেখলে পথিকের তাই খেয়াল হয়। প্ল্যাটফর্মের সিঁড়ি বেয়ে সামনে উঠে দেখলে বোঝা যায় লাল ইট আর চুনাপাথরের মিশ্রণে স্থাপনাটার জৌলুস। পুরান ঢাকার এই ঘিঞ্জি এলাকার ভিতরে হারিয়ে যায়নি সাড়ে তিনশো বছরের এই মোগল অভিজাত্য। দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে তার আপন মহিমায়।
খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ দেখা শেষে এবার আমাদের দল হেঁটে হেঁটে অতিক্রম করলো লালবাগ কেল্লা। উদাস নয়নে দেখা ছাড়া কোনো গতি নেই, লালবাগের যে আর শাখা নেই। ১২টা থেকে ২-৩০ এর বন্ধের ফাঁদে পড়ে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমরা এখানে আর দাঁড়ালাম না। সোজা হেঁটে চলে এলাম চক বাজার মসজিদ। ঠিক কাটায় কাটায় ১টা বাজলে সবাই নামাজ পড়তে চক বাজার মসজিদ প্রবেশ করলো।

১৮৭০ সালে তোলা বড় কাটারার ছবি। ছবিঃ উইকিপিডিয়া।

বর্তমান বড় কাটরা। ছবিঃ লেখক।
জুম্মার নামাজ শেষে শুরু হলো আমাদের বড় কাটারা, ছোট কাটারা অভিযান। বড় কাটারা, ছোট কাটারার নাম শোনেনি এমন মহারথী তো খুবই কম আছে। তবে এখন কাটারা নামে যা আছে শুধুই ধ্বংসাবশেষ। চক বাজার মসজিদ থেকে বরাবর ঢুকে গেলাম বড় কাটারা গলিতে। একেবারে বরাবরই দেখা যাচ্ছে বড় কাটারা।
এককালের জল তুলি রংয়ে দেখা বড় কাটারা ভূমিদস্যুদের কবলে পড়ে বেদখল হয়ে গেছে অনেক আগেই। পুরনো ভবনের উপরই নতুন ইটের গাঁথুনি দিয়ে বড় কাটারা এখন মানুষের দখলে। যাক মাদ্রাসার কারণেও কিছুটা অবশিষ্ট আছে, এখনও টিকে আছে। না হয় বড় কাটারা হারিয়ে যেত ইতিহাসের পাতায়। শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারত নির্মাণের নির্দেশ দেন সেই ১৬৪১ খ্রিস্টাব্দে। প্রথমে এই ভবনে শাহ সুজার বসবাসের কথা থাকলেও পরবর্তীতে এটি মুসাফিরদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ঢাকায় আসা বণিক, মুসাফিরদের এককালে জায়গা হতো এই বড় কাটারায়।

বড় কাটারা। ছবিঃ উইকিপিডিয়া।
বড় কাটারা ভবনের মাঝে সেই শাহী তোরণ যেন মোগলদের নিদর্শনের কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দেয়। শেকড়ের খোঁজে আজ সন্ধানীরা হারিয়ে গেছে এই ঐতিহ্যের শহরে। মুগ্ধ নয়নে তোরণের ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সন্ধানীরা। আর আশেপাশে দেখছে দখলদারীর কারবারি। মোগল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত এই কাটারার নিচতলায় ২২টি দোকান সংযুক্ত ছিল।
আজও আছে দখলদাররা। তবে দোকানগুলোয় দেখা যাচ্ছে আধুনিকতার ছোঁয়া। তোরণ দিয়ে প্রবেশ করে অপর প্রান্তে বের হয়ে এক পলক দেখে নিলাম সেই বাংলা, সমাজ, ইতিহাস বইয়ের পাতায় দেখা সেই বড় কাটারা। হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য, দখল করে নিচ্ছে আধুনিকতা।
সন্ধানীরা ক্লান্ত তবে আজ তাদের ঐতিহ্যের নেশা পেয়েছে। হেঁটে হেঁটে চলে এলাম ছোট কাটারায়। বড় ভাইয়ের সাথে এর কোনো গঠনমূলক পার্থক্য নেই। পার্থক্য আছে শুধু ইতিহাসে। ছোট কাটারা নির্মাণ করেন শায়েস্তা খান। অনুমানিক ১৬৬৩-৬৪ সালে কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৬৭১ সালে। দেখতে বড় কাটরার মতো হলেও ছোট ভাই সাইজে ছোট। ঠিক যেন ৪০০ মিলি কোকের বোতলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ২৫০ মিলি কোকের বোতল।

১৮১৭ সালে চার্লস ডিওয়েলে অঙ্কিত ছোট কাটারা ও এর মসজিদ। ছবিঃ উইকিপিডিয়া।
তবে আংরেজ বাবুরা এই ছোট বাবুর অনেক সংস্কার করে। সংস্কার করবেই না কেন? এই ছোট কাটারা যে ছিল ঢাকার প্রথম ইংরেজি স্কুল। ইতিহাস মজার যদি তা গল্পের ছলে গেলানো যায়। আমাদের সেই গল্পটাও শুরু হয়েছিল ১৮১৫ সালে। ঢাকা শহরে ৪০০ বছরের ইতিহাসে ইংরেজি শিক্ষাকে প্রথম গুরত্ব সহকারে দেখা শুরু করেন শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনারির ধর্ম প্রচারকের দল।
তবে এই বাঙাল মুল্লুকের মানুষদের জন্য উদার হতে তাদের সময় লেগেছিল। ১৮১৫ সালে মূলত হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের (ইউরোপিয়ান, ইউরোশিয়ান) গরীব ছাওয়ালদের শিক্ষার জন্য ক্যালকাটা বেনেভোলেন্ট ইনস্টিটিউশনের একটি শাখা খুলতে সূদূর আয়ারল্যান্ড থেকে আসেন ধর্মপ্রচারক রেভারেন্ড ওয়েন লিওনার্দ।
রেভারেন্ড ওয়েন লিওনার্দ মূলত ১৮১৬ সালের এপ্রিল মাসে এই ছোট কাটারার বুকে স্থাপন করেন ঢাকার প্রথম ইংরেজি স্কুল। সে বছরই গ্রিক ও আর্মেনিয়ানসহ ৩৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে ঢাকার প্রথম ইংরেজী স্কুল। শিক্ষার্থীদের ইংরেজি, ব্যাকরণ, গণিত বিষয়ে শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি ধর্ম গুরু ধর্মীয় সংগীত ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে দিতেন ধর্মীয় দিক্ষা।
জল রঙয়ে আঁকা ছোট কাটারা। ছবিঃ উইকিপিডিয়া।
এই স্কুল প্রথম দিকে খ্রিস্টানদের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও পরবর্তীতে খুলে দেওয়া হয় অন্য ধর্মের ছাত্রদের জন্যও। ১৮১৭ সালে মুসলিম ছাত্রদের আর্কষিত করার জন্য লিওনার্দ নেন সুব্যবস্থা। ৭টি বাংলা স্কুল স্থাপনের পাশাপাশি ইংরেজি স্কুলটিকেও উন্মুক্ত করে দেন সবার জন্য। দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞান পিপাসু ছাত্ররা ছুটে আসতো এই স্কুলে। তবে ধর্ম প্রচারক লিওনার্দের মৃত্যুর পর স্কুলটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
ছোট কাটরা বেশি দিন জ্ঞান বিহীন থাকেনি অবশ্য। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের দামামা যখন বেজে উঠেছিল ছোট কাটরা তখন সজ্জিত হচ্ছিল ঢাকার প্রথম নরমাল স্কুলের তকমা পেতে। উনিশ শতকের শেষ দিকে অথবা বিশ শতকের প্রথম দিকে ছোট কাটরা চলে যায় আবার নবাব পরিবারের দখলে। কয়লা ও চুনের কারখানার কাজ চলতো বেশ। আর এই আধুনিক যুগে এসে ছোট কাটারা একদম শেষ। সামনে গিয়ে দেখতে পেলাম শুধু এর তোরণ আর শেষ ধ্বংসাবশেষ।

বর্তমান ছোট কাটারা। ছবিঃ লেখক।
ডুবে ছিলাম ইতিহাসের গভীর জলে। এক চাচা পাশ দিয়ে পান চিবুতে চিবুতে যাবার সময় হেড়ে গলায় বললেন, ভাই আপনি সাম্বাদিক নাকি? চাচার কথাটা পাঞ্চ লাইনের মতো কানে পাঞ্চ করলো। গলায় ডিএসএলআর ঝুলানো দেখে ভেবেছেন হয়তো সাম্বাদিক। আমিও তাকে নিরাশ না করে মুচকি হেসে রহস্যের ধ্রুমজাল তৈরি করলাম। চাচা মাথা চুলকাতে চুলকাতে চলে গেল। কর্ণ কুহরে সেই পাঞ্চ লাইনের ঠেলায় ক্ষুধার মাত্রাটা যেন বেড়ে গেল। হাজী নান্নার মোরগ পোলাও দিয়ে তা হালাল করতে হবে।
ফিচার ইমেজ সোর্স- পর্যটন বিডি।