বছর ঘুরে যখন ঈদ আসে তখন সবাই ছোটে নিজ গৃহের দিকে। সপরিবারে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে যারা শহর ছেড়ে নিজ গ্রামে যান তাদের কাছে ঈদ মানেই নতুন জামা, দান-খয়রাত, ঈদের নামাজ আর পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে কিছু আনন্দঘন সময় কাটানো।
যারা শহুরে মানুষ তারাও ঈদের দিনটিকে রেখে দেন পরিবার পরিজনদের জন্য। তবে ব্যতিক্রম যে নেই ঠিক তা নয়। আমি শুধু সাধারণের কথা বলছি। ব্যতিক্রম হিসেবে সাংবাদিক ও নিরাপত্তাকর্মীদের ঈদের কথা হয়তো আমরা অনুমান করতে পারি, কিন্তু জানেন কী কেমন কাটে আমাদের তথা টুরিস্টদের ঈদ?
আমি এই ফিচারটি লিখছি নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা থেকে, যেখানে আমি তুলে ধরব পরিবার পরিজন ছেড়ে অচেনা স্থান বা নতুন পরিবেশে ঈদ কাটানোর কিছু ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতা।
থাকার জায়গা

অপরিচিত পরিবেশে ঈদ কাটানোর প্রসঙ্গ সামনে আসতেই প্রথমে যে প্রশ্নটি মনে আসে তা হলো, থাকব কোথায়! ঈদের সময় অধিকাংশ হোটেল কর্মচারীরাই ছুটিতে থাকেন। তাই আগে বুক না থাকলে বেশ বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়।
গত ঈদে আমি পাবনায় গিয়েছিলাম। আমি সেখানে পৌঁছেছিলাম ঈদের আগের রাতে। সেই রাতে যতগুলো হোটেলে গিয়েছিলাম সব হোটেলেই একটা কমন কন্ডিশন ছিল আর তা হলো, সকাল ছয়টার আগে বেরিয়ে পড়তে হবে।
কয়েকটি হোটেল ঘুরে এক পর্যায়ে একটি হোটেলে উঠেছিলাম ঠিকই, কিন্তু সেখানেও একটি সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। ঈদের দিন সকালে বাথরুমে ঢুকে দেখি সেখানে টাওয়েল নেই। আমি সেদিন বাসা থেকে তোয়ালে নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই তোয়ালে ছাড়া যেন চলছেই না।
পুরো হোটেল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও গার্ড ছাড়া কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর দেখা পেলাম না। বাইরে দোকান-পাট সব বন্ধ, নতুন কেনারও কোনো উপায় নেই। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই বিছানার চাদর দিয়ে শরীর মুছতে হলো, যা আমার জীবনের চিরস্মরণীয় একটি ঘটনা হয়ে থাকবে!

তবে হ্যাঁ, কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। পর্যটন এলাকাগুলোতে গেলে ঈদের দিনও পরিপূর্ণ সেবা পাওয়া যায়; যেমন, পাবনায় যাওয়ার আগে আমি কুয়াকাটার কয়েকটি হোটেলে ফোন করেছিলাম। তারা জানালো ঈদের দিনও তাদের হোটেল খোলা থাকবে। কারণ তাদের কর্মচারীদেরকে ঈদের কিছুদিন পরে ছুটি দেওয়া হয়।
খাওয়া-দাওয়া
থাকার জায়গা ঠিক হওয়ার পরে যে প্রশ্নটি মাথায় আসে তা হলো, খাবো কোথায়? এক্ষেত্রেও একটি সমস্যা থাকে আর তা হলো, সন্ধ্যার আগে কোনো খাবার হোটেল বা রেস্তোরাঁ খোলা পাবেন না। আমি বাড়ির বাইরে খুলনা, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও পাবনাতে ঈদ কাটিয়েছি। সব জায়গায়ই এই সমস্যাটি কমনভাবে থাকে।
এক ঈদে আমি সকাল ছয়টায় হোটেল ছেড়ে বেরিয়েছি, ভেবেছিলাম বাইরে খেয়ে নেবো। সারা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো খাবার হোটেল খোলা পাইনি। কী আর করার! শেষমেশ পাউরুটি আর কলা খেয়ে সকালের নাস্তা সারলাম। আর দুপুরে যা খেয়েছিলাম তা আর বলব না। ছবি দেখে নিন।

ছবিতে যে খাবারগুলো দেখছেন এটাও সহজে মেলেনি। এটাকে একজন হোটেল কর্মচারীর দয়া বলতে পারেন। অনেক দোকান ঘুরে-ফিরে খাবার না পেয়ে যখন ক্লান্ত শরীর নিয়ে বসে আছি, তখন হোটেলের এক কর্মচারী বলল- স্যার, আমাদের খাবার থেকে কিছু খাবার বেঁচে যেতে পারে। আপনি চাইলে সেখান থেকে কিছু খেয়ে নিতে পারেন। আমি কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম আর অস্ফুট স্বরেই বললাম, যদি বেশি থাকে তবে দাও।
এরকম আরো অনেক গল্প আছে, একদিন খুলনাতেও এমন একটি ঈদ কেটেছিল। সেদিন খাবার না পেয়ে সকালের নাস্তা করেছিলাম দুপুরে।
তবে আপনি যদি ফাস্টফুড বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে পছন্দ করেন, তবে বেশ ভালোই থাকবেন। কারণ এসময় প্রায় সব মিষ্টির দোকান আর ফাস্টফুডের দোকান খোলা পাবেন।
ঘোরাঘুরি/পরিবহন
ঈদের দিন ভাড়া বেশি লাগে এটা প্রায় সবাই জানেন। কারণ ঈদের দিন প্রায় সবাই-ই কম-বেশি ঘুরতে বের হন। তবে কোনো ঈদ যদি ভ্রমণ নির্ভর হয় তবে আপনি শেষ। টাকা এবং ধৈর্য দুটি জিনিসই বেশি করে নিয়ে বের হবেন। কারণ ঈদের দিন থেকে শুরু করে দুই-তিন দিন ধরে গাড়ি চলাচল কম থাকে। তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ির অপেক্ষায় বসে থাকতে হয়।

আমি একবার ঈদের দিন নাটোরের একটি গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে এক ঘণ্টা বসে থেকেও কোনো গাড়ি পাচ্ছিলাম না। অবশেষে একজন আগন্তুক বাইকারের কাছ থেকে লিফট নিতে হয়েছিল।
বাড়ি ফিরবেন?
এবার বলি আসল কথা, আপনি মনে করুন উপরের সব কয়টি সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। তাই ঈদের দিনই বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা করলেন। এক্ষেত্রেও আপনি আটকে যাবেন। কারণ ঈদের দিন লং রুটে খুব কম গাড়ি চলে। আর যা চলে তা আগে থেকেই বুক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আমি পাবনা গিয়ে উপরোক্ত সব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলাম। তাই বাড়ি ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ট্রেন স্টেশনে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি ট্রেন বন্ধ। তারপর গেলাম বাস টার্মিনালে। সেখানে গিয়ে দেখি কাউন্টার বন্ধ। আশেপাশে কোনো হোটেলও খোলা নেই। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। রাত একটা পর্যন্ত পুরো পাবনা জেলার এ প্রান্ত ও প্রান্ত করে বেড়িয়েছিলাম। সে এক দুর্বিষহ রাত ছিল।
সব শেষে অর্জনের থলে
আপনি যদি সমস্ত প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে পারেন এবং সুস্থভাবে বাড়ি ফিরে আসতে পারেন, তবে স্মৃতির পাতা উল্টানোর সময় খারাপ লাগবে না। এমন কষ্টের মাঝেও হাজার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুখ লাভ করবেন।
Feature Image: yandex.ru