রাজশাহী বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ জেলা। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের এই জেলাটি উত্তরে নওগাঁ জেলা, দক্ষিণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, কুষ্টিয়া জেলা ও পদ্মা নদী, পূর্বে নাটোর জেলা, পশ্চিমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা দিয়ে ঘেরা। এই জেলার মোট আয়তন ২,৪০৭.০১ বর্গ কিলোমিটার। আমাদের দেশের প্রধান নদী পদ্মা রাজশাহী জেলার সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রাজশাহী জেলাকে প্রকৃতি তার নিজ হাতে সাজিয়ে রেখেছে যেন। আর সেই সাথে ইতিহাসে আলতো করে হাত বুলিয়ে গেছে রাজশাহী জেলার পথে প্রান্তরে।
অনুমান করা হয় ‘রামপুর’ এবং ‘বোয়ালিয়া’ নামক দু’টি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয়েছিল রাজশাহী শহর। প্রথমদিকে শহরটি ‘রামপুর-বোয়ালিয়া’ নামে অভিহিত হলেও আস্তে আস্তে তা মানুষের মুখে রাজশাহী নামে পরিচিতি পায়। কিন্তু কোথায় ‘রামপুর বোয়ালিয়া’ আর কোথায় ‘রাজশাহী’! এই রূপান্তরের নেপথ্যে অনেকগুলো কাহিনী রয়েছে।
আজকের রাজশাহী ১৮২৫ সালে তার রাজশাহী নামে প্রথম পরিচিত হয়। কেউ কেউ মনে করেন রাজা গণেশের সময় (১৪১৪-১৪১৮) রাজশাহী নামের উদ্ভব। ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় মনে করেন, রাজশাহী শব্দটি রানী ভবানীর দেয়া নাম। অবশ্য আরেক ঐতিহাসিক মি. গ্রান্ট উল্লেখ করেছেন, রানী ভবানীর জমিদারীই রাজশাহী নামে পরিচিত ছিল।
রাজশাহী নামের মধ্যে এক অদ্ভুত অসাম্প্রদায়িক মেলবন্ধন রয়েছে। সংস্কৃত ‘রাজ’ গিয়ে ফারসি ‘শাহী’র সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সাধারণের হিসাব অনুযায়ী এখানে বহু উচ্চপদস্থ মানুষ বসবাস করতেন বিধায় এটি ‘রাজার শাহী’ বা ‘রাজশাহী’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।
চলুন আজ জেনে আসা যাক রাজশাহী আমাদের জন্য কী কী সৌন্দর্যের আকর সাজিয়ে বসে আছে।
পুঠিয়া রাজবাড়ী:

রাজশাহী জেলার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থাপনা হচ্ছে পুঠিয়া রাজবাড়ি। রাজশাহী জেলা সদর হতে ৩২ কি.মি. উত্তর-পূর্বে এটি অবস্থিত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, মোঘল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে নীলাম্বর নামে একজন প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন এই অঞ্চলে। তিনি তার প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেন। এই পুঠিয়া রাজবাড়ী তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন।
জমিদারি বিলুপ্ত হয়ে গেলেও প্রাচীন প্রাসাদ, মন্দির ও অন্যান্য স্থাপনা এখনো টিকে রয়েছে। বর্তমানে যে প্রাসাদটি দেখতে পাওয়া যায় এটি ১৮৯৫ সালে মহারানী হেমন্ত কুমারী দেবী তাঁর শাশুড়ি মহারানী শরৎ সুন্দরী দেবীর সম্মানে নির্মাণ করেন।
বাংলাদেশের অন্যান্য রাজবাড়ীর থেকে এটি ভালোভাবে সংরক্ষিত। এর কারুকার্যও নজরকাড়া। এই রাজবাড়ির দেয়ালে ও দরজার উপরে, বিভিন্ন পিলারের গায়ে ফুল ও লতাপাতার চিত্রকর্ম এখনো নজর কাড়ে। রাজবাড়ীর চারপাশে পরিখা রয়েছে। এই পরিখাগুলোর আবার আলাদা আলাদা নাম রয়েছে। যেমন: শিব সাগর, গোপাল চৌকি, মরা চৌকি, বেকি চৌকি প্রভৃতি।
আর রাজবাড়ির কেন্দ্রস্থলে রয়েছে বিশাল একটি পুকুর যেটি শ্যাম সাগর নামে পরিচিত। এই স্থাপত্যগুলো ইন্দো ইউরোপিয়ান স্টাইলে নির্মাণ করা হয়েছে। সমস্ত রাজবাড়ি প্রায় পঁচিশ একর জায়গার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। রাজবাড়ী ও তার আশেপাশের মৌজায় প্রায় চৌদ্দটি মন্দির এখনো তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।
বড় আহ্নিক মন্দির, পুঠিয়া:

পুঠিয়ার রাজা কর্তৃক স্থাপিত আরেকটি অনন্য সুন্দর স্থাপনা পুঠিয়ার বড় আহ্নিক মন্দির। বড় আহ্নিক মন্দির পুঠিয়া মন্দির চত্বরের সবচেয়ে দক্ষিণে দিকে অবস্থিত। এর ঠিক উত্তর পাশে রয়েছে আরেকটি মন্দির। যার নাম ছোট গোবিন্দ মন্দির। উত্তর দক্ষিণ দিকে বিস্তৃত এই মন্দিরটি আয়তাকার। মোট তিনটি কক্ষ রয়েছে মন্দিরটিতে। দেখলে মনে হয় যেন তিনটি আলাদা আলাদা মন্দির একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। মধ্যভাগের মন্দির কক্ষ অন্যগুলোর থেকে বড়। পাশের মন্দির কক্ষ দুটি বর্গাকার এবং একই আকারের।
মন্দিরের পুব দিকে তিনটি খিলান দরজা রয়েছে। মন্দিরের উপরের ছাদ দু’চালা রীতিতে নির্মিত। মন্দিরের উত্তর, দক্ষিণ ও পশ্চিম পাশের দেয়াল নিরাভরণ এবং কোনো প্রকার টেরাকোটা বা অলংকরণ দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু সামনের দিকের দেওয়ালে সুন্দর কারুকাজ রয়েছে।
বড় শিব মন্দির, পুঠিয়া:

রাজশাহীর একটি অনবদ্য স্থাপনা পুঠিয়ার বড় শিবমন্দির। রানী ভুবনময়ী দেবী কর্তৃক এই অসাধারণ মন্দিরটি ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। যদিও এর সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয় ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে। ভুবনময়ী দেবীর নামানুসারে মন্দিরটি ভুবনেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত। পুঠিয়া বাজার থেকে পুঠিয়া রাজবাড়ির দিকে এগোলে সর্বপ্রথম আপনার চোখে যে স্থাপনাটি আসবে সেটি হলো এই বড় শিব মন্দির। মন্দিরটির ডানপাশে রথ মন্দির এবং পেছনে গোপাল চৌকি নামে দুটি বিশালাকার দীঘি রয়েছে।
মন্দিরটি চার মিটার উঁচু প্লাটফর্মের উপরে নির্মিত। মন্দিরটি বর্গাকার। প্রতিটি দেয়াল ১৯.৮১ মিটার দীর্ঘ। সর্বোচ্চ চূড়ার উচ্চতা ভূমি থেকে ৩৫.০৫ মিটার। মন্দিরের চারপাশে রয়েছে টানা বারান্দা আর কেন্দ্রে একটি গর্ভগৃহ। মন্দিরটি মূলত পঞ্চরত্ন স্থাপত্য পরিকল্পনায় নির্মিত। তবে জটিল বিন্যাসে এর সাথে আরো অসংখ্য ক্ষুদ্র রত্ন বা শিখর রয়েছে।
পঞ্চরত্ন গোবিন্দ মন্দির:

রানী ভুবনময়ী দেবী কর্তৃক নির্মিত আরেকটি অসাধারণ স্থাপনা পঞ্চরত্ন গোবিন্দ মন্দির। এই মন্দিরটি পুঠিয়া রাজবাড়ির সবচেয়ে কাছে অবস্থিত। মন্দিরে প্রবেশের মূল প্রবেশপথ রাজবাড়ির পেছনে অবস্থিত। আর মন্দিরের পেছনে অবস্থিত ছিল মহারানীর স্নানঘাট। ইট দিয়ে নির্মিত মন্দিরের গায়ে অসাধারণ পোড়ামাটির কারুকার্যময় ফলক রয়েছে। পোড়ামাটির ফলকে রামায়ণ মহাভারতের কাহিনী ঠাঁই পেয়েছে।
কীভাবে যাবেন:
বাংলাদেশের সব জেলা থেকেই রাজশাহী জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। আপনি ঢাকা থেকে সড়ক কিংবা রেল উভয় পথেই যেতে পারবেন। আপনি যদি বাসে যেতে চান তাহলে গ্রিন ও হানিফ এন্টারপ্রাইজ বেছে নেওয়া ভালো হবে। হানিফ এন্টারপ্রাইজের মূল কাউন্টারের ঠিকানা হলো- ১৬৭/২২, ইনার সার্কুলার রোড, আরামবাগ, ঢাকা। ফোন: ০১৭১৩-৪০২৬৭১, ০১৭১৩-৪০২৬৩১। হানিফের গাড়ি ছাড়ার সময় সকাল ৮:০০ টা ও রাত ৮:০০ টা।
আর রেলে যেতে চাইলে আপনাকে বেছে নিতে হবে সিল্ক সিটি এক্সপ্রেস, পদ্মা এক্সপ্রেস ও ধূমকেতু এক্সপ্রেসগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি। আগে থেকে খোঁজ নেওয়ার জন্য কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ০১৭১১৬৯১৬১২ মোবাইল নাম্বারে কিংবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন ৮৯২৪২৩৯ ফোন নাম্বারে যোগাযোগ করতে পারেন। রাজশাহী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে নাটোরগামী বাসে পুঠিয়া আসতে আপনার সময় লাগবে পৌনে এক ঘন্টার মতো।
পুঠিয়াতে জেলা পরিষদের দুটি ডাকবাংলো রয়েছে যেখানে আপনি থাকতে পারবেন। সেক্ষেত্রে আগেই জেলা পরিষদ থেকে অনুমতি নিতে হবে। জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ফোন নাম্বার ০৭২১৭৭৬৩৪৮। এছাড়া পুঠিয়া বাজারের পাশে একটি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হোটেল রয়েছে। সেখানেও আপনি চাইলে থাকতে পারেন।
Feature Image: Khalid Rahman