শ্রীনগর থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরের পেহেলগামে ঢুকতেই সদ্য বৃষ্টি হয়ে যাওয়া একরাশ স্নিগ্ধ বাতাস আমাদের স্বাগতম জানাল যেন তার পাগল করা পাহাড়ি ভ্যালিতে। কোথায় চোখ রাখি? পাহাড়ে পাহাড়ে নেমে আসা ঝর্ণায়? পাহাড় আর রাস্তার মাঝ দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী উচ্ছল যৌবনা লিডার নদীর বুকে? পাহাড়ের গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকা সাদা সাদা মেঘে? নাকি সবুজ পাহাড়ের দূরে হেসে হেসে আমাদের দিকে এগোতে থাকা বরফ মোড়ানো পাহাড় চূড়ায়?
আর একটু এগোতেই ঘন পাইনের অরণ্যের পাশ দিয়ে ছুটে চলতে শুরু করলো আমাদের গাড়ি। এবার আমার একটু মাতাল মাতাল লাগতে লাগল, আমি কোনটা ছেড়ে কোনটা নেব? কাকে ছেড়ে কাকে দেখবো? আমাদের পাহাড়ি রাস্তা আর একটু বাঁক নিতেই ঠিক যেন মুখের সামনে এসে পড়তে লাগলো পাহাড় থেকে রাস্তায় নেমে আসা কয়েকটি পাহাড়ি ঝর্ণা। একটু পরে আরও একটি, তার একটু পরে আরও কয়েকটি পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ঝর্ণার দেখা মিলছে!
এসব দেখতে দেখতেই হুট করে আমাদের গাড়ি ঠিক উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া লিডারের বুকের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা লোহার ব্রিজে উঠে গেল। কোন পাশে চোখ রাখি? দূরের যে পাহাড়ের ভাঁজ থেকে লিডার ছুটে আসছে সেদিকে? নাকি ব্রিজের অপর দিকে যেদিকে সে ছুটে চলেছে আপন খেয়ালে সেদিকে?
আরে এ যে একই জায়গায় একই নদীর দুইটি শাখা! অদ্ভুত তো! একটি নদীই মাঝে ছোট একটি পাহাড় পড়ায় দুই ভাগে ভাগ হয়ে একটু সামনে গিয়ে আবার নিজেদের মিলন ঘটিয়েছে, অবাধ্য ভালবাসার, অনন্য আকর্ষণে! এক মুহূর্ত যেন আলাদা হতে চায় না একে অন্যের কাছ থেকে!
এই দেখতে দেখতেই খেয়াল করলাম আমাদের গাড়ি আচমকা সামনে দাড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু পাহাড়ের গায়ে গায়ে ঘন পাইনের অরণ্যের ভিতরে ঢুকে পড়ছে যেন! কী ব্যাপার আমরা কোথায় যাচ্ছি? পাইনের বনের ভেতরে কি তবে আমাদের সেই স্বর্গ প্যালেস? কী জানি, দেখি কোথায় গিয়ে থামে।
একটি পাহাড়ের পীঠ বেয়ে, মাথার সিঁথির মত মিহি কিন্তু ঢেউ খেলানো আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে পাইনের বনের সাথেই লাগোয়া একটি সবুজ গালিচা বিছানো, গোলাপের জঙ্গলে বাঁধানো, পাহাড়ের মধ্য খানের একটু বেরিয়ে থাকা লনে থামালো। গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ফুটে থাকা গোলাপ আর সবুজের মাঝ দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাতছানি দিয়ে ডাকছে স্বর্গ প্যালেস! ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম সবাই।
আমরা কয়েকজন উপরে গিয়ে কটেজের মালিকের সাথে কথা বলতে গেলাম, বাকিরা নিচে দাঁড়িয়ে চারপাশের সবুজ ঘাস, ঘর অরণ্য, সাদা মেঘ, বিশাল পাহাড়, লিডার নদী আর পাশের ঝর্ণা দেখতে থাকলো। ধারণার চেয়েই কমে মাত্র ৮০০ টাকাতেই পেয়ে গেলাম স্বর্গের মতো এক ভূখণ্ডের স্বর্গ প্যালেসের চারটি স্বর্গীয় রুম। ঝটপট উঠে পড়লাম সবাই যে যার ব্যাগ পত্র নিয়ে নিমেষেই।
আহা, কী জায়গা, আর কী জায়গায় এই কটেজ, আর কী তার রুম থেকে ভিউ, আর কোথাও না গেলেও চলবে। এখানে বসে থেকে, এই জানালায় চেয়ে থেকে, এই বিছানায় শুয়ে থেকে, ডাইনিংয়ে খেতে খেতেই যদি সামনে একের পর এক বাস্তবে আসতে আর ভাসতে থাকে পৃথিবীর সমস্ত কিছু একই সাথে তবে আর কীই-বা চাইবার থাকতে পারে বিধাতার কাছে?
কী পেলে আপনি আর কিছু চাইবেন না বলুন? কী কী পেলে আপনার সব চাওয়া পূর্ণ হতে পারে প্রকৃতির কাছ থেকে? কী কী রূপ দেখতে পেলে আপনি প্রাপ্তির ভারে পাগল হয়ে যেতে পারেন একবার ভাবুন চোখ বুজে?
পাহাড় চান? আছে। কেমন পাহাড় চান? সবুজ? আছে। ন্যাড়া পাহাড়? আছে। ঘন অরণ্যে ঘেরা পাহাড়? আছে। মেঘে ঢাকা পাহাড়? আছে। বরফে মোড়া পাহাড়? আছে। ঝর্ণার গান শুনিয়ে যাওয়া পাহাড়? আছে। নদীর উচ্ছ্বাস? আছে। সবুজ ঘাসের গালিচা? আছে। গোলাপে সাজানো বাগান? আছে। পাথরে বসে নদীতে পা ভেজাতে চান? আছে। পাহাড়-নদী আর ঝর্ণার একই সাথে মিলন দেখতে চান? সেও আছে!
রুমের বিছানায় শুয়ে, বসে বা বেতের চেয়ারে শরীরটাকে এলিয়ে দিয়ে মেঘ-পাহাড়-অরণ্য-নদী আর ঝর্ণার সাথে ফুলের বাগানে বসে একই সাথে চা বা কফি খেতে চান? আছে! আর যখন যা চাইবেন তাই যদি পেয়ে যান তবে কি আর সুস্থ বা স্বাভাবিক থাকা সম্ভব কারো পক্ষে? এত এত কিছু একই সাথে পেয়ে গেলে কি আপনার মাথায় কিছুটা পাগলামি ভর করবে না? নিশ্চয়ই করবে।
আমার মাথায় তো তখন পুরো পাগলামি ভর করেছিল! একবার নিজের রুমের চেয়ারে বসি, তো একবার খাটে শুয়ে বাইরে চেয়ে থাকি। একবার ডাইনিংয়ের চেয়ারে গিয়ে বসি, তো একবার নিচে নেমে সবুজ ঘাসের লনে শুয়ে-বসে থাকি! একবার মোবাইল বের করে ছবি তুলি, তো আর একবার ক্যামেরা বের করে ক্লিক ক্লিক করতে থাকি! সব মিলিয়ে একটা মাতাল মাতাল অবস্থা, একটা পাগুলে পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম পেহেলগামকে দেখে, কাছে পেয়ে আর ওর সবকিছু বাস্তবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
যে কারণে একদিন থাকার যায়গায়, ওখানে গিয়েই শ্রীনগরের রুম ক্যান্সেল করে দিয়েছিলাম দ্বিতীয়বার না ভেবেই। থেকে গিয়েছিলাম একই সাথে তিন দিন।
কী করবো বলুন, পেহেলগাম যে আমাকে পাগল করে তুলেছিল বাঁকে-বাঁকে, ভাঁজে-ভাঁজে, খাঁজে-খাঁজে, এক-এক জায়গায়, এক-একভাবে ওর বাহারি রূপের জাদুকরী মোহের আকর্ষণে। যতটা পারা যায়, ওর রূপের যতটুকু ধারণ করা যায়, চোখ-মন আর প্রাণের যতটা তৃষ্ণা মেটানো যায় ততটাই মেটাতে চেয়েছি।
কিন্তু পেরেছি কি? নাহ পারিনি! যতই থেকেছি ততই তৃষ্ণা বেড়েছে! আরও থাকতে না পারার তৃষ্ণা। যতই দেখেছি ততই চোখের জ্বালা বেড়েছে! আর দেখতে না পারার! যতই উপভোগ করেছি, ততই আক্ষেপ বেড়েছে, আরও মনের মতো করে অনুভব করতে না পারার!
এখানে গেলে আর আসতে মন চায় না, বসলে আর উঠতে ইচ্ছা হয় না, চোখ খুললে আর পলক ফেলার সময় থাকে না! এখানে মনের তৃষ্ণা মেটে না, চোখের তৃপ্তি হয় না, ইচ্ছের কোনো শেষ আসে না, সময়গুলো অলস, ভীষণ অলস হয়ে ঠাঁই বসে থাকতে চায়, অনন্ত সময়ের জন্য স্থির হয়ে!
এখানে প্রকৃতি কখনো কাঁদে না, সব সময় হাসে। কখনো সাদা মেঘের ভেলা হয়ে ভেসে যায় পাহাড়ে আর আকাশে, কখনো আদরের কুয়াশা হয়ে জড়িয়ে দেয় হিম হিম শীতল আদর, কখনো আনন্দের বৃষ্টি ঝরে! কখনো ঝর্ণা গান হয়ে ঝরে পড়ে অবিরত, কখনো নদীর ঢেউয়ে মাতাল হয়ে ছুটে যায়, দূরে বহুদূরে।
এখানে এলে আপনি দুঃখ ভুলে যাবেন, যেতেই হবে! এখানে এলে আপনি পাগল হয়ে যাবেন, হতেই হবে। না হয়ে কোনো উপায়ই যে নেই! কেননা, এ যে পাগল করা পেহেলগাম!
ফিচার ইমেজ- cdn77.org
কাশ্মীরের পাগল করা পেহেলগাম

Loading...
Very informative article.
এতো সুন্দর বর্ণনা পেয়ে মনে হচ্ছে যেন পাহেলগামেই পৌঁছে গেছি। অসংখ্য ধন্যবাদ।