আমি বিশ্বাস করি, ভ্রমণ পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। ভ্রমণে মন প্রসারিত হয়, বোঝা-পড়ার ক্ষমতা বাড়ে, ব্যক্তিত্ব উন্নত হয় এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে উন্নয়ন সহজেই চোখে পড়ে। সাম্প্রতিক উন্নত পর্যটন ব্যবস্থা, ভ্রমণের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং তুলনামূলক সস্তা ফ্লাইটে ভ্রমণ সুবিধার কারণে পর্যটকদের সংখ্যা বেড়েছে। পৃথিবীর যে কোনো ভ্রমণ গন্তব্যে এখন ছোট ছোট দলে চীনা পর্যটকদের ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য খুবই সাধারণ। তাই জনপ্রিয় গন্তব্যগুলো অনেকটাই জনবহুল হয়ে পড়ছে।
ভার্সাইলসে একটা প্রাসাদ আছে। কয়েক বছর আগেও সেখানে বিনা ঝঞ্ঝাটে সিনেমার শুটিং হতো। আর এখন এই প্রাসাদে পর্যটকদের এতটাই ভিড় হয় যে, ঘুরে দেখতে দলে দলে পালাক্রমে মনুমেন্টের বিভিন্ন রুমে প্রবেশ করতে হয়।

মেক্সিকোতে তুলুম নামে একটা নীরব শহর ছিল। শহরটা এখনো আছে, তবে শহরের সেই নীরবতা আর নেই। ডিজিটাল যাযাবরদের কল্যাণে শহরটি আজ অতি জনাকীর্ণ। আইসল্যান্ডের রিকজাভিকের কথাই ধরা যাক। এক সময় এই নগরের রাস্তায় দোকান-পাট দূরে থাক সচরাচর মানুষেরও দেখা মিলত না। আর এখন ডানকিন ডোনাটে পূর্ণ রিকজাভিকের প্রধান সড়কগুলো জন সমুদ্রে পরিণত হয়েছে। তবে আইসল্যান্ডের মানুষ এই টুরিস্টদের পছন্দ করে।
আইসল্যান্ডের মতোই প্রাগ, ভেনিস, এডিনবার্গ, বার্সেলোনা, প্যারিস, কো লিপে, চিয়াং মাই, কুইন্সটাউন্সহ জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যগুলোতে টুরিস্টরা অতি জনাকীর্ণতা তৈরি করছে। একই সঙ্গে টুরিস্টদের অবাধ ও বোকা আচরণে স্থানীয়রা বিরক্ত। এই স্থানগুলো জনবহুল হয়ে ওঠাতে নিয়ন্ত্রণ কমে যাচ্ছে। এতে স্থানীয়রাই শিকার হচ্ছে।

বিশ্বায়নের যুগে ভ্রমণ সবার জন্য উন্মুক্ত, জনবহুল গন্তব্যগুলো শুধুই পণ্য। ২০৩০ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সংখ্যা ৩.৩ শতাংশ বেড়ে ১.৮ বিলিয়নে গিয়ে ঠেকবে! এতে ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণও কমে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। বার্সেলোনাতে এখন নতুন হোটেল তৈরির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। বিলাসী ক্রুজ শিপের সংখ্যাও কমিয়ে আনা হয়েছে। ডাবরভানিকে টুরিস্টদের সংখ্যা কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
চিলি তাদের পূর্বের দ্বীপে পর্যটকদের প্রবেশের সংখ্যা ও অবস্থানের সময় কমিয়ে দিয়েছে। ইকুয়েডরও চিলির পথ অনুসরণ করছে। ভেনিসেও পর্যটকদের ক্ষত্রে একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আইসল্যান্ডও দেশটিতে বিদেশিদের সম্পদ ক্রয়ের সীমিতকরণ নীতি গ্রহণ করেছে। আমস্টারডামে শহরগুলোতে বিদেশিদের পার্টি করতে নিষেধ করা হয়েছে। মেজরকাতে এর সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে। সেখানে স্থানীয়রা পর্যটকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।
পৃথিবী যেন বলছে ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়’। আমি মনে করি না পর্যটকরা ইচ্ছা করে পরিবেশ দূষণ করে। কেউ বলছে না ‘চলো জনবহুল আইসল্যান্ডে গিয়ে মানুষজনকে বিরক্ত করি।’ আসলে অধিকাংশ মানুষ বোঝে না তাদের জন্য কীভাবে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। এ কারণে শিক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এর বিকল্প নেই।

এই সংকট সমাধানের জন্য পর্যটক ও স্থানীয়দের মধ্যে সংখ্যার ভারসাম্য থাকতে হবে। তা না হলে পর্যটকদের আধিক্য এই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এছাড়া জনবহুল গন্তব্যে কেউ যেতেও চায় না। আবার মানুষ টুরিস্টদের জনাকীর্ণতার মাঝে বসবাস করতে চায় না।
তারপরও কেউ পর্যটকদের অধিকার নিষিদ্ধ করতে বলছে না। শুধু পর্যটকদের সংখ্যা ও ভ্রমণ সময়ের নিয়ন্ত্রণ চাইছে। আমারা একটু সচেতন হলেই এই সমস্যার সমাধান খুব সহজেই সম্ভব। এর জন্য আমাদের যার যার অবস্থান থেকে উদ্যমী হয়ে কিছু বিষয় মেনে চলতে হবে।
১। ভ্রমণ গন্তব্যকে ছড়িয়ে দিন
শুধুমাত্র জনপ্রিয় গন্তব্যের উপর নির্ভর করবেন না। শহরের বাইরে ভ্রমণ করুন। পাশের শহরতলীতে কিংবা গ্রামে ঘুরুন। এতে শুধু জটলাই কমবে না আপনিও স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরতে পারবেন। নতুন অনেক কিছু আবিষ্কার করবেন যা আগে ভাবতেও পারেননি কখনো। এতে পর্যটনেরও বিকেন্দ্রীকরণ হবে। সত্যিই ইতালির ভেনিস, স্পেনের বার্সেলোনা কিংবা আইসল্যান্ডের রিকজাভিক ছাড়াও দেশগুলোতে অনেক জায়গা দেখার আছে।
২। পর্যটন এরিয়াতে খাবেন না
যেখানে টুরিস্টদের ভিড় দেখবেন সেখানে খাবেন না। এই সব জায়গায় সাধারণত খাবারের দাম অনেক বেশি আর মান খুবই নিম্নমানের হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে গুগল ম্যাপের সহায়তা নিন। খুব কাছেই ভালো রেস্তোরাঁ পেয়ে যাবেন। আর এখানে মান আর দামের রকমফেরও হবে না। এতে আপনার ভ্রমণ গন্তব্যের ভিড়ও কমবে।

৩। অফ সিজনে ভ্রমণ করুন
আপনার জন্য আদর্শ আবহাওয়া যখন থাকে সেই অনুযায়ী অফ সিজন থেকে সময় বেছে নিয়ে ভ্রমণ করুন। এতে আপনার খরচ অর্ধেক হয়ে যাবে। যদি অন্যের দেখাদেখি ঘুরতে যান তবে ভিড়ের কবলে পড়বেন। সঙ্গে ভিড় বাড়াতে সহায়তা তো করছেনই। এর থেকে অফ সিজনে যখন খাবার ও থাকার খরচ এবং মানুষের ভিড় কম তখন ভ্রমণ করাই শ্রেয়।

৪। তথ্য সমৃদ্ধ পর্যটক হন
আপনার গন্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন। গন্তব্যের রীতিনীতি, ইতিহাস, আইন সকল কিছু সম্পর্কে আগে থেকেই সবিস্তারে খোঁজ নিন। আপনি যত জানবেন ততটাই সম্মানিত হবেন আর সবার জন্য ততটাই ভাল হবে।

৫। নিয়ম মেনে চলুন
প্রতিটি ভ্রমণ গন্তব্যের কিছু নিয়ম রয়েছে। এছাড়া ঘোরাঘুরিরও মৌলিক কিছু নিয়ম রয়েছে। এগুলো সম্পর্কে জানুন ও মেনে চলুন। স্থানীয় কিংবা আদিবাসীদের সঙ্গে অশোভনীয় আচরণ করবেন না। যেমন আমস্টারডামের মানুষজন মদ্যপ পর্যটকদের আচরণে বিরক্ত হয়ে পড়েছে। চাইলে আপনি পার্টি করতে যেতেই পারেন। তাই বলে মানুষ জনকে বিরক্ত করার অধিকার আপনার নেই।

৬। পরিবেশ বান্ধব হন
যেখানেই যান না কেন প্রাকৃতিক সম্পদ অপচয় কিংবা নষ্ট করবেন না। যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলা, পানি-বিদ্যুৎ অপচয় না করা এই সাধারণ বিষয়গুলো মেনে চলুন। আপনি পর্যটন গন্তব্যগুলোর প্রতি দায়িত্ববান হলে স্থানীয়রাও আপনাকে সমাদর করবে হয়তো। খুবই সাধারণ কথা, যদি জায়গাগুলো নষ্টই করে ফেলেন, আবার সেখানে ফিরে যাবেন কী করে?